— ফাইল চিত্র।
নির্বাচন এলেই নাগরিক সমাজে একটা টানাপড়েন তৈরি হয়। নানা রাজনৈতিক প্রশ্নে কী করণীয়, তা নিয়ে তৈরি হয় নানা বিভাজন। ২০১১ থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিষয়টা স্পষ্ট সামনে আসছে। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পর নাগরিক সমাজ থেকেই শাসক বামফ্রন্টকে ‘পরিবর্তন’-এর স্লোগান উঠেছিল। গত বিধানসভা নির্বাচনেও ‘নো ভোট টু বিজেপি’ স্লোগান সাড়া ফেলেছিল, যা তৃণমূলের পালে হাওয়া জুগিয়েছিল। কয়েক মাস আগে কর্নাটকের বিধানসভার নির্বাচনে নাগরিক সংগঠনগুলি এক ছাতায় এসেছিল। তাদের গৃহীত কার্যসূচি বিজেপিকে পরাস্ত করে কংগ্রেসের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। তেলঙ্গানাতে আবার মাওবাদী-প্রভাবিত নাগরিক সংগঠন শাসক দল টিআরএস (বর্তমানে বিআরএস)-কে পরাস্ত করতে সক্রিয় ছিল।
লোকসভা নির্বাচন এসে গেছে। ফিরে দেখা দরকার, নাগরিক সংগঠনের রাজনৈতিক সক্রিয়তায় আখেরে কার লাভ হচ্ছে? নাগরিক আন্দোলন কি শক্তিশালী হচ্ছে? নাগরিক আন্দোলনের সমর্থনে জিতে আসা সরকার কী প্রতিদান দিচ্ছে? কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনের সময় শাসক বিজেপি সরকারের পাশ করা চারটে জনবিরোধী আইনের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজ খড়্গহস্ত ছিল ভূমি সংস্কার সংশোধনী আইন, কৃষিপণ্য বিপণন আইন এবং আট ঘণ্টার শ্রম দিবসকে বারো ঘণ্টা করার আইন। কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতি ছিল, ক্ষমতায় এলে আইনগুলি বাতিল করবে। হিজাব নিষিদ্ধকরণের ফরমানও বাতিলের কথা ঘোষণা করেছিল কংগ্রেস।
ক্ষমতায় বসার পর আট মাস কেটে গেলেও কর্নাটকের কংগ্রেস সরকার একটি আইনও বাতিল করেনি, এমনকি বদলও নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব পরার অধিকারও ফিরে পায়নি মেয়েরা। কিছু দিন আগে কর্নাটকে আটাত্তরটি নাগরিক সংগঠন একযোগে প্রতিশ্রুতি পূরণের দাবিতে আটচল্লিশ ঘণ্টা ধর্না কর্মসূচি পালন করে রাজ্যের সচিবালয়ের কাছে। হাজার হাজার মানুষ এই ধর্নায় অংশগ্রহণ করেন। কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বৈঠকে বসার প্রতিশ্রুতি দেন, একটি প্রতিশ্রুতিও রক্ষিত হয়নি। তেলঙ্গানাতেও ভোটের পরে বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন একযোগে রাস্তায় নেমেছিল। দাবি ছিল, বিগত সরকারের আনা মিথ্যা মামলাগুলি, বিশেষত ইউএপিএ মামলাগুলি, প্রত্যাহার করুক নতুন কংগ্রেস সরকার। মানা হয়নি সে দাবি।
পশ্চিমবঙ্গের ছবিও ভিন্ন নয়। ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল, ক্ষমতায় এলে সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে। জঙ্গলমহল থেকে যৌথ বাহিনী প্রত্যাহার করা হবে। রাজ্য সরকারি কর্মীদের কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দেওয়ার স্থায়ী আদেশনামা বার করা হবে। ইউনিয়নগুলির সঙ্গে প্রতি মাসে বৈঠক করা হবে। রাজ্যে ঝলমলে এক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। এত দিনে এক জন রাজনৈতিক বন্দিকেও সরকার মুক্তি দেয়নি। বেশ কিছু রাজনৈতিক বন্দি গত ১৩-১৪ বছর ধরে বিচারাধীন বন্দি হিসাবে জেলে পচছেন।
পশ্চিমবঙ্গে নাগরিক সংগঠনগুলির সদস্যের একটি বড় অংশ চায়, বিজেপি ক্ষমতাচ্যুত হোক। নানা সংগঠন ইতিমধ্যে সরব হয়েছে। কিন্তু কর্নাটক, তেলঙ্গানা বা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার পরে বিজেপি-বিরোধী দলের সরকারগুলি যে ভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তাতে কী ভাবে ওই বিরোধীদের সমর্থনে কাজ করবে নাগরিক সংগঠনগুলি? তা করতে গিয়ে সংগঠনগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। গত বিধানসভা নির্বাচনে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ আন্দোলনে যোগ দিয়ে বহু বাম মনোভাবাপন্ন সংগঠন তৃণমূলকেই সমর্থন করা হল, এই চিন্তায় হতাশ হয়ে পড়েছে।
বিজেপি নাগরিক সমাজ ও বাক্স্বাধীনতার প্রতি কতখানি বিরূপ, কত সহজেই বিরোধী স্বরকে ‘আর্বান নকশাল’ বলে দাগিয়ে দেয়, তা কারও অজানা নেই। কিন্তু এ দেশে নাগরিক সংগঠনগুলির শক্তি এমন নয় যে, সেগুলি রাজনৈতিক দলগুলিকে শর্ত দেবে, এবং নির্বাচনে জিতে সরকার গড়লে সে সব দাবি মানতে বাধ্য করবে। এমন কোনও ব্যক্তিত্বও নেই, যাঁর কথায় নাগরিক বা রাজনৈতিক সমাজে গভীর ছাপ পড়বে। সরকার যাঁর বক্তব্যকে যথেষ্ট সমীহ করে, এমন ব্যক্তিও পাওয়া দুষ্কর।
অতএব নাগরিক সমাজের রাজনৈতিক প্রতিবাদ কেমন হবে, তা নিয়ে চর্চা দরকার। ফ্যাসিবাদী শক্তির সুবিধা না হয়ে যায়, সেটা দেখতে হবে। আবার, নাগরিক সংগঠনগুলি কোনও বিরোধী দলকে খোলাখুলি সমর্থন করলেও সমস্যা— ভবিষ্যতে সেই সরকারের জনবিরোধী কাজের বিরুদ্ধে কথা বলার নৈতিক অধিকার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। নাগরিক সংগঠনের স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাস করছেন না মানুষ।
আপাতত প্রশ্নটা আরও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, উগ্র ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী শক্তির হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করা নাগরিক সমাজের কর্তব্য। কিন্তু সে কর্তব্য পালনের জন্য কোনও দলের পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য প্রচার করা কি যথার্থ কৌশল? না কি, শুধু প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে, নানা ভাবে জনবিরোধী শক্তির মুখোশ উন্মোচনই কর্তব্য?
বর্তমান পরিস্থিতি মাথায় রাখলে মনে হয়, ভোটের রাজনীতিতে সরাসরি যুক্ত হলে ক্রমে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট।