—প্রতীকী ছবি।
মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত এক গ্রামে। কথায় টরটরে, চলায় চটপটে, গ্রাম ঘুরিয়ে দেখানোর কথা উঠতেই সে এক পায়ে খাড়া। অসরকারি সংস্থার কর্মী মেয়েটিকে দেখে লোকে হাসিমুখে কথা বলে, সে-ও স্বচ্ছন্দে এর-ওর বাড়ি ঢুকে যায়। মুদির দোকানের সামনের জটলায় ঢুকে কষে বকুনি দিতেও ছাড়ে না: “বলেছিলাম ওই ব্যাপারটা নিয়ে বিডিও অফিসে চিঠি দিন, কই লিখলেন?” সিকিবুড়ো, আধাবুড়োরা ঘাড় নেড়ে আমতা আমতা করেন। ফেরার পথে তাকে প্রশ্নটা করেই ফেলা গেল, তুমি ভোটে দাঁড়াও না কেন? তা হলে তো একে-ওকে না ধরে, নিজেই কাজ করতে পারতে? উত্তর এল, “এখন আমি গাঁয়ের সবার সঙ্গে কথা বলি। ভোটে দাঁড়ালে অর্ধেক মানুষের সঙ্গে কথাই বলতে পারব না।”
রাজনীতিই কেবল যোগ্য মেয়ে খোঁজে, তা তো নয়, মেয়েরাও যোগ্য রাজনীতি খোঁজে। ‘নারীশক্তি বন্দন অধিনিয়ম’ পাশ হয়েছে। এর ফলে সংসদ, বিধানসভায় আরও বেশি মেয়ে আসার ব্যবস্থা একটা হল বটে। কিন্তু তারা কোন মেয়ে? যারা নিজের পরিচিতি নিজে তৈরি করেছে, তারা কি আসবে? নেতা-মন্ত্রীদের তৈরি ভুয়ো কোম্পানির ‘ডিরেক্টর’ ‘সিইও’ বৌ-মেয়েরা আজ ইডি-সিবিআইকে বলছে, “আমরা তো কিছুই জানি না।” এটাই দলীয় রাজনীতির মডেল। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতে মহিলা জনপ্রতিনিধি উনিশ হাজারেরও বেশি, মেয়েদের দাবি নিয়ে উনিশটা গলাও শোনা যায় না। সংরক্ষিত আসন যেন গয়না— দেখানোর বস্তু। হওয়া তো উচিত ছিল তরবারি।
মেয়েরা যদি সত্যিই মেয়েদের স্বার্থে রাজনৈতিক ক্ষমতার তরোয়াল চালাত, কেমন হত? ধরুন যদি সংসদ আইন করত, বধূ-কন্যার নাম দলিলে না রাখলে জমি নথিভুক্ত করবে না ভূমি দফতর? যদি মেয়েদের বেতনহীন শ্রমের অনুপাত জিডিপি-র চল্লিশ শতাংশ থেকে কুড়ি শতাংশে নামানোর নীতি গ্রহণ করত কেন্দ্র? যদি বিধানসভায় সব দলের মেয়েরা দাবি তুলত, বেআইনি মদের ঠেক চলছে, ধরা পড়লে পুলিশকে জরিমানা দিতে হবে? দেশটা তখন মেয়েদের যোগ্য দেশ হত।
এমন স্বপ্ন দেখতে পারা আর দেখাতে পারার ক্ষমতাই তো রাজনৈতিক ক্ষমতা। এক দিন সেই শক্তিতেই মেয়েরা এক অসম্ভব দাবি করেছিল— ছেলেদের একটা ভোট থাকলে, মেয়েদেরও একটা ভোট থাকতে হবে (১৯১৭)। তখন মহাত্মা গান্ধীও সায় দিতে পারেননি। মেয়েদের বলেছিলেন, এ হল দেশের কাজ করার সময়। মেয়েরা শোনেনি। বাংলায় ১৯২১ সালে ‘বঙ্গীয় নারী সমাজ’ তৈরি করে কামিনী রায়, মৃণালিনী সেন, কুমুদিনী বসু, বেগম রোকেয়ার মতো মহিলারা জেলায় জেলায় সভা করেন। তবু বাংলার আইনসভায় ৩৭-৫৬ ভোটে প্রস্তাবটি পরাজিত হয়। বর্ধমানের শহীদ সুরাওয়ার্দি (পরে বাংলার প্রধানমন্ত্রী) প্রশ্ন করেছিলেন, মেয়েরা কী এমন করেছে যে, তাদের যোগ্য ভাবতে হবে? প্রত্যুত্তরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলমান মহিলা স্নাতক সুলতানা মোয়াজ্জাদা একটি ইংরেজি দৈনিকে লিখেছিলেন, বাংলার মেয়েদের, বিশেষত মুসলমান মেয়েদের, হীন অবস্থার জন্য দায়ী কারা?
১৯১৯-২০ সালে বম্বে, মাদ্রাজের আইনসভা সেখানকার মেয়েদের (সীমিত) ভোটাধিকার দিয়েছিল, অথচ, ১৯২১ সালে বাংলার নেতারা তা খারিজ করেছিলেন, এই ঘটনা সযত্নে এড়িয়ে যায় অধিকাংশ পাঠ্যবই। ভাবখানা এমন যেন, ভোটের অধিকার মেয়েরা না চাইতেই পেয়েছে। এই বিস্মরণও এক রাজনীতি। চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে স্বরাজ্য দল বেঙ্গল কাউন্সিলে ক্ষমতায় এলে, ১৯২৪-এ কলকাতা পুরসভার ভোটে মেয়েরা সীমিত ভোটাধিকার পায়।
মেয়েদের নেতৃত্ব পুরুষরা না পেরেছে গিলতে, না ওগরাতে। বিপ্লবীরাও মেয়েদের নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার মতো বৈপ্লবিক কাজ করে উঠতে পারেনি, তার দৃষ্টান্ত লীলা নাগ। ঢাকার মেয়েদের সংগঠিত করে দীপালি সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার পরে ১৯২৬ সালে তিনি যোগ দিলেন শ্রীসঙ্ঘ বিপ্লবী দলে। সেই প্রথম বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবী দলে মেয়েদের সদস্য করা হল। তিনি ও তাঁর সঙ্গিনীরা অস্ত্র সংগ্রহ, সরবরাহও করতেন। ১৯২৮ সালে দলনেতা অনিল রায় লীলার সংগঠন-প্রতিভার স্বীকৃতি দিতে ‘দ্বৈত নেতৃত্ব তত্ত্ব’ প্রস্তাব করলেন। দল ভেঙে গেল, রক্ষণশীলরা তৈরি করলেন অন্য দল। লীলা নাগের (রায়) সাংগঠনিক প্রতিভা দেখে সুভাষচন্দ্র বসু তাঁকে ‘ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি’-র সদস্য করেন। যে বারো জন মহিলা সংবিধান রচনায় যোগ দেন, লীলা তাঁদের এক জন।
একটি মেয়ে যদি কর্তৃত্বের ভূমিকা চায় নিজের জন্য, তার প্রতি গভীর সন্দেহ তৈরি হয় ঘরে এবং বাইরে। জনজীবনে, কর্মক্ষেত্রে যে মেয়েরা নেতৃত্ব ক্ষমতার কিছুমাত্র পরিচয় দেয়, তাদের জোটে অনাস্থা, শ্লেষ, কদর্য অপবাদ। বাড়তি চাপ এড়াতে বহু মেয়ে উন্নতির সুযোগ ছেড়ে দেয়। এ বছর নারী দিবসের অনুষ্ঠানে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের এক মহিলা আধিকারিক তাঁর জুনিয়র মেয়েদের মিনতি করছিলেন, “প্লিজ়, তোমরা প্রমোশন নিয়ো, ছেড়ে দিয়ো না।”
