প্রথম যে টাইপরাইটার তৈরি করেছিল রেমিংটন কোম্পানি, তার চেহারা ছিল সেলাই মেশিনের মতো। প্রতীকী ছবি।
টাইপরাইটার’ গল্পে তারাপদ রায় নিষিদ্ধপল্লির মেয়ে জলির কথা লিখেছিলেন— কী ভাবে তার হাতে পৌঁছে গেল একটা টাইপরাইটার, তার ঘরের বাইরে বাড়িওয়ালি মাসির আপত্তি সত্ত্বেও ‘টাইপিং ডান হিয়ার, এখানে টাইপ করা হয়’ লেখা ছোট সাইনবোর্ড ঝুলল। মেয়েদের জীবনে কত বিচিত্র পথেই না জড়িয়ে গিয়েছে এই যন্ত্রটি।
প্রথম বাণিজ্যিক টাইপরাইটার ব্যবহার হল ১৮৭৪ সালে। শুরুতে তা ছিল পুরুষদের এলাকা, ক্রমে যা হয়ে উঠল নারী-অধ্যুষিত। টাইপরাইটার আসার আগে ১৮৭০ সালে আমেরিকায় কেরানির কাজের মাত্র ২.৫ শতাংশ করতেন নারীরা, ১৯৩০ সালের মধ্যে সংখ্যাটা দাঁড়াল ৫২.৫%। মিশিগান ইউনিভার্সিটির অর্থনৈতিক ইতিহাসের শিক্ষক এলিস রতেলা-র মতে, টাইপরাইটার, অ্যাডিং মেশিন আর ডিকটাফোন ছিল মেয়েদের কাজের জগতে টেনে আনার মুখ্য চালিকাশক্তি।
প্রথম যে টাইপরাইটার তৈরি করেছিল রেমিংটন কোম্পানি, তার চেহারা ছিল সেলাই মেশিনের মতো। মজার কথা হল, রেমিংটন প্রথমে বানাত বন্দুক, আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ থামার পর বন্দুকের চাহিদা কমায় তারা সেলাই মেশিন বানাতে শুরু করে। তার পর আসে টাইপরাইটার। সেলাই মেশিনের ট্রেডলই টাইপরাইটারে ব্যবহার করা হয়েছিল, এমনকি একই ফুলেল নকশা। হয়তো ইচ্ছাকৃত নয়, কিন্তু এতে একটা ব্যাপার হল— লোকে ভাবল, সেলাই মেশিনের মতো এই টাইপরাইটারও মেয়েদের পক্ষে ভারী মানানসই একটা জিনিস।
১৮৮১ সালে ওয়াইএমসিএ অব নিউ ইয়র্ক মেয়েদের জন্য আট মাসের একটা স্টেনোগ্রাফার টাইপরাইটিং কোর্স শুরু করল। আর অমনি কিছু লোক বলতে শুরু করল এটা কত খারাপ। মেয়েদের আসল জায়গা ঘর, আর অফিসে ছেলেমেয়ে পাশাপাশি কাজ করলে অনর্থ হবে। মেয়েদের কী কাজ করা উচিত, উনিশ শতকে আর বিশ শতকের গোড়ার দিকে এই আলোচনায় বেশি শোনা যেত দু’টি শব্দ— ন্যাচারাল এবং আনন্যাচারাল। ন্যাচারাল অর্থাৎ স্বাভাবিক কাজ হচ্ছে মেয়েদের বাড়িতে থাকা আর ছেলেদের অফিসে কাজ করা। সেই হিসাবে মেয়েদের টাইপরাইটারে কাজ করা ছিল একটা আনন্যাচারাল কাজ— অ-স্বাভাবিক।
শুরুর দিকে মেয়েরা টাইপ করলেও অনেক সময় তাঁরা অফিসে বসে কাজ করতেন না, এজেন্সির মাধ্যমে তাঁদের দিয়ে করিয়ে আনা হত। ১৮৭৫ সালে ডান অ্যান্ড ব্র্যাডস্ট্রিট মেয়েদের অফিসে বসিয়েই কাজ করাতে শুরু করল। বহু পুরনো সিনেমায় অফিস দেখালে অপরিহার্য ছিল মেয়েদের খুটখুট টাইপ করার দৃশ্যও। তবে বেশির ভাগ অফিসেই বিয়ে হয়ে গেলে টাইপিস্ট মেয়েদের ছাঁটাই করা হত।
সেরেস্তা ও অন্যান্য-তে কিন্নর রায় লিখছেন, “রেমিংটন টাইপরাইটারের পাশাপাশি ‘গোদরেজ’ কোম্পানির টাইপরাইটার দেখেছি। যথেষ্ট, সেই টাইপরাইটিং মেশিনও যথেষ্ট শক্তপোক্ত মজবুত। পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর দশকেও টাইপরাইটার অপারেটর ও স্টেনোগ্রাফারের চাকরি ছিল বেশ অনেকটাই ব্যাপ্ত। স্কুল ফাইনাল, ম্যাট্রিক বা হায়ার সেকেন্ডারি, নয়তো প্রি ইউ— প্রি ইউনিভার্সিটি পাশ করে অনেকেই টাইপরাইটিং ও স্টেনোগ্রাফি শেখার জন্য ভর্তি হতেন বিশেষ কলেজে বা টাইপরাইটিং স্কুলে। সেখানে টাইপরাইটিং ও স্টেনোগ্রাফি শেখানো হত। স্টেনোগ্রাফি শেখার জন্য ‘পিটম্যান’-এর বই ছিল বিখ্যাত। তখন সাইক্লোস্টাইল মেশিনের যুগ। টাইপরাইটিং, স্টেনোগ্রাফির পাশাপাশি ছিল মোম মাখানো কাগজের ওপর লোহার সূচিমুখঅলা কলম দিয়ে লেখা।”
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘অবতরণিকা’ গল্পে অফিসের আবহ তৈরি করেছে টাইপরাইটারের খুটখাট। ‘চেক’ গল্পে সরসী দত্ত ক্লাইভ রোডে সওদাগরি অফিসে আশি টাকা মাইনেতে টাইপিস্ট হয়ে ঢোকে সংসারের কিছু সুরাহার চেষ্টায়। যদিও প্রথমে তার বাবা কিছুতেই চাননি মেয়ে চাকরি করুক। বলেছিলেন মরে গেলেও মেয়েকে আগুনের মধ্যে পাঠাবেন না।
অনুপমা-য় কল্যাণীর মায়ের তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও নিজের অফিসে কল্যাণীকে টাইপিস্টের একটা অস্থায়ী কাজ জোগাড় করে দেয় নরেন। মা বলেন, কেন, কাজটা ছেলে অবনী করুক না। নরেন বলে, ছুটি-নেওয়া এক মেয়ে টাইপিস্টের কাজেই দু’মাসের জন্য আর এক জন মেয়ে টাইপিস্ট চাইছে অফিস। হাসিমুখে চাকরি করতে লেগে যায় কল্যাণী। অবশেষে সংসারের মানুষগুলোর মুখে হাসি ফিরে আসে। পুরুষের চেয়ে সে কম কিসে?
হলিউডের পপুলারিয়া, দ্য টাইপিস্ট, বলিউডের ওয়াজুদ, টলিপাড়ার লুকোচুরি, পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট— টাইপিস্ট-জীবন ছুঁয়ে ছুঁয়ে আরও কত ছবি!
ভারতে এক সময় বছরে ৫০,০০০ টাইপরাইটার মেশিন প্রস্তুত করত যারা, সেই গোদরেজ সংস্থা ২০০৯ সালে এই যন্ত্র বানানো চিরতরে বন্ধ করে দেয়, চাহিদা একেবারে কমে যাওয়ার কারণে। তত দিনে মেয়েরাও পেয়ে গিয়েছেন নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য উন্নততর বিকল্প।