অতিমারি এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধের আর্থসামাজিক ক্ষতির পরিমাণ বিপুল, তা সুদূরপ্রসারীও বটে। আমাদের মতো দেশে সেই ক্ষতি আরও ব্যাপক। ক্ষতি যখন হয়েছে, তখন সেটা কারও না কারও ক্ষতি তো বটেই। খবরে যা দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে যে, এই অতিমারির বছরেও বিশিষ্ট শিল্পপতি থেকে সরকারি অফিসের কেরানি, অনেকেরই আর্থিক লাভ হয়েছে বেশ। তা হলে প্রশ্ন হল, ক্ষতির ভারটা কে বা কারা বহন করছেন, করবেন?
এই ক্ষতির বণ্টনের প্রক্রিয়া যদি পুরোপুরি বাজার অর্থনীতির উপর ছেড়ে দেওয়া হয়, তা হলে একটা মাৎস্যন্যায়ের মতো পরিস্থিতি হতে পারে। যেখানে বড় সংস্থা ছোট সংস্থার উপর, এবং বেশির ভাগ সংস্থাই সাধারণ কর্মচারী বা সাধারণ উপভোক্তার উপরে ক্ষতির ভার চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে— যেখানে সম্ভব, সেখানেই। আর যেখানে সেটা সম্ভব নয়, সেখানে একটা অরাজকতার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে।
একটা দেশের অর্থব্যবস্থার যখন বৃদ্ধি হয়, তার একটা ভাল দিক হচ্ছে, বেশির ভাগ মানুষেরই কম-বেশি উন্নতি হয়। সেই উন্নতির একটা মাপকাঠি হচ্ছে চাকরি বা সমাজের অর্থনীতিক কাঠামো বা সিঁড়ির উপরের ধাপে পৌঁছনো। ধরা যাক, কেউ রাস্তার ধারে একটা ছোট অস্থায়ী দোকান চালাতেন। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি হয়তো একটা স্থায়ী দোকান দিলেন। এক জন চর্মকার শুধু জুতো সেলাই না করে সঙ্গে কিছু জুতো বিক্রি করতেও শুরু করলেন।
স্বভাবতই, এই গোত্রের উন্নতি এক দিনে হয় না, ধাপে ধাপে আস্তে আস্তে হয়। অতিমারি এই উন্নতিগুলোকে এক ধাক্কায় কেড়ে নিতে পারে, এবং মানুষগুলোকে ফিরিয়ে দিতে পারে আগের অবস্থানে। যে উন্নতি হতে দশ বছর লেগেছে, হয়তো এক বছরের মধ্যে সেটা সম্পূর্ণ ধুয়েমুছে গেল। এক জন সাধারণ মানুষ হয়তো একটু ভাল জীবনের স্বাদ পেতে শুরু করেছিলন— একটু ভাল খাবার, পোশাকআশাক, স্বাস্থ্যকর জীবন— তাঁর থেকেও সেটা কেড়ে নিতে পারে অতিমারি। চার পাশে এমন ঘটনা ঘটেই চলেছে।
এই ক্ষতি অনেক ভাবে ঘটতে পারে— জীবিকা চলে গেলে, বা চাকরি থাকলেও আয় কমে গেলে। আয় কমে যাওয়ার শঙ্কাটা অনেক বেশি। সেটা আরও বেশি সম্ভব যখন বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা নিজেদের ক্ষতি কমানোর জন্য সেই বোঝার ভার যতটা সম্ভব অন্য কারও উপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। যেমন, বিশেষত ছোট সংস্থাগুলো তাদের কর্মচারীদের বেতন কমিয়ে নিজেদের ক্ষতি কমানোর চেষ্টা করবে। অন্য দিকে, বিভিন্ন বড় সংস্থা যেখানে বাজার শক্তিশালী, সেখানে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করে ক্ষতি কমানোর চেষ্টা করবে। যাঁদের হাতে উৎপাদক সম্পদ নেই, বা অতি সামান্য, এই দু’ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত তাঁদের উপরই এসে পড়বে বেশির ভাগ ক্ষয়ক্ষতির বোঝা। এবং, তার ফলে সম্পদের অসম বণ্টন আরও ত্বরান্বিত হবে।
এই সম্পদের অসম বণ্টন যে কী বিষম বস্তু, তার একটা ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক। আজিম প্রেমজি ইউনিভার্সিটি ২০২০ সালে এপ্রিল আর মে মাসে দেশের ১৬১টা জেলার পাঁচ হাজার গরিব মজুর, ছোটখাটো স্বনিযুক্ত মানুষকে নিয়ে একটা সমীক্ষা করেছিল। তাতে দেখা গিয়েছিল, প্রতি তিন জনের মধ্যে দু’জনেরই আয়ের রাস্তা বন্ধ; ৭৭ শতাংশ মানুষ কম খাবার খেয়েছেন আগের তুলনায়; ৪৭ শতাংশ মানুষের কাছে টাকাই ছিল না নিতান্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার মতোও।
