‘গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড’ নিয়ে উত্তেজনাই ত্রিপুরার নির্বাচনের কেন্দ্রে
Tripura

নতুন রাজনীতির দৌড়

তিপ্রা মথার সাফল্যের প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় ২০২১ সালের এপ্রিলে, ত্রিপুরা ট্রাইবাল এরিয়াস অটোনমাস ডিসট্রিক্ট কাউন্সিল (এডিসি) নির্বাচনে।

Advertisement

অনিন্দিতা ঘোষাল

শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২২ ০৪:৪৯
Share:

অশান্ত: রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষোভের সঙ্গে তিপ্রাল্যান্ডের দাবি নিয়ে সংঘর্ষ পরিস্থিতি, আগরতলা, ২০১৬ ফাইল চিত্র।

২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ছোট রাজ্য ত্রিপুরার জন্য এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় হতে চলেছে। ত্রিপুরায় এ বারের নির্বাচন অনেক কারণে গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতার ৭৫ বছরে ত্রিপুরায় এই প্রথম কোনও সর্বভারতীয় বা জাতীয় রাজনৈতিক দলের পরিবর্তে এক অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক দলের গদি দখলের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বছর দুয়েক আগে এক নতুন স্বপ্ন দেখানোকে হাতিয়ার করে, তার উপযোগী ছকে রাজনীতির ঘুঁটি সাজিয়ে, ত্রিপুরায় আমূল পরিবর্তনের জোরালো ‘হাওয়া’ তৈরির প্রয়াসী হন রাজপরিবারের বংশধর ও আদিবাসী/জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের বুবাগ্রা (রাজা) প্রদ্যোত বিক্রম মাণিক্য দেব বর্মন। মাত্র দেড় বছর আগে তিপ্রা ইন্ডিজেনাস প্রোগ্রেসিভ রিজিয়নাল অ্যালায়েন্স বা তিপ্রা মথা নামে এক দল তৈরি করে, ত্রিপুরার ভূমিপুত্রদের দাবিদাওয়াকে লগ্নি করে ‘মাঠে’ নেমে পড়েন।

Advertisement

তিপ্রা মথার সাফল্যের প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় ২০২১ সালের এপ্রিলে, ত্রিপুরা ট্রাইবাল এরিয়াস অটোনমাস ডিসট্রিক্ট কাউন্সিল (এডিসি) নির্বাচনে। বিভিন্ন আদিবাসী বা জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে তৈরি তিপ্রা মথা এডিসি ১৮টি আসনে জয়লাভ করে। বাকি ৯টি আসন মিলিত ভাবে বিজেপি এবং তাদের জোট সঙ্গী ইন্ডিজেনাস পিপলস ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা বা আইপিএফটি (আর একটি জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে তৈরি দল) জয়ী হয়। পাহাড়ি অঞ্চলে ব্যাপক রিগিং, হিংসার ঘটনা, আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি, শাসকশ্রেণির ক্ষমতার অপপ্রয়োগ ইত্যাদির পরও এডিসি নির্বাচনে তিপ্রা মথার এই অত্যাশ্চর্য উত্থান ত্রিপুরার ভোটের রাজনীতির হিসেবকে প্রথম পাল্টে দেয়। তিপ্রা মথার জনভিত্তির আর একটি জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেছে গত ১২ নভেম্বর। এদের আয়োজনে সাংবিধানিক সুরক্ষার মাধ্যমে ‘গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড’-এর দাবিতে রাজধানী আগরতলায় এক বিরাট র‌্যালিতে যোগ দেন অন্তত ১০ হাজার বিভিন্ন জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ। সমসাময়িক কালে কোনও সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল, এমনকি বর্তমান শাসক দল বিজেপিও এমন রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করে উঠতে পারেনি।

তাই ২০২৩ সালের ভোটের আগে ত্রিপুরার রাজ্য-রাজনীতি সরগরম। কংগ্রেস, সিপিআইএম-এর মতো জাতীয় দল, যারা ত্রিপুরার পুরনো শাসক দলও বটে, তারা রাজনৈতিক ভাবে কৌশলের পন্থা ঠিক করছে, ত্রিপুরার বাইরে গোপন মিটিং করছে নির্বাচন পূর্ববর্তী বা পরবর্তী জোটের সম্ভাবনা নিয়ে। তিপ্রা মথা ইতিমধ্যেই শাসক দল বিজেপির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী— দু’বছর আগে যেখানে এই আঞ্চলিক দলের কোনও অস্তিত্বই ছিল না।

