শিষ্ট: বিধানসভায় বাজেট অধিবেশনের প্রথম দিন বিধায়কদের সঙ্গে রাজ্যপালের সৌজন্য বিনিময়। ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩। ছবি: পিটিআই।
রাজভবন আবার শিরোনামে। কেন্দ্রের মনোনীত নতুন প্রতিনিধির সঙ্গে রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের সম্পর্কের রসায়ন অতঃপর কোন দিকে মোড় নেবে, এখনই নিশ্চিত বলা শক্ত। তবে সুর-তাল কাটার ইঙ্গিত মিলতে শুরু করেছে।
এ কথা মানতেই হবে যে, আজকের দিনে দেশ জুড়ে রাজভবনগুলি কার্যত রাজনৈতিক ঠিকানায় পর্যবসিত। বিশেষ করে বিরোধী-শাসিত রাজ্যগুলির প্রায় সর্বত্র রাজ্যপালরা কেন্দ্রের হাতে যে ভাবে ‘ব্যবহৃত’ হন, তাতে তাঁদের সাংবিধানিক মর্যাদা এবং নিরপেক্ষতা প্রশ্নের মুখে পড়তে বাধ্য।
তবে এই প্রবণতা রাতারাতি তৈরি হয়নি। স্বাধীনতার ঠিক পরে কেন্দ্রে এবং রাজ্যগুলিতে যত দিন কংগ্রেসের একদলীয় শাসন ছিল, তত দিন রাজ্যপালদের কার্যত কোনও ‘সক্রিয়’ ভূমিকাই ছিল না। রাজ্যপাল হয়ে বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত বলেছিলেন, “এ যেন সোনার খাঁচায় থাকা পাখির জীবন!” পট্টভি সীতারামাইয়া মজা করে বলতেন, “সকাল থেকে আমার কাজ শুধু অতিথি আপ্যায়নের বন্দোবস্ত খেয়াল রাখা।” মোদ্দা কথা, রাজ্যপালরা শান্ত, নিরুদ্বেগ সময় কাটাতেন।
পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে অ-কংগ্রেস রাজ্য সরকার গড়ে ওঠার সময় থেকে রাজ্যপালদের ভূমিকা একটু-একটু করে ‘অর্থবহ’ হতে থাকে। কেরলে ইএমএস নাম্বুদ্রিপাদের কমিউনিস্ট সরকার ভাঙা তার প্রথম সোপান। তার পরেই সম্ভবত বাংলা। ষাটের দশকের শেষ দিকে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভাঙার চেষ্টায় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল ধর্মবীরের বিতর্কিত হয়ে ওঠা এই রাজ্যের রাজনীতিতে চরম আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি ঘটনা।
আজও বিভিন্ন বিরোধী রাজ্যে কী ভাবে রাজ্যপালদের ‘কাজে’ লাগানো হচ্ছে, তা কারও অজানা নয়। আর এটাও দেখা যাচ্ছে, দিন এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রের শাসক শ্রেণির আগ্রাসী মনোভাব বেড়েই চলেছে। রাখঢাকের বালাই নেই।
নরেন্দ্র মোদীর আমলের রাজ্যপালেরা প্রকাশ্যেই কার্যত রাজনীতির কুশীলব হয়ে উঠেছেন। কী ভাবে সরকার ভাঙা-গড়ার ‘চক্রান্তে’ খোলাখুলি রাজ্যপালদের প্রত্যক্ষ শরিক করে তোলা হচ্ছে, তার উদাহরণ অজস্র। প্রশ্ন ও বিতর্ক রাজ্যপালদের ‘বাছাই’ করা নিয়েও। রাজ্যপাল পদ পাওয়া ইদানীং যেন এক ‘রাজনৈতিক পুরস্কার’!
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে গিয়েছে যে, ভোট এলে রাজনৈতিক দলগুলির অবস্থা সম্পর্কে আলোচনার পাশাপাশি রাজ্যপালের ‘ভূমিকা’ও এখন সমান্তরাল প্রাধান্য পায়! কোনও বিরোধী রাজ্যে কেউ রাজ্যপাল হলে প্রথমেই চর্চা শুরু হয়, সেখানকার সরকারের পক্ষে এটা কতটা ‘চাপ’-এর হবে!
বাংলার নতুন রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসকে কী ভাবে দেখতে পাওয়া যাবে, তা ভবিষ্যৎ বলবে। কর্মজীবনে দুঁদে আমলা হিসাবে তিনি বহু বড় দায়িত্ব সামলে এসেছেন। আবার কর্মজীবন শেষে নিজের রাজনৈতিক ‘ঝোঁক’ তিনি গোপন করার চেষ্টা করেননি। তাঁকে এই রাজ্যে রাজ্যপাল করে পাঠানোর সঙ্গে সেগুলির যোগ অস্বীকার করা চলে না। তাই হঠাৎ তাঁর কিছু পদক্ষেপ তাঁকে আরও বড় জল্পনার কেন্দ্রে এনে ফেলল। মনে রাখতে হবে, বোস এসেছেন জগদীপ ধনখড়ের উত্তরসূরি হয়ে।
অতীতে অনেক আমলা এখানে রাজ্যপাল হয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করে আসা আইসিএস, আইএএস থেকে দেশের গোয়েন্দা কর্তাদের মতো আইপিএস-রা আছেন সেই তালিকায়। তাঁদের অনেকের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে যুক্তফ্রন্ট এবং বামফ্রন্ট সরকারের বনিবনা হয়নি।
আবার অ-বাম রাজনীতির বৃত্ত থেকে যাঁরা রাজ্যপাল হয়েছেন, তাঁদেরও কয়েক জনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বেধেছে বার বার। কংগ্রেসের শ্রমিক নেতা অনন্তপ্রসাদ শর্মা তাঁদের অন্যতম। তিনি রাজ্যপাল থাকাকালীন রাজভবনকে ‘বয়কট’ পর্যন্ত করা হয়েছে। তিনি চলে যাওয়ার সময় তাঁকে বিদায় জানাতে যাননি মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু।
আবার একনিষ্ঠ গান্ধীবাদী ত্রিভুবননারায়ণ সিংহকে বিদায় জানাতে লাল গোলাপের তোড়া নিয়ে হাওড়া স্টেশনে গিয়েছিলেন জ্যোতিবাবু, প্রমোদ দাশগুপ্ত উভয়েই। স্লোগান উঠেছিল, ‘ত্রিভুবননারায়ণ সিংহ লাল সেলাম’! বিজেপির বীরেন জে শাহ রাজভবনে আসার পরে তাঁর সঙ্গেও জ্যোতিবাবুর সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রথম দফার তিন বছর কাটিয়ে বিনা দ্বন্দ্বে শাহ রাজ্যপালের মেয়াদ শেষ করেছিলেন।
তা বলে ওই রাজ্যপালরা কি কখনও সরকারের কোনও কাজকর্মের বিপক্ষে দিল্লিতে রিপোর্ট পাঠাতেন না? নিশ্চয় পাঠাতেন। প্রাক্তন গোয়েন্দা প্রধান এম কে নারায়ণন, গোপালকৃষ্ণ গান্ধী বা তারও অনেক আগে এ এল ডায়াস, টি ভি রাজেশ্বর, ভৈরব দত্ত পান্ডের মতো রাজ্যপালকে বামেরা তো কোনও দিন ‘বন্ধু’ মনেই করেননি। কিন্তু ওই রাজ্যপালরাও রাজভবনকে খোলাখুলি বিরোধী রাজনীতির আখড়া করে তোলেননি। তাই কারও ক্ষেত্রেই শালীনতা বা সৌজন্যের বেড়া ভাঙেনি। কোথাও একটা মোটা দাগের ভেদরেখা ছিল।
এ পি শর্মার আমলে তৎকালীন কংগ্রেস নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায় মাঝে মাঝে রাজভবনে আড্ডা মারতে যেতেন। দু’চার বার তাঁর সঙ্গী হয়েছি। শর্মা এবং সুব্রতদা একত্রে আইএনটিইউসি করেছিলেন। সেই সব গালগল্প শুনতাম। কখনও মনে হয়নি, শাসক সিপিএম-কে প্যাঁচে ফেলার ছক সাজাতে গিয়েছেন সুব্রতবাবু।
ইদানীং ছবি বদলেছে। বিজেপি নেতারা রাজভবনে গেলে সেটা এখন তাই রীতিমতো রাজনৈতিক চর্চার বিষয়। এতে রাজভবনের ‘অবদান’ অনস্বীকার্য। আরও স্পষ্ট বললে, রাজ্যপাল হিসাবে ধনখড়ের আমলে সেই ধারণা পোক্ত হয়েছে।
বিরোধীরা রাজ্যপালের কাছে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে যাবেন, এটা খুবই ন্যায্য। তা নিয়ে রাজ্যপালের করণীয় অবশ্যই থাকতে পারে। যার পদ্ধতি আছে। কিন্তু রাজভবন যদি সর্বদাই অভিযোগের ভিত্তিতে নির্বাচিত সরকারকে প্রকাশ্যে শাসানি দিতে শুরু করে এবং সমাজমাধ্যমে নিয়মিত ওই ধরনের বক্তব্য প্রকাশ পেতে থাকে, তখন বিষয়টি খুব ন্যায্য থাকে কি? কোনও রাজ্যপাল যদি নিয়মিত সাংবাদিকদের কাছে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে থাকেন এবং বিরোধীদের উৎসাহের উৎস হয়ে ওঠেন, তা-ও কি ‘সঙ্গত’ বলা চলে?
এমনই এক আবহে এখানে রাজ্যপাল হয়ে এসেছেন প্রাক্তন আইএএস অফিসার সি ভি আনন্দ বোস। তিনি মোদীর কতটা ‘ঘনিষ্ঠ’, সেই আলোচনায় কিছু লোকের বাড়তি আগ্রহ থাকতেই পারে। তবে তার চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ কয়েকটি বিষয় রয়েছে। যার অভিঘাত সুদূরপ্রসারী। সেগুলি একটু দেখা যাক।
প্রথমত, বোস বাংলায় ভোট-পরবর্তী হিংসার অভিযোগ সম্পর্কে তদন্তে আসা দলের সদস্য ছিলেন এবং তাঁদের পর্যবেক্ষণ ছিল শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে। এখানে রাজ্যপাল থাকাকালীন ওই হিংসার অভিযোগ নিয়ে যথেষ্ট সরব ছিলেন ধনখড়।
দ্বিতীয়ত, রাজ্যপাল হয়ে এসে মাস তিনেকেই সরকারের অর্থাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বোস এতটা ‘ভাল’ সম্পর্ক তৈরি করেন যে, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তাঁর প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়েছেন। এটা বোসের দিক থেকে একটি অর্থবহ ‘অর্জন’। যার জেরে রাজ্য বিজেপির নেতারা এই রাজ্যপালকে সরিয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি পর্যন্ত দিতে থাকেন। বাজেট অধিবেশনে বোসের বক্তৃতার সময় বিক্ষোভরত বিজেপির মুখে ‘রাজ্যপাল শেম শেম’ শোনা যায়।
তৃতীয়ত, এর পরেই রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি। তৎক্ষণাৎ রাজভবনের বিবৃতিতে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা, দুর্নীতির অভিযোগ থেকে উপাচার্য নিয়োগে অনিয়মের মতো নানা বিষয়ে কড়া ‘বার্তা’ দেওয়া হয়। সরিয়ে দেওয়া হয় রাজ্যপালের সচিব পদে কর্মরত আইএএস-কে। পর দিন বোস দিল্লি গিয়ে দেখা করেন বর্তমান উপরাষ্ট্রপতি ধনখড়ের সঙ্গে।
সকল পদক্ষেপেরই কার্যকারণ ও যুক্তি থাকে। তবে ঘটনাগুলি পর পর গাঁথলে যেন একটি মালা! আর তার মাঝখানের লকেটটি প্রশংসার সেই ‘মণিহার’। সহসা ‘অন্য রকম’ কিছু বলা তাই হয়তো খুব সহজ নয়।
ক্লাইম্যাক্স হল, রাজ্য বিজেপি এখন বলছে, বোস এ বার ‘সঠিক’ পথে ফিরেছেন!