—প্রতীকী ছবি।
ভরা বাজারে দু’জন যুবক কথা বলছেন। আলাপচারিতায় বুঝতে অসুবিধা হয় না, উভয়েই পরস্পর পরিচিত, হয়তো বন্ধুই। কিন্তু দু’জনেই কথা বলার সময় প্রতিটি বাক্যের মাঝে বা শেষে একটি অশ্লীল শব্দ জুড়ে দিচ্ছিলেন। এক বয়স্ক ভদ্রলোক দোকানির সঙ্গে কথা থামিয়ে বিনীত ভাবে বললেন, “আমার একটা জিজ্ঞাস্য আছে, যদি কিছু মনে না করেন। আপনারা প্রতিটি কথার মধ্যে শরীরের অঙ্গবাচক শব্দটি ব্যবহার করছেন, এটা বলে আপনারা কি কিছু আরাম পাচ্ছেন? বাড়িতেও কি আপনারা এই একই ভাষায় কথা বলেন?” ভেবেছিলাম, ওঁরা হয়তো রুখে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোককে বাছাই কোনও বিশেষ্য বা বিশেষণে আপ্যায়িত করবেন। কিন্তু ভাগ্য ভাল বলতে হবে, যুবকেরা পরস্পর মুখ-চাওয়াচাওয়ি করে বিনা বাক্যব্যয়ে সরে পড়লেন।
কয়েক দিন আগেই লোকাল ট্রেনে অনুরূপ এক ঘটনার মুখোমুখি পড়তে হয়েছিল। ভিড় ট্রেনে জনাকয়েক নিত্যযাত্রী পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ আলোচনার সময় কদর্যতর শব্দের ফোয়ারা ছোটাচ্ছিলেন। আলোচনার বিষয় রাজনীতি, জনৈকা নেত্রী সম্পর্কে ক্রমাগত নানা অশ্লীল মন্তব্য করে যাচ্ছিলেন তাঁরা। মহিলা যাত্রীরা লজ্জায় না শোনার ভান করে অন্য দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে বাধ্য হচ্ছিলেন। এক বয়স্ক ভদ্রলোক বিনীত ভাবে শুধু বলেছিলেন, ওঁকে আপনাদের পছন্দ না-ই হতে পারে, কিন্তু এক জন মহিলা সম্পর্কে জনপরিসরে এ ধরনের কথাবার্তা কি বলা উচিত? ব্যস, আর যায় কোথায়! নিত্যযাত্রীরা সমবেত ভাবে ভদ্রলোককে উচ্চারণের অযোগ্য ভাষায় এমন আক্রমণ শুরু করলেন যে, একটু পরেই তিনি ভিড় ঠেলে স্থানত্যাগে বাধ্য হলেন। অথচ মজার ব্যাপার, ভরা কামরায় একটি মানুষও ভদ্রলোকের সমর্থনে একটা কথাও বললেন না।
শুধু বাজারঘাটে, বাসে, ট্রেনে বা খেলার মাঠেই যে এমন কথোপকথন আমরা আকছার শুনি তা নয়, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনেও পড়ুয়াদের একই ভাষায় কথা বলতে শোনাটা পরিচিত ঘটনা। আর রাজনীতির অঙ্গনে তো কুকথার ফুলঝুরি। ক’দিন আগে খোদ বিধানসভা চত্বরে বিরোধী দলনেতার নেতৃত্বে এক দল বিধায়ক টি-শার্টের সামনে ও পিছনে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর পদবিহীন নামের পাশে ‘চোর’ লিখে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন। আবার তার পাল্টা রাজ্যের শাসক দলের সমর্থকদেরও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নামের পাশে ‘চোর’ লেখা টি-শার্ট পরে রাস্তায় নেমে পড়তে দেখা গেল। অথচ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বা দেশের প্রধানমন্ত্রী যে চোর, এমন প্রমাণ আজও কেউ দিতে পারেনি।
কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনে সলমন খানের নাচের সঙ্গে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর পা মেলানো প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিংহের মন্তব্যের ‘ঠুমকা’ শব্দটি নিয়ে যথেষ্ট আলোড়ন উঠেছে। একমাত্র কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ছাড়া এ রাজ্যের প্রতিটি রাজনৈতিক দল এর প্রতিবাদ করেছে। কিছু দিন আগে ভারতের মাননীয়া রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে মন্ত্রী অখিল গিরির করা এক কুমন্তব্যের জন্যে ক্ষমা চেয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং। বাম আমলে তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে বলা অশালীন মন্তব্য নিয়ে আজও রাজনৈতিক মহলে যথেষ্ট চর্চা হয়, যেমন চর্চা হয় পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ডে জনৈকা সাংসদের মন্তব্য ঘিরে। তিনি বলেছিলেন, ঘটনাটা নিছকই ক্লায়েন্টের সঙ্গে লেনদেনজনিত বিরোধপ্রসূত।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের বলা কুকথার তালিকা অনিঃশেষ। তবে অশালীন আক্রমণ-প্রতিআক্রমণের এই ধারা বা লক্ষ্য শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যেই সীমিত, এমনটা নয়। কিছু দিন আগে গভীর রাতে নিষিদ্ধ শব্দবাজি ফাটানো বন্ধ করতে তৎপর পুলিশের বিরুদ্ধে জনৈক বিধায়কের হুঙ্কার, কিংবা বীরভূমের জনৈক নেতার পুলিশকে বোমা মারার নিদান-সহ সরকারি কর্মী-আধিকারিক থেকে, অধ্যাপক থেকে কলেজের মেধাবী ছাত্রী পর্যন্ত বহু মানুষকেই কুকথা বা হেনস্থার শিকার হতে দেখা গেছে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, এঁরা এ সব খারাপ কথা বলেন কেন? কেউ কেউ বলেন, ক্ষমতা জাহিরের অন্যতম হাতিয়ার হল কুকথা। অনুগামীদের প্রবুদ্ধ করতে নাকি কুকথা খুবই কার্যকর। উদাহরণ হিসাবে তাঁরা প্রয়াত এক অভিনেতা-সাংসদের ‘ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে’ কার্যসিদ্ধির হুমকি দেওয়ার সময় উপস্থিত জনতার করতালিমুখর অভিনন্দনের উল্লেখ করেন। সম্প্রতি বহিষ্কৃত লোকসভার এক সাংসদ একদা সাংবাদিকদের ‘দু’পয়সার সাংবাদিক’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। তার পর তাঁর দলের নীরবতা যেন কুকথাকেই সমর্থন করে। অনেকের মতে, অশ্লীল শব্দোচ্চারণ হল ক্রোধ বা হতাশার বহিঃপ্রকাশ। তা যদি সত্যি হয়, তবে ক্রোধ বা হতাশা একান্তই ব্যক্তিগত বিষয় এবং এগুলি থেকে উত্তরণের অনুশীলনই যথার্থ শিক্ষার অনুষঙ্গ। সর্বসমক্ষে অশ্লীল শব্দোচ্চারণে অন্তরের কদর্যতা প্রকাশ সামাজিক অপরাধের শামিল।
মহানায়ক উত্তমকুমার অভিনীত সর্বশেষ ছায়াছবিতে একটা গান ছিল, ‘শুধু তুমি নও অবলাকান্ত, অনেকেরই বলার সময় খেয়াল থাকে না’। তবুও মনে রাখতে হবে, কুকথা কখনও বীরত্বের দ্যোতক হতে পারে না, তা ভাষা-সন্ত্রাসের শামিল। রাগ বা হতাশা, বিদ্বেষ বা ভালবাসা, মনে যা-ই থাক না কেন, ভাল ভাষায় তা প্রকাশ করার কথা প্রত্যেকেরই কি খেয়াল রাখা উচিত নয়?