—প্রতীকী ছবি।
গত ২৪ জুলাই আর একটু দেরি হলে আর একটি ছাত্রের মৃত্যু হতে পারত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। হয়নি, কারণ এ ক্ষেত্রে মেডিক্যাল অফিসার দ্রুত হস্তক্ষেপ করায় ছেলেটিকে হাসপাতালে আনা গিয়েছিল। মেডিক্যাল অফিসারের বক্তব্য অনুযায়ী, তিনি গিয়ে দেখেন ছেলেটি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। প্রচণ্ড ভয় পেলে, নার্ভাস হলে যেমন হয়। তাকে ঘিরে রেখেছে বেশ কিছু ছাত্র। ছেলেটিকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য বেরিয়ে যাওয়ার সময় অ্যাম্বুল্যান্সে তোলার মুহূর্তে ছাত্রদের একাংশ বাধা দেয়। বলা হয়, হাসপাতালে নিয়ে যেতে হলে তাদের কাছে সই করে নিয়ে যেতে হবে।
ভয়াবহ। আগের বছর ঠিক এই সময়,এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলেই, স্বপ্নদীপের রক্তাক্ত শরীর যখন মেঝেতে পড়ে আছে, দ্রুত হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে পুলিশ বা শিক্ষকদের হস্টেলে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। কোন ‘ন্যারেটিভ’ দুনিয়াকে বলা হবে, তা ঠিক করে দেওয়া হয় মিটিং করে। প্রমাণ লোপাটের জন্য রক্ত ধুয়ে ফেলা হয়, ভুয়ো ডায়েরি লেখা হয়, যাতে তদন্ত দিগ্ভ্রান্ত হতে পারে। শেষে যখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিল, তখন ট্যাক্সি আটকানো হয়। সেই ঘটনার সন্তোযজনক বিচার আজও হল না। অতি সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান্টি র্যাগিং কমিটি তদন্ত করে শাস্তির বিধান দিলেও কিছু প্রশ্ন থেকেই গেল। এত দিন ধরে শাস্তির বিষয়ে এত রকম টালবাহানা চলল কেন? কেন কর্তৃপক্ষ সবেমাত্র শো-কজ়ের কাজটি শুরু করলেন? এত দিনে যদি শাস্তি সুনিশ্চিত করা যেত, পাঠ্যক্রমে ‘র্যাগিং’কে অন্তর্ভুক্ত করা হত, র্যাগিং-বিরোধী সেল-কে যথাযথ ভাবে সক্রিয় করা যেত, এবং অভিযুক্তদের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হত— হয়তো এক বছর পর আজকের এই দিনটি দেখতে হত না।
এ বারের ঘটনাটিকেই ধরা যাক। কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি ল্যাপটপ চুরির অভিযোগ ওঠে, তবে সাধারণ ভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সে বিষয়ে লিখিত অভিযোগ জানানোই নিয়ম। যাদবপুরে উপাচার্য আছেন, থানা আছে। অথচ, সেখানে কোনও অভিযোগ না জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সালিশি সভা বসানো হচ্ছে, খাপ পঞ্চায়েত চলছে। ক’দিন আগে অনেকটা এ ভাবেই বৌবাজারে মোবাইল চোর সন্দেহে এক যুবককে পিটিয়ে খুন করা হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের যে গোষ্ঠীটি এই অভিযোগে বার বার অভিযুক্ত হচ্ছে, তারা দু’টি ঢাল ব্যবহার করছে। একটি বিবৃতি হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যেখানে ছেলেটির বাবা বলছেন, পড়ুয়াদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি হয়। ছেলে এখন সুস্থ, তাকে এক আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে আসা হয়েছে। এই বিবৃতির ধরনটি সংশয় জাগাতে পারে। কেননা, জানা আছে যে এই দেশে বেশির ভাগ বৈবাহিক ধর্ষণ, যৌন হেনস্থা থানায় লিপিবদ্ধ হয় না ভয়ে ও সামাজিক সম্মানহানির গ্লানিতে, অপর পক্ষের বাহুবল দেখে। সুতরাং, এই শহরে তথাকথিত ‘কানেকশন’ না-থাকা বাবার মুখে ছেলের এত বড় সঙ্কটের পরও এই বিবৃতি অস্বাভাবিক ঠেকলে দোষ দেওয়া যায় না। ভুল বোঝাবুঝিও যদি হয়, কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বন্ধুরাই সবার আগে হাসপাতালে ভর্তি করতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অসুস্থ ছাত্রকে উদ্ধার করতে আসা অন-ডিউটি মেডিক্যাল অফিসারকে বাধা দেওয়া হল কেন, অ্যাম্বুল্যান্স আটকে রাখা হল কেন?
দু’নম্বর ঢালটি— যাদবপুর মেন হস্টেল। র্যাগিং-বিরোধী কোনও প্রচারপত্র ছাত্রছাত্রীরা বিলি করলে, র্যাগিং নিয়ে সচেতনতামূলক প্রচার করলে, মেন হস্টেলের ছাত্রদের নাকি বলা হচ্ছে— তাদের ‘র্যাগার’ হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ দিকে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে, যাদের নাম তদন্ত কমিটির রিপোর্টে আছে, কেবল তাদেরই শাস্তি হতে পারে। হস্টেলে তিন-চারশো ছেলে থাকে, তারা দূরদূরান্ত থেকে এসে পড়াশোনা করে, তাদের জন্যই সারা দেশে যাদবপুর আজ চার নম্বরে। তাদের অযথা কেন কেউ ‘র্যাগার’ বলবে? আসল প্রশ্নটি অন্য— ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে’-র। অভিযুক্তদের কি কেউ বাঁচানোর চেষ্টা করছেন? শিক্ষার্থীদের কেউ? কর্তৃপক্ষের কেউ? প্রভাবশালী কেউ? তাঁরা কি এটা ভেবে দেখছেন না, নদিয়া থেকে যে সেই-যে সতেরো বছরের ছেলেটি পড়তে এসেছিল বাংলা বিভাগে, তাকে আর ফিরে পাবে না তার পরিজন— সেই নৃশংস ঘটনার যদি বিচার না হয়, তা হলে এই প্রবণতা ছড়িয়ে যাবে আরও শিকড়ে, জল-হাওয়া পাবে আরও অপরাধ?
সময় এসেছে সমাজের সকল স্তর থেকে একটি নৈতিক আহ্বান ওঠার, কেবল আইন নয়, র্যাগিং-এর বিচার চাই। সাধারণ পড়ুয়াদেরই দায়িত্ব, কোনও ভাবেই সেই নির্দিষ্ট অপরাধমনস্ক গোষ্ঠীটির সঙ্গে জড়িয়ে না পড়া। শুধুমাত্র যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেগুলি কলকাতার আলোকবৃত্তের বাইরে জেলা-মফস্সলগুলিতে ছড়িয়ে আছে, যে সব প্রাঙ্গণে অনেক অপরাধই সংবাদমাধ্যমের পাতায় জায়গা পায় না, তাদের প্রত্যেকটি ঘটনার বিচার চাই।
রবি ঠাকুরের ‘ন্যায়দণ্ড’ কবিতাটি আমরা পাঠ করতাম। মনে পড়ে যায় এ সব দেখে।