Bangladesh

নতুন দেশের শপথ ও এই শহর

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলায় নিরীহ সাধারণ মানুষের উপর নৃশংস অত্যাচার চালায় যা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে কুখ্যাত।

Advertisement

স্নেহাশিস সুর

শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:৫৬
Share:

—ফাইল চিত্র ।

বা‌ংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে সাধারণত ১৯৭১-এর মার্চ এবং ডিসেম্বর এই মাস দু’টিই সবচেয়ে গুরুত্ব পায়। কিন্তু ওই বছর ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার বৈদ্যনাথতলায়— যা পরে পরিচিত হয় মুজিবনগর হিসাবে— স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে কৌশলগত দিক থেকে এই ঘটনার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

Advertisement

১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে আওয়ামী লীগ বৃহত্তম দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলেও, শেখ মুজিবুর রহমানকে দেশের প্রধানমন্ত্রী না করাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন চলতে থাকে। ১৯৭১-এর মার্চের গোড়া থেকেই তা সার্বিক জন আন্দোলনের চেহারা নেয়। বঙ্গবন্ধু ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ দেন, যেখানে তিনি বলেন, “এ বারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এ বারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। আমাদের কেউ দাবায় রাখতে পারবা না।” এই ভাষণ— যেটি পরে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছিল— ব্যাপক উন্মাদনা ছড়ায়।

২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব বাংলায় নিরীহ সাধারণ মানুষের উপর নৃশংস অত্যাচার চালায় যা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে কুখ্যাত। ওই রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে গিয়ে বহু সংখ্যক নিরস্ত্র ছাত্র, এ ছাড়াও বহু অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবীকে পৈশাচিক ভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু আত্মগোপন করতে রাজি না হওয়ায় ওই রাতেই পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। পরের দিন ২৬ মার্চ প্রচারিত হয় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বাণী। যেখানে তিনি বলেন, “হতে পারে এটা আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।”

Advertisement

অন্য দিকে, ২৫ মার্চ রাতেই বিশিষ্ট নেতা তাজুদ্দিন আহমেদ (ছবিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে) এবং তরুণ ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম রওয়ানা হন ভারতের উদ্দেশে। কঠিন ছিল সে সফর। চুয়াডাঙ্গা হয়ে তাঁরা ভারতে পৌঁছন এবং ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার তাঁদের কলকাতা নিয়ে যান। সেখানে আসেন বিএসএফ-এর প্রধান রুস্তমজি। এর পর তাঁরা বিশেষ সেনা বিমানে দিল্লি যান। উদ্দেশ্য, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে পরামর্শ। ৪ এবং ৫ এপ্রিল ১৯৭১ দু’বার দিল্লিতে তাজুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎ হয়। তাজুদ্দিন সাহেব মুক্তিযুদ্ধে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের সার্বিক সহায়তা চান। দ্বিতীয় দিনের বৈঠকে ঠিক হয় যে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের সরকার গঠিত হবে তা ভারতীয় ভূখণ্ডে অবস্থান করতে পারবে। শুরু হয় সরকার গঠনের উদ্যোগ।

১০ এপ্রিলের ঘোষণায় বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র হিসাবে গঠন করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে কার্যত তাঁকে সমস্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়। এই সঙ্গে ওই একই দিনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেশের প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করেন। ১১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেন। ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী হন দলীয় সম্পাদক তাজুদ্দিন আহমেদ। কিছু আলোচনার পর পররাষ্ট্র মন্ত্রী হন খন্দকার মোস্তাক আহমেদ। তাঁর অবশ্য প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছে ছিল। ঠিক হল শপথ হবে চুয়াডাঙ্গায় ১৪ এপ্রিল। কিন্তু বিষয়টা জানাজানি হয়ে যায় এবং ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী চুয়াডাঙ্গা দখল করে নেয়। পরে বিষয়টি অত্যন্ত গোপন রাখার সিদ্ধান্ত হয়।

ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম এবং আবদুল মান্নান বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ১৬ এপ্রিল কলকাতা প্রেস ক্লাবে যান। সাংবাদিকদের বেশি রাতে খাওয়াদাওয়া করে ক্লাবে সমবেত হতে বলা হয় এবং বাংলাদেশ সংক্রান্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ খবরের জন্য তাঁদের কোথাও নিয়ে যাওয়া হবে বলেও জানানো হয়। মাঝরাতের পর নেতৃবৃন্দকেও গাড়িতে তোলা হয়। তাঁরা সকলেই তখন কলকাতায় থাকেন। প্রেস ক্লাবের সামনে গাড়ি অনেক। গাড়ির চালক বা সাংবাদিকদের ঘুণাক্ষরেও জানানো হয়নি কোথায় কেন যাওয়া হচ্ছে। বিদেশি সাংবাদিকরাও হাজির হয়ে যান। প্রেস ক্লাব থেকে রওনা হয় গাড়ির বহর।

কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে যখন সবাই পৌঁছলেন, তখন ১৭ এপ্রিল সকাল ১১টা। ভারতীয় সেনা দূর থেকে প্রহরারত, রয়েছে মুক্তিবাহিনীর নিরাপত্তা বেষ্টনী। ছোট মঞ্চে তখন উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং অন্য মন্ত্রীরা। উপরাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। পবিত্র কোরান পাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হয় শপথ অনুষ্ঠান। সেখানে তখন হাজার হাজার জনতার উপস্থিতি, কণ্ঠে স্বাধীন বাংলাদেশের স্লোগান। অনুষ্ঠান শেষে সকলে ফিরে আসেন কলকাতায়।

আর এই কলকাতার পাকিস্তানি দূতাবাসই প্রথম, যেখানে পাকিস্তানি ডেপুটি হাই কমিশনার হোসেন আলির নেতৃত্বে ১৮ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য জানানো হয়। এখানেই দেশের বাইরে প্রথাগত ভাবে প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ওড়ে।

এ ভাবে কলকাতা যুক্ত হয়ে পড়ে এক ঐতিহাসিক সরকারের শপথ গ্রহণে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত কলকাতার বিভিন্ন স্থান থেকেই চলত বাংলাদেশ সরকারের কাজ। এখানে স্থাপিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement