—প্রতীকী ছবি।
মানুষের জন্য সৎ ভাবে কাজ করা বা রাজধর্ম পালনে একনিষ্ঠ থাকার সঙ্গে পরের নির্বাচনে ভোটে জিতে ক্ষমতায় ফিরে আসার সমানুপাতিক সম্পর্ক কোনও কালেই ছিল না। এই সম্পর্ককেই আজকের তথ্যকেন্দ্রিকতার যুগে আরও অনেক বেশি জটিল করে ফেলেছে আন্তর্জালে ছড়িয়ে থাকা কৃত্রিম মেধার ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন সংস্থা। গত অর্ধ দশকে স্মার্টফোনের ব্যবহারের পরিসংখ্যানে দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে ভারত। অথচ, এ দেশের তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশই ৩০-৪০ সেকেন্ডের রিলের বাইরের জগতে ঠিক কী ঘটছে, তা বুঝতে অপারগ। আর এইখানেই ভুয়ো তথ্যে নির্মিত আপাতসত্যের ছায়াছবি নির্মাণ করে জনমতকে প্রভাবিত করার খেলা চলছে। শুধু ভারতেই নয়, দুনিয়ার প্রায় সর্বত্রই ধনী রাজনৈতিক দলগুলো চাকরি দিচ্ছে নবীন যন্ত্রমেধার স্নাতকদের, খুলে ফেলছে স্টার্ট-আপ। সমাজমাধ্যমে হাস্যকর রকমের অপেশাদার পোস্ট করতে থাকা তথাকথিত ‘আইটি সেল’-গুলো খুব তাড়াতাড়ি খোলনলচে পাল্টে হয়ে উঠছে ‘পলিটিক্যাল এআই’ (রাজনৈতিক কৃত্রিম মেধা) টিম। আর এখানেই সম্ভবত আরও ঘনীভূত হয়ে উঠছে গণতন্ত্রের এক অনিবার্য বিপর্যয়— প্রকৃত জনমত, রাষ্ট্রের কল্যাণকামী শক্তি এবং নির্বাচনী ফলাফলের মধ্যে বাড়তে থাকা ব্যবধান।
২০০৮-এ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে শুরু হয়েছিল নেটিজ়েনদের তথ্য ব্যবহার করে নির্বাচনী প্রচারের বিবিধ কৌশল। আজকের নেটদুনিয়ার তুলনায় সে ছিল নিতান্ত প্রস্তরযুগ। এখন যে কোনও বড় নির্বাচনের প্রাক্কালে ভোটদাতাদের মতামতকে প্রভাবিত করা থেকে শুরু করে অঞ্চলভিত্তিক ভাবে বিরুদ্ধ মতের ভোটারদের চিহ্নিত করে তাঁদের ভয় দেখানোর রকমারি কৌশল, সর্বত্রই বিগ ডেটা প্রযুক্তি ও মেশিন লার্নিং-এর অবাধ অপপ্রয়োগ শুরু হয়েছে।
কৃত্রিম মেধাচালিত এক ধরনের কম্পিউটার প্রোগ্রাম যখন কোনও মানুষ ইন্টারনেট-ব্যবহারকারীকে নকল করতে পারে, তখন সেই প্রোগ্রামটিকে বলা হয় একটি ‘এআই বট’। বট হল রোবটের অপভ্রংশ। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা আন্তর্জালেই এদের বাস। বট ও মানুষের সংযোগের যেমন ভাল দিক আছে, তেমনই আছে খারাপ দিকও। আজকের এআই বটগুলোর অন্যতম চালিকাশক্তি হল জেনারেটিভ এআই বা সৃজনশীল কৃত্রিম মেধা— এমন এক কম্পিউটার প্রোগ্রাম, যার সামনে উদাহরণ হিসাবে আসল ক্যামেরায় তোলা অনেক মানুষের ছবি হাজির করা হলে, এই ছবিগুলোর অভ্যন্তরীণ গঠন-কাঠামো বুঝে ফেলে সে নিজেই বানিয়ে ফেলতে পারে এমন নকল ছবি, যাতে ক্যামেরায় ধরা এক জন হাসিমুখের মানুষ আছেন যিনি আদৌ কখনও পৃথিবীতে জন্মাননি।
জেনারেটিভ এআই-এর এই নকল তথ্য বানানোর দুর্দান্ত ক্ষমতাটি এখন বিস্তৃত হয়েছে নকল ভিডিয়ো, টেক্সট, এবং অডিয়ো-র মতো বহুমাত্রিক তথ্যের ক্ষেত্রেও। এক জনের ধড়ে আর এক জনের মাথা বসিয়ে দেওয়া কিংবা ঘরের সোফায় বসে তোলা আপনার ছবির পটভূমিতে পুরীর সমুদ্র এনে ফেলা— ডিজিটাল ছবির জগতে এ সব কারিকুরি প্রচলিত ছিল বহু বছর ধরে। তবে, খুঁটিয়ে দেখলে অনেক সময়েই নকলটি ধরে ফেলা যেত। আজকের দিনে ডিপফেক-এর মতো প্রযুক্তি এসে আসল-নকলের ফারাক বোঝার কাজটিকে কঠিনতর করে তুলেছে। মানব স্নায়ুতন্ত্রের অনুকরণে নির্মিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সফলতম অধ্যায় অর্থাৎ ‘ডিপ লার্নিং’ এবং ‘ফেক’— এই শব্দ দুটো মিশিয়ে তৈরি হয়েছে ডিপফেক। নকল, কিন্তু একেবারে আসলের মতো ছবি, ভিডিয়ো, অডিয়ো বানানোতে এর জুড়ি নেই।
স্বভাবতই এর অপপ্রয়োগের ক্ষেত্রটি রাজনীতির অঙ্গনেও প্রসারিত হয়েছে। ডিপফেকের সাহায্যে তৈরি কোনও ভিডিয়োতে হয়তো দেখা যাচ্ছে এক জন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তাঁর প্রতিপক্ষকে অসাংবিধানিক ভাষায় আক্রমণ করছেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বহু কোটি মানুষ দেখে ফেলছেন ভিডিয়ো ক্লিপটি। যত দিনে সত্যতা যাচাই করে জানা যাবে যে ভিডিয়োটি ভুয়ো, তত ক্ষণে সেই নেতার ভাবমূর্তির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। আমেরিকায় জো বাইডেন থেকে পাকিস্তানে ইমরান খান, অনেকেই ডিপফেকের শিকার হয়েছেন গত এক-দেড় বছরে। এর উল্টোটাও অবশ্য হচ্ছে— মুখ ফস্কে কুকথা বলে ফেলা নেতা দাবি করছেন, সেই ক্লিপটি আসলে ডিপফেকের কারসাজি! সমস্যার গভীরতা মেনে নিয়ে বিজ্ঞানীমহলে দাবি উঠছে, যে সব কোম্পানি জেনারেটিভ এআই-এর সফটওয়্যার বাজারে আনবে, তাদের আসল আর নকল কনটেন্টের ফারাক করার প্রোগ্রামকেও রাখতে হবে ব্যবহারকারীদের নাগালের মধ্যে।
সমাজমাধ্যমই এখন আমাদের রাজনৈতিক তরজার চণ্ডীমণ্ডপ। টাইপ করা প্রতিটা শব্দ, পোস্ট করা ছবি বা ভিডিয়ো থেকে যায় সমাজমাধ্যমের বিস্তীর্ণ যান্ত্রিক স্মৃতির মধ্যেই। এই সব ডিজিটাল স্বাক্ষর থেকে আপনার বা আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পছন্দ বুঝে নিয়ে আমাদের মনের মতো করে দলীয় কর্মসূচি ও বিজ্ঞাপন সাজিয়ে আমাদেরই মোবাইল কিংবা সমাজমাধ্যমে পাঠাতে থাকা আজকের বিগ ডেটা প্রযুক্তির পক্ষে খুবই সহজ। মানুষের রাজনৈতিক মতামতকে প্রভাবিত করার পক্ষে এআই বটের ব্যবহারের একটি চমকপ্রদ উদাহরণ হয়ে থাকবে ২০১৭-র মে মাসে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ভোটের ঠিক আগে হঠাৎই ফেসবুক ও টুইটারে বন্যার মতো আছড়ে পড়ে স্বয়ংক্রিয় বটের স্রোত, প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ইমানুয়েল মাকরঁ-র হ্যাক করা বিভিন্ন বৈদ্যুতিন বার্তার সঙ্গে বিবিধ নকল রিপোর্ট মিলিয়ে ভোটারদের সামনে নির্মাণ করা হয় এক ধরনের আখ্যান, যেখানে মাকরঁ চিহ্নিত হন এক জন প্রতারক হিসাবে। পরে অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউট-এর বিশ্লেষণে সামনে আসে চমকপ্রদ পরিসংখ্যান। গবেষণায় দেখা যায় যে, মুষ্টিমেয় টুইটার অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এই অপপ্রচারের ৫০ শতাংশ কনটেন্ট উৎপন্ন হয়েছিল। এই অ্যাকাউন্টগুলো থেকে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ১,৫০০ নতুন টুইট এবং আবার প্রতি ঘণ্টায় ৯,৫০০ বার করে রিটুইট হয়েছিল। নির্বাচনের দিন ফ্রান্সে প্রতি ঘণ্টায় এই ভুয়ো তথ্যের ভিত্তিতে প্রভাবিত হয়েছিলেন প্রায় তিন কোটি টুইটার ব্যবহারকারী।
যে কোনও প্রযুক্তি যত পরিণত হয় ওঠে, ততই তার অভিঘাত তীব্রতর হয়, কঠিন হয় তার ফাঁকফোকর ধরতে পারা। ভারতের মতো দেশের পক্ষে এর সুদূরপ্রসারী ফল মারাত্মক। এ দেশের মানুষের বড় অংশ ইন্টারনেটের ব্যবহার ও বিপদ সম্পর্কে অন্ধকারে। মুদির দোকানে ফোন পে-র মাধ্যমে ১০ টাকার লেনদেন থেকে আধার কার্ডটিকে সমস্ত ডিজিটাল পরিষেবার সঙ্গে সম্পর্কিত করা— এ রকম কত ফাঁক গলে তথ্যের বিরাট জালের মধ্যে রাষ্ট্রীয় নজরদারিতে আটক পড়ছেন তাঁরা, এতে কতটা সুরক্ষিত থাকছে সংবিধান প্রদত্ত মানবাধিকার, এ সব খুব একটা আলোচিত নয় এখনও। এক দিকে যখন রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন অঞ্চলে তথ্যভিত্তিক সমীক্ষা চালিয়ে কে কোন আসনের প্রার্থী হবেন ঠিক করার চেষ্টা চালাচ্ছে, তখন নকল খবর পরিবেশন করে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়িয়ে দেওয়া থেকে ডিপফেকের মাধ্যমে উঠতি প্রতিবাদী নেতার গোপন মুহূর্তের নকল ভিডিয়ো নেটে ফাঁস করে দেওয়া— এ সবও আজ বিরল নয়। রয়েছে তথ্যে জল মিশিয়ে প্রাক্-নির্বাচনী জনমত সমীক্ষার কৃত্রিম মেধা নির্ধারিত ফলাফলকে একটি বিশেষ দলের অনুকূলে সাজিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও।
তথ্য এই নতুন যুগের পেট্রল হলেও, কৃত্রিম মেধা সেই তেল পুড়িয়ে চলা ইঞ্জিন। তথ্যে কারচুপি থাকলে সেই ইঞ্জিন ঠিকমতো কাজ করবে না। তথ্যের সুরক্ষা ও সত্যতা বজায় রাখার পথে বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে অজস্র ডিজিটাল কনটেন্ট ও সেগুলোর পিছনে থাকা ছোট-বড় মিডিয়া প্রতিষ্ঠান, অস্তিত্ব বজায় রাখতে যাদের চব্বিশ-ঘণ্টা টিভি চ্যানেলে, ফেসবুকে, টুইটারে, হোয়াটসঅ্যাপে মুখরোচক খবর পরিবেশিত হচ্ছে।
২০২৪-এর পৃথিবীতে রাষ্ট্রনায়কদের কাছে একটা অবশ্যম্ভাবী গণ-অভ্যুত্থান বা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে বন্ধু পুঁজিপতিদের ভাতে মারার চেয়ে অনেক সহজ হল আন্তর্জালের প্রচ্ছন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের চিন্তা-ভাবনার রাশকে হাতে রাখা, যাতে অজানতেই তাঁদের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ শাসকের একনায়কতন্ত্রকে গণতন্ত্রের লোক-দেখানো মোড়কে পরিপুষ্ট করে তোলে। স্কুলস্তর থেকেই ইন্টারনেটের অপব্যবহার, তথ্যের সুরক্ষা এবং ডিজিটাল কনটেন্টের সত্যতা বিষয়ে নবীন প্রজন্মকে সতর্ক করা না হলে, চোখের আড়ালে গণতন্ত্রের এই ধীর কিন্তু নিশ্চিত মৃত্যুকে আটকানো যাবে না।