Advertisement

২০১৮ সালের মার্চ মাসে বিজেপি ত্রিপুরায় ক্ষমতায় এসেছিল, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অধিকাংশ রাজ্যের মতো এখানেও জনজাতি সম্প্রদায়ের সংগঠন আইপিএফটি-র সঙ্গে জোট বেঁধে। তখনও আদিবাসীদের সত্তাপরিচিতিভিত্তিক রাজনীতি দিয়ে তাদের মধ্যে ‘তিপ্রাল্যান্ড’ নামের এক ‘সোনার পাথরবাটি’ স্বপ্নভূমির ধারণা তৈরি করা হয়েছিল। ত্রিপুরীদের জন্য স্বাধীন এই রাজ্যে নিয়মিত রেশন, পাহাড়ি এলাকায় টিউবওয়েলের মাধ্যমে পানীয় জলের সরবরাহ ছাড়াও, টাইম কলের জল, ওষুধ, পঞ্চায়েতের সব সুবিধে পাওয়া যাবে, শোনা গিয়েছিল। বাস্তবে এই সাড়ে চার বছরে অবস্থা আসলে বিপরীত হয়েছে। পাহাড়-সহ গোটা রাজ্যে এক নৈরাজ্যের সময় চলেছে। নব্বই শতাংশের বেশি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত করতে পারেনি সরকার। ত্রিপুরার অগ্রগতির স্বাভাবিক গতি শ্লথ হয়েছে। আক্রমণ ও প্রতি-আক্রমণের বহুমুখী অভিমুখের কারণে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বিজেপির পোষা তথাকথিত বাইকবাহিনী (মতান্তরে হামলাবাহিনী) সদস্যদের রোজ হিসেবে নাকি ১০০০ টাকা দেওয়া হয়েছে, প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড বন্ধ করা ও অশান্তি তৈরির জন্য।

এই পরিস্থিতিতে মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্যের প্রপৌত্র প্রদ্যোত দেব বর্মন আদিবাসী/ জনজাতি সম্প্রদায়ের যুব সমাজের কাছে ‘মসিহা’ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। তাঁর বুবাগ্রা (রাজা) হয়ে ওঠার পিছনে যদিও কারণ অনেক, কিন্তু তাঁর ইউএসপি আসলে দুটো। এক, তিনি প্রথম থেকে বলে এসেছেন যে, তাঁর আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হল ত্রিপুরার আদিবাসী/ জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষদের সাংবিধানিক উপায়ে ‘গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড’ বা নিজেদের রাজ্যগঠন-সহ বাকি সব সুযোগ সুবিধে নিশ্চিত করা। দুই, তিনি এডিসি নির্বাচনে জিতে ঘোষণা করেছিলেন, যে রাজনৈতিক দল তাঁদের লিখিত ভাবে ‘গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ড’ তৈরির পক্ষে সমর্থন জানাবে, তাঁর পার্টি তার সঙ্গে জোট বাঁধতে আগ্রহী। এই বক্তব্য তিনি পাল্টাননি, পিছু হটেননি আদর্শগত জায়গা থেকে, এমনকি বিজয় রাংখলের মতো বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতাকেও জায়গা দিয়েছেন। আবার ‘পুইলা জাতি’র ধারণার কথা ফিরিয়ে এনে, ১৮৪ জন মাণিক্য মহারাজাদের হাজার বছর ত্রিপুরা শাসন স্মরণ করিয়ে, নিজেদের ‘ব্রু’ বলে সম্বোধন করে, ‘তিপ্রাসা’ বা ত্রিপুরার জনজাতি সম্প্রদায়ের ‘থানসা’ বা ঐক্য প্রতিষ্ঠার কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বিলক্ষণ জানেন, চাকমা বা রিয়াং-সহ অন্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে দেববর্মা সম্প্রদায়ের বিভেদের কথা।

এও জানেন, ত্রিপুরায় সব জনজাতি সম্প্রদায়ের আস্থা ও সমর্থন না পেলে শুধুমাত্র এডিসি অঞ্চলের অধিকাংশ আসনে জিতে তিনি বড়জোর ‘কিং-মেকার’ হতে পারেন, ‘কিং’ নয়। ডিজিটাল মিডিয়ায় অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ, মাথা ঠান্ডা, ইংরেজি এবং হিন্দি ভাষায় সুবাগ্মী প্রদ্যোত এখন ঘোষণা করছেন যে, ত্রিপুরার বিধানসভার মোট ৬০টি আসনের মধ্যে তিপ্রা মথা অন্তত ৩৫ থেকে ৪০টা আসনে প্রার্থী দেবে। কয়েক দিন আগের উপনির্বাচনে সুর্মা বিধানসভা কেন্দ্রে অ-জনজাতি আসনে এক জন হিন্দুস্থানি প্রার্থী দাঁড় করিয়ে তিপ্রা মথা দ্বিতীয় বৃহত্তম সংখ্যক ভোট পেয়েছে। তিনি আগরতলা এয়ারপোর্টে ককবরক ভাষায় ঘোষণার ব্যবস্থা করা হয়, তার তদ্বির করছেন। অন্য দিকে, ১০৩২৩ জন চাকরি খোয়ানো সরকারি কর্মচারীদের হৃত চাকরির পুনরুদ্ধারের জন্য মামলা লড়ছেন সুপ্রিম কোর্টে। সত্তা-রাজনীতির দুই দিক নিয়েই তিনি সচেতন। এখন তিনি হিন্দিতে বক্তৃতা দেন, মাঝেমধ্যে কিছু ককবরক শব্দ বলেন, ইচ্ছে করে বাংলা বলেন না। তিপ্রা মথার ‘নন-ট্রাইবাল ফ্রন্ট’ নামে এক নতুন শাখা খুলেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপির যে মূল অস্ত্র বা অভিযোগ— তিপ্রা মথা শুধুমাত্র জনজাতিদের সুরক্ষা নিশ্চিতকারী দল নয় তা প্রমাণের জন্য।

