—ফাইল চিত্র।
নাগলা বিধিচাঁদ? নামটা শোনা শোনা লাগছে যেন!” ট্যাক্সিচালক আকাশ যাদবের গ্রামের নাম শুনে কথাটা বলেই ফেললাম। আগরায় এক কনফারেন্স সেরে আকাশের ট্যাক্সিতে দিল্লি ফিরছিলাম। আমার স্বগতোক্তির উত্তরে আকাশ বললেন, “বছর চারেক আগে আমাদের গ্রামের নামটা খবরে এসেছিল, স্যর। তখন লকডাউন চলছিল। সোনিয়া কুমারী নামে আমাদের গ্রামের একটা বাচ্চা মেয়ে না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছিল সেই সময়। অনাহারে মৃতপ্রায় অবস্থা হয়েছিল গ্রামের আরও অনেকেরই।”
মনে পড়ে গেল খবরটা। কোনও একটা ইংরেজি দৈনিকে পড়েছিলাম। বছর পাঁচেক বয়স ছিল সোনিয়ার। ওর মা লকডাউনে কাজ হারিয়েছিলেন। সোনিয়ার বাবা আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন, মায়ের উপার্জনেই সংসার চলত। প্রথম দু’তিন মাস পড়শিরা খাবারদাবার দিয়ে সাহায্য করেছিলেন সোনিয়াদের। তার পর এক সময় সেটাও বন্ধ হয়ে যায়, কারণ তত দিনে আগরা থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত গোটা গ্রামটিকেই গ্রাস করেছিল চরম দারিদ্র। একটা সময় আসে, সোনিয়ারা কার্যত অনাহারে কাটায় টানা দিন তিনেক। তার ফলে গুরুতর ডায়রিয়া এবং ডিহাইড্রেশনে আক্রান্ত হয় সোনিয়া। অচিরেই মৃত্যু। মনে পড়ল, খবরটা এমনই বিচলিত করেছিল আমায় যে, দু’রাত ঘুমোতে পারিনি ঠিকমতো।
দিল্লি ফিরে এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে রাতে ফোনে কথা হচ্ছিল এই নিয়ে। বললাম, “যে ঘটনাটা দু’রাত ঘুমোতে দেয়নি, এত তাড়াতাড়ি কী করে ভুলে গিয়েছিলাম বলো তো সেটা? আমার কি স্মৃতিভ্রম হচ্ছে?” বন্ধু জবাব দিল, “কেবল তোমার নয়, আমাদের গোটা দেশেরই স্মৃতিভ্রম হয়েছে। শুধু সোনিয়া কুমারী কেন? গোটা পর্বটাই ভুলে গিয়েছি আমরা। মাত্র কয়েক ঘণ্টার নোটিসে জারি হওয়া পুরোপুরি অপরিকল্পিত লকডাউনের ফলে যে ভয়ঙ্কর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, তার কোনও স্মৃতিই আর অবশিষ্ট নেই আমাদের মনে। রামমন্দির, বিকশিত ভারত, বুলেট ট্রেন আর অচ্ছে দিনের স্বপ্নে আমরা এতটাই বুঁদ হয়ে আছি যে, এ সব তুচ্ছ ঘটনা আমাদের মনেই পড়ে না!”
সত্যিই। চার বছরও পূর্ণ হয়নি, ইতিমধ্যেই কোভিড এবং লকডাউনের সময়টা ভুলে গিয়েছি আমরা বিলকুল। কিন্তু সেটা তো হওয়ার কথা ছিল না। লকডাউনের ফলে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল দেশ জুড়ে, সেটা তো মনে রেখে দেওয়া উচিত ছিল আমাদের। মনে যে রাখিনি, তার একটা কারণ কি এই যে, আমরা যারা মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্গত, তাদের কাছে লকডাউনটা একটা সময়ের পর কেবল একটা লম্বা আরামদায়ক ছুটিতে পর্যবসিত হয়েছিল— পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর, ডালগোনা কফি বানানোর, ওয়েব সিরিজ় দেখার নিশ্চিন্ত অবসর?
যদি এর পরিবর্তে, লকডাউনের দরুন তৈরি হওয়া তীব্র খাদ্য সঙ্কটের বীভৎসতা স্পর্শ করত আমাদের? ভিন রাজ্যে সহসা কর্মচ্যুত হয়ে এবং মাথার উপরে ছাদ হারিয়ে যদি ফোস্কা পড়া পা আর পিঠের অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে কিংবা সাইকেল চালিয়ে ফিরতে হত নিজেদের রাজ্যে? রোগীর চাপে কার্যত ভেঙে পড়া সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় জায়গা না পেয়ে যদি চোখের সামনে প্রিয়জনকে শবে পরিণত হতে দেখতাম? তা হলে কি ভুলে যেতে পারতাম লকডাউনের সেই সময়টাকে? সেই দুঃসহ দিনগুলোকে, রাতগুলোকে?
কী জানি, যদি এ সব অভিজ্ঞতা হত, তা হলেও হয়তো পারতাম ভুলে যেতে। কারণ লকডাউনের ভয়াবহতা যাঁদের স্পর্শ করেছিল সবচেয়ে বেশি, সেই গরিব নিম্নবিত্ত মানুষ তো পেরেছেন ভুলে যেতে সব কিছু। যদি তা না হত, তা হলে কি যে রাজ্যগুলিতে লকডাউনের ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল, সেই রাজ্যগুলির কোভিড-পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে মানুষ ঢেলে ভোট দিতেন বিজেপিকে? যদি গরিব মানুষ মনে রেখে দিতেন সেই অন্ধকার সময়টাকে, তা হলে কি ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে দেশের শাসক দল বাধ্য হত না অন্তত এক বারের জন্যও ভুল স্বীকার করে বলতে যে, অপরিকল্পিত ভাবে লকডাউন জারি করা অন্যায় হয়েছিল? নিশ্চিত হত। যদি সত্যিই ঢেউ উঠত, সেটা বিজেপির মতো দলের বুঝতে অসুবিধে হত না এতটুকু। এবং তা হলে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েও তাদের ভুল স্বীকার করতে হত, ক্ষমা চাইতেই হত জনতার কাছে। কারণ ভোটের আগে জনতা যে সত্যি জনার্দন।
কিন্তু সেটা তো হল না! লোকসভা নির্বাচনের আগে লকডাউন নিয়ে টুঁ শব্দটিও করল না দেশের শাসক দল। তার কারণ তারা ভাল করেই জানে, লোকে ভুলে যায়। গরিব মানুষ ভুলে গিয়েছেন সব। শাসকরা জানেন, লকডাউনের সময়ে তাঁদের ভোগান্তির জন্য গরিব মানুষ নিজের কপালকে দুষবেন, কিন্তু শাসক দলের দিকে বা তার সর্বোচ্চ নেতার দিকে আঙুল তুলবেন না।
না কি, লকডাউনের ফলে গরিব মানুষের যতটা ভোগান্তি হয়েছিল বলে ভাবা হয়, আদৌ ততটা ভোগান্তি হয়নি তাঁদের? সোনিয়া কুমারীর মৃত্যুর মতো ঘটনা নেহাতই ব্যতিক্রম? খবরের কাগজের আর্কাইভ ঘাঁটলে কিন্তু তেমনটা মনে হয় না একেবারেই। যেমন আনন্দবাজার পত্রিকা-য় ১২ এপ্রিল ২০২০-তে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, “এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ঝাড়খণ্ডের ১৯টি জেলা এবং ৫০টি ব্লকে ‘রাইট টু ফুড ক্যাম্পেন’ নামের একটি সমীক্ষা চালানো হয়...। তাতে দুর্ভিক্ষের ছবিটাই আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেখা গিয়েছে, প্রান্তিক মানুষরা খাবার থেকে বঞ্চিতই রয়ে গিয়েছেন সেখানে। রেশন কার্ড থাকা সত্ত্বেও ৫০টি ব্লকের মধ্যে ২০টিতে কোনও চাল-ডাল-গম পৌঁছয়নি।” এর কয়েক দিন পর (২৫ এপ্রিল) একই পত্রিকায় প্রকাশিত আর একটি প্রতিবেদনেও উঠে এসেছিল গরিব মানুষের মর্মান্তিক অবস্থার আরও একটি ছবি, “লকডাউনের মাঝে দেশ জুড়ে মোট ১১,১৫৯ জন পরিযায়ী শ্রমিকের উপর করা একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ২৫ মার্চ দেশ জুড়ে লকডাউন শুরু হওয়ার পর ওই শ্রমিকদের ৯০ শতাংশেরও বেশি মজুরি পাননি মালিকপক্ষের কাছ থেকে। ফলে ২৭ মার্চ থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত অন্তত ৭০ শতাংশের হাতে ছিল মাত্র ২০০ টাকা, সেটাই একমাত্র ভরসা।”
লকডাউনের ফলাফল নিয়ে পরবর্তী সময়ে হওয়া অসংখ্য গবেষণার দিকে চোখ রাখলেও একই ছবি দেখতে পাওয়া যায়। ২০২১-এ প্রকাশিত আজ়িম প্রেমজি ইউনিভার্সিটির গবেষকদের একটি গবেষণাপত্র দেখিয়েছে, ২০২০-র এপ্রিল এবং মে মাসে, দেশের দরিদ্রতম ২০ শতাংশ পরিবার তাদের সম্পূর্ণ আয় হারিয়েছিল। একই গবেষণা আরও জানিয়েছে, অতিমারি এবং লকডাউন দেশের ২৩ কোটি মানুষকে দারিদ্রসীমার নীচে ঠেলে দিয়েছিল। এর ফলে ভারতের গ্রামীণ এলাকায় দারিদ্রের হার বেড়ে ছিল ১৫ শতাংশ বিন্দু আর শহুরে এলাকায় ২০ শতাংশ বিন্দু।
এত সবের পরও গরিব মানুষ যে ভুলে গেলেন লকডাউনের বীভৎসতা, হয়তো গরিব মানুষের ভুলে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই বলেই। চাকরিবাকরির শোচনীয় অবস্থা, আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, মাত্রাছাড়া অসাম্য— বর্তমান নিয়েই চূড়ান্ত নাজেহাল তাঁরা। তাই অতীত যতই দুঃসহ হোক, সেটা মনে রাখার মতো ‘বিলাসিতা’ তাঁদের নেই। সে কারণেই তাঁদের সঙ্গে যতই অন্যায় হয়ে থাকুক, পার পেয়ে যায় অন্যায়কারীরা। যুগ যুগ ধরে এটাই হয়ে এসেছে। প্রতিবাদ করতে, প্রশ্ন করতে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেও তো ন্যূনতম শক্তি লাগে। আজকের নয়া ভারতে গরিব নিম্নবিত্ত মানুষের সেই শক্তিটুকুও সম্ভবত অবশিষ্ট নেই।
কিন্তু, যাঁদের পক্ষে সেই অতীত মনে রাখা সম্ভব, তাঁরাও যদি স্বেচ্ছায় বিস্মৃত হন, ভুলে যান সোনিয়া কুমারীর বীভৎস মৃত্যুর কথা, ভুলে যান রেললাইনে পড়ে থাকা রক্তমাখা রুটির কথা, ভুলে যান কাজ হারিয়ে আয় হারিয়ে দিশাহারা মুখগুলির কথা, সেই বিস্মৃতি অক্ষমণীয়।