—প্রতীকী ছবি।
১৯৮৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল অঞ্জন চৌধুরীর ছবি ছোট বউ। অত্যাচারী শাশুড়ি বনাম সংসারের ছোট বউয়ের বাগ্যুদ্ধ ও রাজনীতি এ ছবির উপজীব্য। আজও সমাজমাধ্যমে ছবির সে-সব দৃশ্য প্রবল জনপ্রিয়। দর্শক মজা করে দেখেন। হেসে ওঠেন। ছবিটি দেখায় যে, শাশুড়ি যতই অত্যাচারী হোন, তিনি যখন অশক্ত, অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন তাঁর শুশ্রূষার সমস্ত ভার নিজের হাতে তুলে নেয় ওই ছোট বউই। কারণ তখন ওই বৃদ্ধা অসহায় এক মানুষ। তাঁর পাশে দাঁড়াতে হবেই। ছোট বউ ছবির ত্রিশ বছর পর মুক্তি পায় আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তর জোনাকি (২০১৮)। প্রথম থেকেই আমরা দেখি এক জন অশীতিপর মহিলা— যাঁর কেউ নেই— তিনি খানিক ‘কোমাটোস’ অবস্থায়। জীবনের বিগত, রঙিন সময়গুলো তিনি যেন কল্পনার ঘোরের মধ্যে দেখতে পান। স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান।
এই বৃদ্ধার চরিত্রের অসহায় অবস্থাটি দেখলে আমাদের অস্থির লাগে। দম বন্ধ হয়ে আসে। ত্রিশ বছরের ব্যবধানে বাঙালি জীবনে কত বদল! যৌথ পরিবার ভেঙে একক সংসার, কিন্তু পাশে পাওয়ার মতো কেউ নেই। আর এই ব্যবস্থার শিকার হয়ে চলেছেন সমাজের বয়স্ক মানুষেরা। সম্প্রতি খবরে প্রকাশ পেয়েছে, এই কলকাতার বুকে অসুস্থ এক বৃদ্ধাকে তাঁরই আয়া মারতে মারতে খুন করে ফেলেছে। বৃদ্ধা নাকি রাতের বেলা কখনও ওই আয়াকে (যে কিনা বৃদ্ধাকে রাতেই দেখাশোনা করার জন্য নিয়োজিত) ডাকতেন এবং তাতে আয়ার নাকি ঘুমের ব্যাঘাত হত! সে-কারণেই শয্যাশায়ী বৃদ্ধাকে মহিলা বেধড়ক মারধর করত। কয়েক বছর আগে বৃদ্ধার স্বামী মারা গিয়েছেন। একাকী, পরিজনহীন সেই অসহায় বৃদ্ধা খুন হওয়ার আগে না জানি কত না মার খেয়েছেন পরিচর্যাকর্মীর হাতে! অথচ সে কথা বলার একটা লোক ছিল না পাশে। খুনি গ্রেফতার হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা অপরাধীগুলোকে নিরস্ত করবে কে?