প্রদ্যোত দেব বর্মন ও তিপ্রা মথার এই উত্থানের সময়ে, শাসক দল বিজেপি, তাদের জোট সাথি আইপিএফটি, কংগ্রেস বা সিপিআইএম কী করছে? বিজেপির ঘোষণা, ২০২৩ সালের নির্বাচনে তাদের জোটসঙ্গী হিসেবে আইপিএফটি থাকবে। কিন্তু তাতে সমস্যা দু’টি। এক নম্বর সমস্যা, মুখ্যমন্ত্রী পরিবর্তন। বিপ্লব দেব যতই বোকার মতো মন্তব্য করুন, পাহাড় ও সমতলে বহু বছর আরএসএস-এর ক্যাডার হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁর ঝুলিতে ছিল। নতুন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা সেখানে অনেকটাই জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন। দুই, শাসক দল বিজেপির জোটসঙ্গী আইপিএফটির মোট অাট এমএলএ-র মধ্যে তিন জন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এর মধ্যেই যোগদান করেছেন তিপ্রা মথায়। ত্রিপুরা কংগ্রেসে মূল কান্ডারি হয়ে উঠেছেন সুদীপ রায় বর্মন। এ দিকে বিজেপি থেকে বেরিয়ে আসার ফলে, দলে তাঁর প্রশ্নাতীত বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। আবার এও ঠিক, পাহাড়ে ভোটের রাজনীতিতে যেখানে টার্নিং পয়েন্ট তৈরি করেছে তিপ্রা মথা, সমতলে সেই একই কাজ শুরু করেছে সুদীপ বর্মনের ব্যক্তিগত ক্যারিশমা। শেষ উপনির্বাচনে তিনি প্রমাণ করেছেন বিজেপিকে হারানো সম্ভব। কংগ্রেসের ‘যোগদান মেলা’য় তিনিই আসল মুখ। বিজেপি থেকে অনেকে বেরিয়ে এসে তাঁর ভরসায় কংগ্রেসে যোগ দিচ্ছেন।

সমীক্ষা বলছে, রাজ্যে সিপিআইএম-এর অবস্থা এখন বেশ ভাল। ট্রাইবাল এডিসিগুলোর পাঁচটা আসন, যেগুলো চাকমা আর রিয়াং অধ্যুষিত এলাকায়, তাতে সিপিএম-এর জনপ্রিয়তা বেশি। তিপ্রা মথাকে অনেকে আড়ালে ‘লাল মথা’ বলে, পাহাড়ে জনজাতিদের মধ্যে সিপিআইএম বহু দশক ধরে গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তার কারণে। কিন্তু মানিক সরকারের বদলে এ বারে সিপিআইএম ভোটের ময়দানে নামবে জিতেন্দ্র চৌধুরীর নেতৃত্বে।

সব মিলিয়ে স্বাধীনতার পর এই প্রথম ত্রিপুরাতে হাং অ্যাসেম্বলি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, যেখানে কোনও দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। কিন্তু ভোটের আগে সম্ভবত জোটের কথা ঘোষণা করবে না কেউই, তাঁদের নিজস্ব ভোট ব্যাঙ্কের স্বার্থে। লক্ষণীয়, কংগ্রেস আর সিপিআইএম কিন্তু তিপ্রা মথা বা তিপ্রাল্যান্ড আন্দোলন নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করছে না। এ বার বিজয়ার সময় সিপিআইএম-এর জিতেন্দ্র চৌধুরী এবং কংগ্রেসের সুদীপ রায় বর্মন, দু’জনেই গিয়েছিলেন প্রদ্যোত দেব বর্মনের বাড়িতে। সুদীপ বর্মন বলেেছন, তিপ্রা মথা তিপ্রাল্যান্ড তৈরির সাংবিধানিক অধিকার চাইতেই পারে।

পাহাড়ে এখন রাজাকে নিয়ে কাল্ট ইমেজ তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে। নতুন করে রাজভক্তি ফিরে এসেছে তাদের মধ্যে, যারা আসলে রাজাকে কোনও দিন দেখেনি। ত্রিপুরা সব মিলিয়ে ভাসমান অবস্থায় আছে। ভেসে ভেসে সে কোন তীরে উঠবে, দেখা যাক।

ইতিহাস বিভাগ, ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement