ড্রোনের ক্যামেরা থেকে তোলা ছবির মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন শস্যখেতের সুনির্দিষ্ট সীমা, কোথায় আগাছা বেড়েছে বা কোথায় ফসলে ধরেছে পোকা। প্রতীকী ছবি।
এই সর্বগ্রাসী কম্পিউটার-কেন্দ্রিক প্রযুক্তির যুগে আমরা সবাই এবং আমাদের লেনদেনগুলো যখন এক-এক টুকরো তথ্য হয়ে জমা পড়ছে সরকারি তথ্যভান্ডারে, তখনও শীতের রাতে মানুষ খালি পেটে বিনা কম্বলে শুয়ে থাকছেন শহুরে ফুটপাতে। আর সুন্দরবনের প্রত্যন্ত কোনও জায়গাতে কোনও এক দিন খিচুড়ি বিতরণ হলে, সেই খবর পেয়ে তিনটি অপুষ্ট বাচ্চাকে টানতে টানতে পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে চলে আসছেন কিশোরী মা। বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্ট অনুযায়ী কোভিড-পরবর্তী পৃথিবীতে দারিদ্র এবং সম্পদের বিভাজনে প্রবল অসাম্য, দুই-ই বেড়েছে— বিভিন্ন রাষ্ট্রের তথ্য গোপন করার যাবতীয় চেষ্টা সত্ত্বেও। ২০২২ সালে প্রকাশিত রাষ্ট্রপুঞ্জের হিউম্যান ডেভলপমেন্ট রিপোর্ট বলছে, আন্তর্জাতিক বহুমাত্রিক দারিদ্রসূচক অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে ভারতে চূড়ান্ত দারিদ্রসীমার উপরে উঠে এসেছেন প্রায় ৪১ কোটি মানুষ। কিন্তু, সে রিপোর্টই দেখাচ্ছে, ২০২০-তে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গরিব মানুষের বাসভূমি ছিল ভারত। সংখ্যাটা প্রায় ২৩ কোটি।
তা হলে দুনিয়া কাঁপানো ইন্টারনেট অব থিংস এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম মেধার প্রয়োগ কি শুধু অবস্থাপন্নদের জীবনকে আরও সহজ করার জন্য? দিন-আনা-দিন-খাওয়া বা আদৌ না-খাওয়া মানুষগুলোর জীবনে রাষ্ট্রের অভিভাবকত্বকে অধিকারের মতো সংযুক্ত করায় এই ধরনের তথ্য-নির্ভর প্রযুক্তির প্রয়োগ ঠিক কেমন হতে পারে? বিশ্বের অন্য দেশগুলোতে ঠিক কী ভাবে প্রযুক্তি হয়ে উঠছে দারিদ্রের সঙ্গে লড়াইয়ের অন্যতম হাতিয়ার? ভারতের পরিস্থিতিই বা কেমন?
দারিদ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রথম ধাপ নিঃসন্দেহে এই চূড়ান্ত দারিদ্রের কারণ খোঁজা, এবং দেশের সবচেয়ে হতদরিদ্র জনবসতিগুলোকে চিহ্নিত করে একটা ডেমোগ্রাফিক ম্যাপিং করা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, গৃহযুদ্ধ, ঔপনিবেশিকতা, সরকারি সদিচ্ছার অভাব, এই রকম বহু কারণে অনেক দেশে দারিদ্র চিহ্নিত করার উপযোগী সমীক্ষা প্রকাশ করা হয় না, যেমন হয়নি আফ্রিকার অনেক রাষ্ট্রে। ২০১৬ সালে সায়েন্স-এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধে নিয়েল জিনের নেতৃত্বে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক দল বিজ্ঞানী দেখালেন, কী ভাবে এ ক্ষেত্রে পৃথিবীর আকাশে ভেসে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিগুলোকে কৃত্রিম মেধার সাহায্যে বিশ্লেষণ করে আফ্রিকার চূড়ান্ত দারিদ্রপীড়িত জনবসতিগুলোকে চিহ্নিত করা যায়।
এই কাজ প্রথম শুরু হয়েছিল কৃত্রিম উপগ্রহের তোলা রাত্রিকালীন ছবিগুলো নিয়ে। রাতের অন্ধকারে সচ্ছল পল্লিগুলোতে যখন উপচে পড়ে বিদ্যুতের আলো, তখন গরিব মানুষদের বসতি ডুবে থাকে অপেক্ষাকৃত ভাবে বেশি অন্ধকারে। অনেক উঁচু থেকে তোলা আফ্রিকার ভূখণ্ডের ছবিতে আলোক-ঘনত্বের এই অঞ্চলভিত্তিক ফারাকটাই ধরে ফেলতে পারে মানব স্নায়ুতন্ত্রের আদলে তৈরি ডিপ নিউরাল নেটওয়ার্ক, যা বর্তমানে কৃত্রিম মেধার এক সফলতম সংযোজন। পরবর্তী কালে স্ট্যানফোর্ডেরই অধ্যাপক মার্শাল বার্কে ও তাঁর সহযোগীরা রাতের তোলা ছবিগুলোর সঙ্গে দিনের আলোয় তোলা ছবিগুলিও ব্যবহার করে পদ্ধতিটিকে আরও উন্নত করে তুললেন। এর ফলে উপগ্রহচিত্র বিশ্লেষণ করে মেশিন লার্নিং মডেল অ্যাঙ্গোলা, ঘানা, রুয়ান্ডা, নাইজিরিয়া, বা তানজ়ানিয়া-র মতো বিস্তীর্ণ ভূভাগের কোথায় দারিদ্রের ছোবল সবচেয়ে মারাত্মক, কোথায় শিশুমৃত্যু ও অপুষ্টি ছাড়িয়েছে সমস্ত সহ্যসীমা, অবিলম্বে ত্রাণের দরকার কোন অঞ্চলে— এগুলো নির্দেশ করতে পারল সহজেই। সীমিত গৃহসমীক্ষার ফলের সঙ্গে কৃত্রিম মেধার ভবিষ্যদ্বাণী মিলে গেল প্রায় ৯৯%। বিশ্বব্যাঙ্ক, ইউনেস্কো এবং অন্যান্য অসরকারি সংস্থা ওই সব অঞ্চলে নিজেদের বিভিন্ন ত্রাণমূলক কর্মসূচিতে কতটা সফল সেটাও ক্রমে বুঝে নেওয়া যাচ্ছে এই উপগ্রহ থেকে তোলা ছবির বিশ্লেষণেই।
মিলেট জাতীয় শস্য যেমন সর্গ্যাম বা জোয়ার অনেক খরাপ্রবণ দেশের কৃষিব্যবস্থার মেরুদণ্ড। খাদ্য, পানীয় এবং জৈব জ্বালানির প্রধান উৎস। সর্গ্যাম-এর উৎপাদন বাড়াতে পারলে কৃষিনির্ভর সেই সব দেশের অর্থব্যবস্থাকে একটা ভাল অবলম্বন জোগানো যায়। আমেরিকার কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটির গবেষকরা ঠিক এই লক্ষ্যেই ফার্মভিউ নামের এক প্রকল্প শুরু করেছেন। প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য রোবোটিক্স এবং কৃত্রিম মেধার ব্যবহারের মাধ্যমে উদ্ভিজ্জের প্রজনন এবং ফসল ব্যবস্থাপনার আমূল উন্নতি। ফার্মভিউ প্রকল্পে যুক্ত বিজ্ঞানীদের আশা, এর ফলে আজ থেকে ২০ বছর পরে পৃথিবীর জনসংখ্যা যখন আনুমানিক ৯৬০ কোটি, তখন বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের জনবহুল দেশগুলোতে রোজ পেট ভরাবার রসদ জোগানো সম্ভব হবে।
প্রিসিশন এগ্রিকালচারের উদাহরণ দিই। ড্রোনের ক্যামেরা থেকে তোলা ছবি পূর্বার্জিত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে, কৃত্রিম মেধা চিহ্নিত করে ফেলে বিভিন্ন শস্যখেতের সুনির্দিষ্ট সীমা, কোথায় আগাছা বেড়েছে বা কোথায় ফসলে ধরেছে পোকা। সেই অনুপাতে, খুব দ্রুত অনেকটা জায়গা জুড়ে সুনির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে ড্রোনের সাহায্যেই কতটা কীটনাশক বা অন্যান্য ওষুধ ছড়িয়ে শস্যের সুস্থতা বজায় রাখা সম্ভব, সেটাও নির্ধারণ করতে পারে। পৃথিবী জুড়ে মানুষের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী হলেও, শহরমুখী সভ্যতার ধারায়, বিস্তীর্ণ কৃষিজমিতে ঘাম ঝরানোর মানুষ ক্রমেই কমছে সব দেশে। অতএব, কৃষিক্ষেত্রে যন্ত্রমেধা ও রোবোটিক্স-এর প্রয়োগে এই স্বয়ংক্রিয়করণ বেকারত্বের আয়োজন নয়, বরং এই সময়ের প্রয়োজন।
পৃথিবীর বহু দেশে কৃত্রিম মেধা পরিচালিত ড্রোনের পল্টন ব্যবহার করা হচ্ছে দুর্গত, প্রান্তিক মানুষকে বাঁচাতে। পাপুয়া নিউ গিনি এবং হাইতির প্রত্যন্ত অঞ্চলে আদিবাসীদের মধ্যে যক্ষ্মার মহামারি রুখতে ম্যাটার্নেট কোম্পানি যেমন ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস-এর মতো সংস্থার সাহায্যে গড়ে তুলেছে ড্রোনের মাধ্যমে রোগীদের নিয়মিত খুব কম সময়ের মধ্যে ওষুধ ও পথ্য পৌঁছে দেওয়ার এক রীতিমতো স্বতন্ত্র আকাশপথ।
আজকের দুনিয়ায় প্রায় ১৬০ কোটি মানুষ তাঁদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, জ্বালানি, এবং ওষুধের জন্য সরাসরি অরণ্যের উপরে নির্ভর করেন, অথচ তা সত্ত্বেও প্রতি বছর কাটা পড়ে প্রায় ১৫০০ কোটি গাছ। এই হারে অরণ্যধ্বংস বহু মানুষকে প্রতি বছর দারিদ্রের চরম সীমায় ঠেলে দিচ্ছে। এই জঙ্গল ফিরিয়ে আনতেও সহায়ক হতে পারে ড্রোন প্রযুক্তি। বায়োকার্বন এঞ্জিনিয়ারিং এই ভাবেই পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতায় সক্ষম ড্রোনের ছোট ছোট দল ব্যবহার করে আকাশ থেকে বীজ, সহায়ক অণুজীব ও ছত্রাক ছড়িয়ে দূষিত মাটির স্বাস্থ্য ফেরাতে উদ্যোগী হয়েছে। এই সংস্থা এক দিনে ড্রোনের সাহায্যে ৫০০০ গাছ পুঁতেছে কয়লা খননে বিপর্যস্ত অস্ট্রেলিয়ার ডানগগ অঞ্চলে। এ ছাড়াও, কৃত্রিম মেধার পরিচালনায় ড্রোনের দল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চোরাশিকারি ধরতে, বেআইনি গাছকাটা রুখতে, স্থানীয় ব্যবসার বিকাশে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আকাশপথে ত্রাণ সরাসরি দুর্গতদের হাতে পৌঁছে দিতে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বহু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিপুল মানবসম্পদ, এবং চূড়ান্ত দারিদ্র বাস্তবে থাকা সত্ত্বেও, ভারত এখনও সর্বাত্মক ভাবে এই লড়াইয়ে যোগ দেয়নি। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি তৈরি করেছে একটা গোটা গবেষণাগার, যার নাম ‘পভার্টি অ্যান্ড টেকনোলজি ল্যাব’। ভারতের নামজাদা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারি সাহায্যে এ রকম উদ্যোগ দেখা যায় কি? আশার কথা, অন্তত কিছু প্রতিষ্ঠানে, বিচ্ছিন্ন ভাবে হলেও, তথ্য-ভিত্তিক প্রযুক্তিকে খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োগ করা হচ্ছে সরাসরি গরিব মানুষের জীবনকে একটু সহজ করতে। যেমন ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং সেন্টার কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পাওয়া ছবি ও তথ্যের সাহায্যে প্রতি দিন ভারতের কয়েক লক্ষ মৎস্যজীবী মানুষকে সমুদ্রের কোন অঞ্চলে ভাল মাছ পাওয়া যাবে তা জানিয়ে দিচ্ছে, দিয়ে যাচ্ছে সামুদ্রিক ঝড়ের পূর্বাভাস।
কেন্দ্রীয় সরকার ২০২২-এর বাজেটে ড্রোন শক্তি প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছে, জোর দেওয়া হয়েছে কৃত্রিম মেধা ও তথ্য-ভিত্তিক গভর্ন্যান্সের উপরে, কৃষি ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এগুলির প্রয়োগের উপরে। কিন্তু এখনও অনেক পথ পেরোনো বাকি। সেই পথ দ্রুত পেরোতে গেলে প্রতি দিন শাসনযন্ত্রকে এবং নিজেদের প্রশ্ন করে যেতে হবে— কেন স্থানীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত হয়ে সরাসরি ড্রোন-বাহিত ত্রাণ পৌঁছবে না বন্যাদুর্গত সুন্দরবনে? কেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের শ্রমজীবী মেয়েরা মানুষ-ডাক্তার না হলেও, অন্তত কোনও টেলিমেডিসিন নেটওয়ার্কের চ্যাটবটকে নিজেদের শারীরিক সমস্যার কথা নিজেদের ভাষায় জানাতেন পারবেন না এবং উপযুক্ত ওষুধ পাবেন না?