আমরা বয়স্ক মানুষদের কাজ থেকে অবসরে সরানোর অছিলায় ঠেলে দিতে চাই জীবন থেকে দূরে। সমাজের যে-কোনও আনন্দোৎসবেই তাঁদের উপস্থিতি সামান্য, অথবা নেই। বকুনি, অপমান, হাতে টাকাপয়সা না দেওয়া, মানসিক অত্যাচার, এমনকি মারধর পর্যন্ত তাঁদের ভবিতব্য হয়ে ওঠে। তবে এর মূল প্রোথিত সুদূর অতীতে। ভারতীয় হিন্দু শাস্ত্রে ‘বানপ্রস্থ’-র কথা বলা আছে। অর্থাৎ একটা বয়সের পর সংসার থেকে অব্যাহতি নিতে হবে, আর তার পর ‘সন্ন্যাস’। সংসারের সব মজামশকরা কেবল যুবক-যুবতীদের জন্য, এই কুসংস্কারটি আমাদের মধ্যে এখনও বাসা বেঁধে আছে। আমরা মনে করি, বয়স বাড়লে জীবনে আগ্রহ কমে যাবে, এটাই স্বাভাবিক।
এই ‘বয়সবাদ’-এর (এজিজ়ম)— বয়স্কদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব কেবল তাঁরা বয়স্ক বলেই— অন্যায় রূপ সম্পর্কে ভারতে এখনও যথেষ্ট সচেতনতা আসেনি। সমাজের মতো কর্মক্ষেত্রেও ধরে নেওয়া হয়, এক জনের বয়স বেশি মানেই তাঁর কর্মক্ষমতা নিম্নমুখী হতে বাধ্য। ‘আপনার তো বয়স হচ্ছে, আর বেশি দৌড়ঝাঁপ না করাই ভাল’ জাতীয় নিদানগুলি দিয়ে একটা বিরাটসংখ্যক মানুষকে আমরা প্রত্যহ অসম্মান আর নিঃসঙ্গতার মুখে ঠেলে দিই। বাড়িতে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়ে রাখাই হয়তো এখন পরিবারের বয়স্কদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও সাহচর্যের পরাকাষ্ঠা।
আর কিছু বছর পর ভারতে বৃদ্ধ মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় কুড়ি শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে। তাঁদের প্রতি আমরা কী ভাবে যত্নশীল হব, কোনও তরফ থেকে এ নিয়ে কোনও ভাবনাচিন্তার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন, মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে বয়স্ক মানুষদের যৌনজীবনের প্রতিও। যৌনতার যে কোনও শেষ সীমা বা বয়সের মাপকাঠি নেই যত ক্ষণ পর্যন্ত ‘সম্মতি’ আছে, সেটাকে ‘সাধারণ’ ব্যাপার করে তুলতে হবে। কত বয়স্ক মানুষ সঙ্গীহীন, প্রেমহীন, ভেবে দেখার সময় এসেছে।
আর একটা বিষয় মনে রাখতে হবে— এই বয়স্ক মানুষদের মধ্যে হেনস্থা-হিংসার শিকার হচ্ছেন মহিলারা বেশি। কারণ সামাজিক দিক থেকে তাঁরা এমনিতেই দুর্বল। তাঁদের প্রতি হিংসার প্রকাশ কেবল অসহিষ্ণুতা, অবমাননা, মারধরেই প্রকাশ হয়, এমন নয়। পুষ্টিকর খাদ্য না দেওয়া, যথাযথ চিকিৎসা না করানোও হিংসার প্রকাশ।
অন্য দিকে, বয়স্ক সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের তো আজ অবধি কোনও পরিসংখ্যানই তৈরি হল না এই দেশে! ‘বার্ধক্য ভাতা’ যে বিভিন্ন রাজ্যে চালু আছে তার সুবিধা বয়স্ক সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষেরা কি পাচ্ছেন? তাঁদের যেন ভবিতব্যই একাকী, সংসারহীন, বিবাহ-যৌথতাহীন, সন্তানহীন জীবন! এঁদের কথা কে চিন্তা করছে? অথচ এই আমরাই ‘বৃদ্ধাবাস’-এর ধারণাকে সমীহ করি না। বৃদ্ধাবাসগুলি যেন আমাদের সংসার ভেঙে যাওয়ার প্রতীক। যে মনোযোগ এক জন বয়স্ক মানুষের প্রাপ্য সেটা যদি সংসার দিতে না পারে, তা হলে অন্য ব্যবস্থায় ক্ষতি কী? অনেক সমবয়স্ক মানুষকে নিয়ে বৃদ্ধাবাস ও তার বাসিন্দাদের বরং সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে কী ভাবে কাছে টানা যায়, তার চেষ্টা করতে হবে। বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে যদি আমরা সম্পৃক্ত হতে না পারি, তবে যে দেশ গড়ে উঠবে তা বড় কুৎসিত। এক দিন তো আমাদের সকলেরই বয়স হবে!