বুধবার সংশোধিত ওয়াকফ বিল পেশ হতে চলেছে লোকসভায়। —ফাইল চিত্র।
লোকসভায় ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল, ২০২৫ পেশ করতে চলেছে সরকার। বুধবার বেলা ১২টায় বিলটি লোকসভায় পেশ হওয়ার কথা। রাজ্যসভায় এটি পেশ হতে পারে বৃহস্পতিবার। লোকসভায় দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনার পরে বিলটি ভোটাভুটির মাধ্যমে পাশ করাতে চাইছে কেন্দ্রের এনডিএ সরকার। আপাত ভাবে লোকসভা এবং রাজ্যসভার অঙ্ক বলছে, বিলটি পাশ করাতে বিশেষ কসরত করতে হবে না বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ-কে। তবে জোটের বড় শরিক বিজেপি এ ক্ষেত্রে শরিক দলগুলি, বিশেষত নীতীশ কুমারের জেডিইউ এবং চন্দ্রবাবু নায়ডুর টিডিপির উপর অনেকটাই নির্ভর করছে। অন্য দিকে, এই বিলের বিরুদ্ধে এককাট্টা বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’ও।
সংশোধিত ওয়াকফ বিল নিয়ে নীতীশ এবং চন্দ্রবাবু কী অবস্থান নেন, তা নিয়ে গোড়ায় ধন্দে ছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। কয়েক মাস পরেই বিহারে বিধানসভা নির্বাচন। সে রাজ্যের ১৭ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটকে নিজের অনুকূলে রাখতে নীতীশ বিলের বিরোধিতা করবেন কি না, তা নিয়ে আশঙ্কা ছিল শাসক শিবিরে। শেষমেশ জেডিইউ অবশ্য জানিয়ে দিয়েছে, তারা এই বিলকে সমর্থন করছে। দলের এক শীর্ষনেতা বলেন, “আমাদের দল ইতিমধ্যে মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড, ওয়াকফ বোর্ড এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। তাঁদের ভাবনার কথা সরকারকে জানানো হয়েছে। সরকার বিষয়টি দেখছে।”
অন্ধ্রে অবশ্য আগামী চার বছর কোনও বড় নির্বাচন নেই। তাই চন্দ্রবাবু সংখ্যালঘু ভোটে ফাটল ধরাতে না-চাইলেও জোট ধর্মের স্বার্থে বিলকে সমর্থন করবেন— এই বিষয়ে প্রত্যয়ী ছিল বিজেপি। মঙ্গলবার টিডিপি মুখপাত্র প্রেমকুমার জৈন বলেন, “আমাদের দল (বিলটি) সমর্থন করবে। চন্দ্রবাবু নায়ডু আগেই জানিয়েছেন যে, আমরা মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থে কাজ করব।” একনাথ শিন্দের নেতৃত্বাধীন শিবসেনা তিন লাইনের হুইপ (নির্দেশিকা) জারি করে লোকসভায় দলীয় সাংসদদের বিলটির সমর্থনে ভোট দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। একই ভাবে বিলের পক্ষে থাকার জন্য সাংসদদের তিন লাইনের নির্দেশ দিয়েছে এনডিএ-র আর এক শরিক দল চিরাগ পাসওয়ানের এলজেপি (রামবিলাস)।
বিলের বিরুদ্ধে বিরোধীদের রণকৌশল নির্ধারণ করতে মঙ্গলবার বৈঠকে বসেন লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী, দলের সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে, এসপি নেতা রামগোপাল যাদব, তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, এনসিপি (এসপি) সাংসদ সুপ্রিয়া সুলে প্রমুখ। বৈঠকে ছিলেন ডিএমকে, সিপিএম, সিপিআই, আরএসপি, আপের প্রতিনিধিরাও। বৈঠকের পর সমাজমাধ্যমে খড়্গে লেখেন, “ওয়াকফ সংশোধনী বিল নিয়ে মোদী সরকারের অসাংবিধানিক এবং বিভেদকামী নীতির বিরুদ্ধে সব বিরোধী দল ঐক্যবদ্ধ রয়েছে।”