আর, এ বছর মে মাসে বাজারে এল দুটো গাড়ি— একটার দাম সাড়ে তিন কোটি টাকা; অন্যটা আড়াই কোটি। দ্বিতীয় গাড়ির নির্মাতা সংস্থাটি ভেবেছিল, বছরে গোটা পঞ্চাশেক গাড়ি বিক্রি হবে ভারতে। তাদের সব অনুমান উড়িয়ে দিয়ে পঞ্চাশটা গাড়িই প্রি-বুকড হয়ে যায়। এর পর সেই গাড়ি কিনতে হয়তো বছরখানেক অপেক্ষা করতে হবে। কোনও সংস্থা কতগুলো গাড়ি বাজারে আনবে, সেটা স্থির করা হয় বহু হিসাবনিকেশের পর। অর্থাৎ, এই অতিমারি-আক্রান্ত সময়ে ভারতীয় ক্রেতাদের একাংশের ক্রয়ক্ষমতার কোনও আন্দাজ সেই বিশ্বখ্যাত বহুজাতিক সংস্থাটিরও ছিল না।
ভারতে সম্পদের অসম বণ্টন অবশ্য আজকের ঘটনা নয়— বেশ কয়েক বছর ধরেই সেই অসাম্য বেড়ে চলছে। বণ্টনের অসাম্য আর পরিবেশ দূষণের মধ্যে একটা আশ্চর্য মিল আছে— এগুলো যখন বাড়ে, তখন সাধারণ মানুষ বিশেষ কিছু টের পান না, ফলে সেই অসাম্য বা দূষণ ঠেকানোর জন্য বিশেষ চাপও তৈরি হয় না। জল যখন গলা পর্যন্ত পৌঁছয়, তখন টনক নড়ে সাধারণ মানুষের। কিন্তু তখন আর কিছু করার থাকে না। পরিস্থিতিকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে— যদি আদৌ তা ফিরিয়ে আনা যায়— যে মেহনত আর সময় লাগে, তার পরিমাণ পরিস্থিতি খারাপ করতে লাগা সময় আর মেহনতের তুলনায় অনেক বেশি।
এই ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার তার নীতি প্রয়োগ করে এই ক্ষতি বা সম্পদের অসম বণ্টনের প্রভাব কম করতে পারে। এক হতে পারে যে, রাজকোষের টাকা খরচ করে সরকার দরিদ্র বা সাধারণ আয়ের মানুষকে রক্ষা করল। কিন্তু, সরকারের সেই ক্ষমতা সীমিত, বিশেষত এই অতিমারির সময়ে। কাজেই, ক্ষতির বোঝা বহন করার ক্ষমতা যাঁদের সীমিত, সরকারকে যদি তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হয়, তা হলে হয় করের পরিমাণ বাড়াতে হবে, নয় আরও ধার করতে হবে। এখানেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের মূল্যায়ন জরুরি হয়ে ওঠে। আয়ের সাপেক্ষে পরোক্ষ করের বোঝা মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তের তুলনায় দরিদ্র বা নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের উপর বেশি পড়ে। কাজেই, পরোক্ষ কর আদায়ের পরিমাণ বাড়িয়ে সরকার অর্থসংস্থান করতে চাইলে এই সঙ্কটকালে হিতে বিপরীত হওয়ার ঝুঁকি।
সে ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ কর আদায়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে। সেটা সম্ভব না হলে সরকারকে বাজার থেকে ধার করতে হবে। ধার করলে আবার সরকারকে সেই টাকাটা ফেরত দিতে হবে নিজের আয় থেকেই। এই ক্ষেত্রে ধারটা যদি দীর্ঘমেয়াদি হয়, তা হলে সেটা ফেরত দেওয়ার জন্য সরকারের হাতে খানিকটা সময় থাকে। বিগত কিছু বছর ধরে দেখা যাচ্ছে যে, সারা পৃথিবী জুড়েই বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক (ভারতের ক্ষেত্রে যেমন রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক) এগিয়ে আসছে সরকারকে সাহায্য করতে। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক টাকা জুগিয়ে সরকারের তহবিলের ঘাটতি পূরণ করছে। এই ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সরকার ধার করছে ঠিকই, কিন্তু সেটা বাজারের উপরে ঠেলে না দিয়ে, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সেই ধারের অনেকটাই জোগান দিচ্ছে। না হলে সুদের হারের উপর এই ঋণের ছাপ পড়ত, সেই হার ঊর্ধ্বমুখী হত।
ক্ষতির যুক্তিপূর্ণ বণ্টন অর্থনীতির বৃদ্ধির হার বাড়ায় এবং ভিত্তি মজবুত করে। অসম বণ্টনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতি সুদূরপ্রসারী। এখন অর্থনীতির উপরে অতিমারির প্রকোপ কমানোর জন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বনের চিন্তা চলছে বটে, কিন্তু একই সঙ্গে এই ক্ষতির বণ্টনের চিন্তাটা যে চাপা পড়ে যাচ্ছে, সেটা ভুললে চলবে না। ক্ষতির মোট বোঝা কমানো জরুরি তো বটেই, কিন্তু তার সুষম বণ্টন হওয়াটাও জরুরি।
ইন্ডিয়া রেটিং অ্যান্ড রিসার্চ। মতামত ব্যক্তিগত