মেয়েরা হয় নিজেদের অযোগ্য ভাবে, নইলে ভাবে কর্মক্ষেত্রে বা রাজনীতিতে নেতৃত্বের চাইতে আরও জরুরি কাজ তার আছে। এই চিন্তা ব্যক্তিগত নয়, মেয়েদের মধ্যে এমন প্রতিযোগিতা-বিমুখতা তৈরি করে রাজনীতি। তাই এক-তৃতীয়াংশ আসনে মেয়েদের টিকিট না দিয়ে, বরং আসন সংরক্ষণ করল সংসদে। যে মেয়েরা নিজেদের নেতৃত্বের ক্ষমতা নিজেরাই প্রমাণ করে, তাদের সরিয়ে দেয়। একশো বছর আগে, বছর ছাব্বিশের এক তরুণীর নেতৃত্বে নৈহাটির গৌরীপুর চটকলে ধর্মঘট হয়। তিন মাস পরে শ্রমিকদের শর্ত মেনে দরজা খোলে চটকল, অবিসংবাদিত শ্রমিক নেত্রীর স্বীকৃতি পান সন্তোষকুমারী দেবী। তাঁর নেতৃত্বে অন্তত ন’টি বড় চটকল ধর্মঘট হয়। এমনই ছিল তাঁর জনপ্রিয়তা যে, ব্যারাকপুর থেকে স্বরাজ্য দলের সমর্থনে রাজনীতিতে আনকোরা বিধানচন্দ্র রায় প্রার্থী হলে চিত্তরঞ্জন দাশ সন্তোষকুমারীকে অনুরোধ করেন প্রচার করতে। বিপক্ষে ডাকসাইটে কংগ্রেস নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। জয়ী হন বিধানচন্দ্র। তবু ১৯২৭ সালের পর সন্তোষকুমারী সম্পূর্ণ সরে গেলেন রাজনীতি থেকে। কেন, তা জানাও যায় না। যেমন আজ আমরা জানি না, কেন বড় বড় ট্রেড ইউনিয়নের মিছিলে হাঁটে এত মেয়ে, অথচ মহিলা নেত্রী, এমনকি মুখপাত্র, এত বিরল।
তেভাগা আন্দোলন, নকশালবাড়ি থেকে নন্দীগ্রাম, যে মেয়েরা জমি রক্ষার জন্য পুরুষের আগে গিয়ে পুলিশের গুলির সামনে দাঁড়িয়েছিল, রাজনৈতিক দল তাদের প্রাণশক্তি, ধীশক্তির সম্পূর্ণ ব্যবহার করেছে। কিন্তু দলে বা প্রশাসনে তাদের জায়গা ছাড়েনি। চাষের জমিতে মেয়েদের অধিকারও স্বীকার করেনি। যেখানে রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পদাধিকারী মহিলা, সেখানেও মেয়েদের সম্পদের অধিকার, নিরাপত্তার অধিকারের প্রতি সমান অন্ধত্ব।
তাই আজ তাকাতে হবে নারীবাদের প্রথম ঢেউ, ১৯২০-৪০ সময়কালের দিকে। জাতীয় কংগ্রেস, কমিউনিস্ট দল, সশস্ত্র বিপ্লবী দল, ট্রেড ইউনিয়ন, প্রবেশমাত্রই সর্বত্র মেয়েরা লড়াই করেছে দু’হাতে। এক হাতে দলের ভিতরে, মেয়েদের যোগ্য দল তৈরির জন্য, অন্য হাতে অপশাসনের বিরুদ্ধে, বাসযোগ্য দেশ তৈরির জন্য। পাঁকে গাঁথা পা, বর্ম-ঢাল নেই, দু’হাতে তরোয়াল, এ তো অসম্ভব যুদ্ধ! ঠিক তাই। ওই হল সাম্যের লড়াই।