লোকসভায় বিলটি পাশ করাতে ২৭২ জন সাংসদের সমর্থন প্রয়োজন। বিজেপির সাংসদ সংখ্যা ২৪০, জেডিইউ-এর ১২ আর টিডিপির ১৬। এ ছাড়াও লোকসভায় চিরাগের দলের পাঁচ জন এবং শিন্দেসেনার সাত জন সাংসদ রয়েছেন। শরিকদের সমর্থন নিশ্চিত হওয়ায় অনায়াসেই বিলটি লোকসভায় পাশ করাতে পারবে এনডিএ শিবির।
রাজ্যসভায় এনডিএ-র ১২৫ জন সাংসদ রয়েছেন। ছ’টি আসন শূন্য রয়েছে। ফলে ১১৮ জন সাংসদের সমর্থন পেলেই সংসদের উচ্চ কক্ষে বিলটি পাশ করাতে পারবে শাসক জোট। রাজ্যসভায় বিজেপির ৯৮ জন, জেডিইউ-এর চার জন, অজিত পওয়ারের এনসিপির তিন জন এবং টিডিপির দু’জন সাংসদ রয়েছেন। বিজেপির আশা, অসম গণ পরিষদ এবং তামিল মানিলা কংগ্রেসের এক জন সাংসদের সমর্থন তারা পাবে। একই ভাবে মনোনীত ছ’জন সদস্যও বিলের পক্ষে ভোট দেবেন বলে আশা পদ্মশিবিরের।
প্রসঙ্গত, বর্তমান ওয়াকফ আইনের ৪০ নম্বর ধারা অনুযায়ী, যে কোনও সম্পত্তিকে ওয়াকফ হিসাবে ঘোষণার অধিকার রয়েছে ওয়াকফ বোর্ডের হাতেই। নতুন সংশোধনীতে ওয়াকফ বোর্ডের সেই একচ্ছত্র অধিকার কেড়ে নিয়ে কোনও সম্পত্তি ওয়াকফ কি না, সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হবে জেলাশাসক বা সম পদমর্যাদার কোনও আধিকারিকের হাতে। সরকারের যুক্তি, বর্তমানে যে আইন রয়েছে, তাতে ওয়াকফের দখল করা জমি বা সম্পত্তিতে কোনও ভাবেই পর্যালোচনা করার সুযোগ থাকে না। কারও আপত্তি সত্ত্বেও জমি বা সম্পত্তি দখল করতে পারে ওয়াকফ বোর্ড। তাতে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকে না সরকারের। নতুন বিলে তার বন্দোবস্ত রয়েছে।
বিরোধীদের প্রবল আপত্তি ও হট্টগোলের মধ্যে গত ৮ অগস্ট লোকসভায় ওয়াকফ সংশোধনী বিল পেশ করেছিলেন কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রী কিরেন রিজিজু। বিলটি ‘অসাংবিধানিক এবং মুসলিমদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপকারী’ বলে অভিযোগ তুলে বিরোধীরা একযোগে তা নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। কংগ্রেস, তৃণমূল-সহ বিরোধীদের অভিযোগ, ৪৪টি সংশোধনী এনে ওয়াকফ বোর্ডের উপর সরকারি কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করতে চাইছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। দীর্ঘ বিতর্কের শেষে ঐকমত্যের লক্ষ্যে বিলটি যৌথ সংসদীয় কমিটি বা জেপিসির কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কেন্দ্র।
বিজেপি সাংসদ জগদম্বিকা পালের নেতৃত্বাধীন ৩১ সদস্যের জেপিসি বিরোধীদের আপত্তি উপেক্ষা করেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে গত ৩০ ডিসেম্বর ১৪টি সংশোধনী-সহ বিলটি সংসদে পেশ করার জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করে জেপিসি। সরকার পক্ষের তরফে ২৩ এবং বিরোধীদের তরফে ৪৪টি সংশোধনী প্রস্তাব কমিটিতে জমা পড়েছিল। সরকার পক্ষের সাংসদদের আনা ১৪টি সংশোধনী গৃহীত হলেও বিরোধীদের সব ক’টি সংশোধনী প্রস্তাবই জেপিসিতে খারিজ হয়ে যায়।