প্রশ্ন হল, জাত-ধর্ম নির্বিশেষে ‘সন্দেহভাজন নাগরিক’ বাড়বে কি
CAA

দেশহীনতার আতঙ্ক

পুরনো রেকর্ড ঘেঁটে দেখছি, ২০১৯-এর ১১ এপ্রিল থেকে সে বছরের ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে অন্তত ছ’বার এই সিএএ-এনআরসি’র ঘটনাপরম্পরা ব্যাখ্যা করেছেন অমিত শাহ।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২৪ ০৮:০১
Share:

বিপদাভাস: সিএএ কার্যকর হওয়ার সিদ্ধান্তে নাগরিক উদ্বেগ, কলকাতা, ১২ মার্চ।

একটা প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। বাংলাদেশ থেকে আসা কোনও মানুষ এ দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য সিএএ-র নিয়মমাফিক আবেদন করলেন। কিন্তু যে সব নথি চাওয়া হয়েছে, তার কোনওটাই দিয়ে উঠতে পারলেন না। বা অন্য কোনও কারণে তাঁর আবেদন খারিজ হয়ে গেল। সে ক্ষেত্রে তাঁর পরিচিতি কী হবে? তিনি কি বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যাবেন? তিনি কি এ দেশে থেকেও অ-নাগরিক হয়ে যাবেন? না কি তাঁকে সন্দেহভাজন নাগরিক বলা হবে?

Advertisement

গত লোকসভা নির্বাচনের পরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মুখে বার বারই একটি বাক্য শোনা যেত। ‘আপ ক্রোনোলজি সমঝ লিজিয়ে’! সহজ ভাষায় সিএএ ও এনআরসি-র কালানুক্রম ঘটনাপরম্পরা বোঝাতেন তিনি। অমিত শাহের ব্যাখ্যা ছিল, প্রথমে সিএএ আসবে। নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন করা হবে। তার মাধ্যমে সমস্ত শরণার্থীকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। তার পরে এনআরসি আসবে। বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করা হবে। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, গোটা দেশে এনআরসি আসবে। কারণ, অনুপ্রবেশকারীরা শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা দেশের সমস্যা। শরণার্থীদের এনআরসি নিয়ে চিন্তা করার কারণ নেই। তবে বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের চিন্তার কারণ রয়েছে।

পুরনো রেকর্ড ঘেঁটে দেখছি, ২০১৯-এর ১১ এপ্রিল থেকে সে বছরের ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে অন্তত ছ’বার এই সিএএ-এনআরসি’র ঘটনাপরম্পরা ব্যাখ্যা করেছেন অমিত শাহ। কখনও পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা ভোটের প্রচারে, কখনও সংবাদমাধ্যমের সামনে, কখনও সংসদে দাঁড়িয়ে শাহ বলেছেন, প্রথমে সিএএ, তার পরে এনআরসি। সিএএ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মাধ্যমে কারও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে না। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। তবে, এনআরসি বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরির সময় চিহ্নিত করা হবে, কারা ভারতীয় নাগরিক, কারা নাগরিক নন।

Advertisement

সিএএ-এনআরসি’র বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন দানা বাঁধছে, মোদী সরকার এ দেশের মুসলমানদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তাঁদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠছে, সে সময়ও একই কথা বলে গিয়েছিলেন অমিত শাহ। ২০১৯-এর ১৭ ডিসেম্বরের পরে অমিত শাহের মুখে আর এ কথা শোনা যায়নি। কারণ, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঠিক তার পরেই অমিত শাহের উল্টো সুর ধরেন। সে বছর ২২ ডিসেম্বর দিল্লির রামলীলা ময়দানে বিজেপি দিল্লি বিধানসভা ভোটের প্রচার শুরু করেছিল। সেই জনসভায় মোদী বলেছিলেন, তাঁর সরকারের আমলে এনআরসি নিয়ে কোনও দিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় আলোচনা হয়নি। সংসদে এনআরসি আসেনি। এনআরসি-র বিধিনিয়ম তৈরি হয়নি। মিথ্যে প্রচার করা হচ্ছে।

প্রশ্ন হল, দেশের প্রধানমন্ত্রী, না কি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কার কথা বিশ্বাস করা উচিত? এক জন বলছেন, সিএএ-র পরে এনআরসি আসছে। অন্য জন বলছেন, এনআরসি নিয়ে কোনও আলোচনাই হয়নি। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য সে দিন এ কথা বলেননি, এনআরসি আসবে না। প্রধানমন্ত্রীর সেই বক্তৃতার পরেই সিএএ-এনআরসি নিয়ে জনমানসে ‘বিভ্রান্তি’ দূর করতে সরকারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছিল। মূলত হিন্দি ও উর্দু সংবাদপত্রে প্রকাশিত সেই বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল— দেশ জুড়ে এনআরসি হবে বলে কোনও ঘোষণা হয়নি। ‘যদি কখনও’ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়, তা হলে এমন ভাবে বিধিনিয়ম তৈরি করা হবে, যাতে ভারতীয় নাগরিকদের যেন কোনও সমস্যা না হয়।

সেই ‘যদি কখনও’ এখনও আসেনি। দেশ জুড়ে এনআরসি বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরির প্রকল্প এখনও ঝোলা থেকে বেরোয়নি। তবে সিএএ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন চালু হয়ে গেল। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের সময় থেকে সিএএ নিয়ে বিজেপি ঢাক পেটাতে শুরু করেছিল। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের মুখে দাঁড়িয়ে সিএএ চালু হল। প্রশ্ন হল, এই সিএএ-র মাধ্যমে কি আসলে এনআরসি-র প্রক্রিয়া শুরু করে দিল মোদী সরকার?

সিএএ চালুর পরে কলকাতা তথা দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা ‘এনআরসি-র বিরুদ্ধে যৌথ ফোরাম’-এর মাধ্যমে যে বিবৃতি জারি করেছেন, সেখানে ঠিক এই প্রশ্নই তোলা হয়েছে। সিএএ-কে আসলে ‘এনআরসি-র মতো প্রক্রিয়া’ বলেই আখ্যা দিয়েছেন তাঁরা। কারণ সিএএ-র নিয়ম বলছে, একটি ‘এমপাওয়ার্ড’ বা ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি নাগরিকত্বের আবেদন যাচাই করবে। চাইলেই কেউ নাগরিকত্ব পাবেন না। স্বাভাবিক নিয়মেই অনেক আবেদন খারিজ হয়ে যাবে। তার মধ্যে একটা অংশ থাকবে, যাঁরা সত্যিই বেআইনি অনুপ্রবেশকারী। এ দেশে সম্প্রতি ঢুকে পড়ে ভারতের নাগরিকত্ব জোগাড়ের চেষ্টা করছেন। কিন্তু আর একটা অংশ থাকবে, যাঁরা বহু দিন ধরে এ দেশে বসবাস করছেন। তাঁদের রেশন কার্ড, আধার বা ভোটার কার্ডও রয়েছে। তাঁদের আবেদন খারিজ হয়ে গেলে তাঁরা কি ‘অ-নাগরিক’ বা ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’ হয়ে পড়বেন! তার পরে কি তাঁদের আধার কার্ড নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে? যেমন, সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে বহু মানুষের আধার নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিল। কারণ, আধার বিধিনিয়মে নতুন ধারা যোগ করে এখন আধার কর্তৃপক্ষকে কারা ভারতীয় নাগরিক, কারা নন, তা নির্ধারণের ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে।

ফলে মোদী সরকার যতই বলুক, সিএএ-র মাধ্যমে কারও নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হচ্ছে না, শুধুমাত্র শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়া হচ্ছে— বাস্তবে সিএএ নিছক সিএএ থাকছে না। এর মাধ্যমেই কে নাগরিক, কে নাগরিক নন, বা সন্দেহভাজন নাগরিক, তার বাছাইপর্ব শুরু হয়ে যাচ্ছে। যিনি নাগরিকত্ব সংশোধন আইনে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করবেন, তিনি প্রথমেই মেনে নিচ্ছেন, তিনি এ দেশের নাগরিক নন। তার পরে আবেদন খারিজ হয়ে গেলে তাঁর কী হবে, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। মনে করিয়ে দেওয়া যাক, যাঁরা এই প্রশ্নের মুখে পড়বেন, তাঁরা কেউই মুসলমান নন। কারণ, সিএএ-তে মুসলমানদের নাগরিকত্ব পাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। শুধুমাত্র বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় উৎপীড়নের ফলে এ দেশে চলে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, পার্সি, জৈন, খ্রিস্টানরাই আবেদন করতে পারছেন। আরও একটি প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্ট নাগরিকরা। তা হল, কে ভারতীয় নাগরিক, কে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী, তা নির্ধারণের দায়িত্ব রাষ্ট্রের; সরকার, পুলিশ, প্রশাসনের। সিএএ নাগরিকত্ব প্রমাণের দায় নিশ্চুপে নাগরিকদের ঘাড়ে ঠেলে দিচ্ছে। যেমনটা হয়েছিল অসমে; এনআরসি তৈরির সময়।

প্রধানমন্ত্রী ২০১৯-এর সেই রামলীলা ময়দানের জনসভা থেকে বলেছিলেন, সিএএ বা এনআরসি-র সঙ্গে ভারতীয় মুসলমানদের কোনও লেনাদেনা নেই। কাউকে ‘ডিটেনশন সেন্টার’-এ পাঠানো হচ্ছে না। ভারতে কোনও ডিটেনশন সেন্টারই নেই— যেখানে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বা বিদেশি নাগরিক হিসাবে চিহ্নিতদের আটকে রাখা হবে। বাস্তব হল, অসমের গোয়ালপাড়াতে দেশের বৃহত্তম ডিটেনশন সেন্টার চালু হয়ে গিয়েছে। নরেন্দ্র মোদী সে সময় বলেছিলেন বটে যে, এনআরসি নিয়ে তাঁর সরকারের মন্ত্রিসভাতে কখনও আলোচনাই হয়নি। ২০১৯-এর ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর সেই বক্তৃতার চার মাসের মধ্যে তাঁর সরকারই সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে বলেছিল, কারা নাগরিক, কারা নাগরিক নন, তা নির্ধারণ করতে এনআরসি একটি জরুরি প্রক্রিয়া। আবার তার ঠিক এক মাস আগেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সংসদে জানিয়েছিল, এনআরসি তৈরি নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। অথচ, ২০১৯-এ নরেন্দ্র মোদী সরকার দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পরে সংসদের প্রথম যৌথ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির বক্তৃতায় বলা হয়েছিল, কেন্দ্রীয় সরকার এনআরসি প্রক্রিয়া কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনুপ্রবেশের সমস্যায় জর্জরিত এলাকায় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে এনআরসি রূপায়ণ করা হবে।

কে হিন্দু, কে মুসলমান, সে প্রশ্ন পরে। সিএএ, এনআরসি-র মতো বিষয় জাত-ধর্ম নির্বিশেষে কোনও নাগরিককে এক পলকে কলমের খোঁচায় সন্দেহভাজন নাগরিকে পরিণত করে দিতে পারে। তাই এ বিষয়ে অন্তত দেশের সরকারের এক সুরে, এক ভাষায় কথা বলা প্রয়োজন। না হলে সিএএ, এনআরসি নিয়ে দেশে থেকেই দেশহীন হয়ে পড়ার আতঙ্ক থেকেই যাবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement