জাতিগণনা দূরের কথা, জনগণনার কাজই ক্রমশ পিছিয়ে চলেছে মোদী সরকার। প্রতীকী ছবি।
২০১৮ সালে রাজনাথ সিংহ যখন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ২০২১-এর সেন্সাস বা জনশুমারির সঙ্গে জাতিগণনাও হবে। যার অর্থ, তফসিলি জাতি ও জনজাতিদের সঙ্গে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বা ওবিসি-দের সংখ্যা কত, তাও গুনে বার করা হবে।
সত্যিই তা হলে, মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ মেনে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ ওবিসি-দের জন্য ২৭ শতাংশ আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থার পরে এই প্রথম ওবিসি-দের সংখ্যা জানা যেত। কিন্তু মোদী সরকারের দ্বিতীয় জমানায় রাজনাথ সিংহের বদলে অমিত শাহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বদলের সঙ্গে অবস্থানও বদলে গেল। মোদী সরকার এখন জাতিগণনা করতে নারাজ।
জাতিগণনা দূরের কথা, জনগণনার কাজই ক্রমশ পিছিয়ে চলেছে মোদী সরকার। অতিমারির কারণে জনগণনার কাজে বাধা পড়েছিল। করোনার প্রকোপ কমে আসার পরে সরকারের বাকি সব কাজই চলছে। একমাত্র জনগণনার কাজই শুরু হচ্ছে না। সেই ১৮৮১ সাল থেকে এ দেশে প্রতি দশ বছর অন্তর জনগণনার কাজ হয়। এখন যা পরিস্থিতি তাতে বোঝা যাচ্ছে, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে জনগণনার কাজ হবে না। জনগণনার কাজ শুরুর আগে সমস্ত শহর, গ্রাম, মহকুমার প্রশাসনিক সীমানা বেঁধে ফেলতে হয়। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন রেজিস্ট্রার জেনারেলের দফতর থেকে রাজ্যগুলিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ২০২৩-এর জুন পর্যন্ত তার সময়সীমা বাড়ানো হচ্ছে। প্রশাসনিক সীমানা বেঁধে দেওয়ার তিন মাস পরে জনগণনার কাজ শুরু হয়। প্রথম দফায় পরিবার ও বাড়ির সংখ্যা গোনা হয়। দ্বিতীয় দফায় ওই বাড়িতে কত জন বাস করছেন, তাঁদের সম্পর্কে অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করা হয়। দুই দফায় জনগণনার কাজ করতে অন্তত ১০ থেকে ১১ মাস সময় লাগবে। এ দিকে ২০২৪-এর মে মাসের আগে মার্চ-এপ্রিলে আগামী লোকসভা নির্বাচন সেরে ফেলতে হবে। যার অর্থ হল, কোনও ভাবেই ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে জনগণনার কাজ শেষ হওয়া সম্ভব নয়। লোকসভা নির্বাচনের দোহাই দিয়ে জনগণনার কাজ লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ফলে, অন্তত তিন থেকে চার বছর জনগণনার কাজ পিছিয়ে যাবে। ১৪০ বছরে এই প্রথম ঠিক সময়ে জনগণনা হবে না।
প্রশ্ন হল, শুধুই কি জাতিগণনা? না কি মোদী সরকার লোকসভা ভোট পর্যন্ত জনগণনার কাজ পিছিয়ে দিয়ে আরও অনেক কিছু থেকেই পালাতে চাইছে?
জনগণনা হলে শুধু জনসংখ্যাই জানা যাবে, তা তো নয়। দেশের মানুষের কত জনের খাদ্য সুরক্ষা দরকার, কত জনকে পাকা বাড়ি করতে দিতে হবে, কত জনের বাড়িতে শৌচাগার তৈরি বাকি, কত মানুষের বাড়িতে নলবাহিত পানীয় জল পৌঁছে দিতে হবে, কত বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে হবে, এই সব তথ্যও উঠে আসবে। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে কি মোদী সরকার এই বাস্তবের আয়নার মুখোমুখি হতে চাইছে না?
জাতিগণনা নিয়ে মোদী সরকার তথা বিজেপির অস্বস্তি নতুন নয়। বিহারে নীতীশ কুমার জাতিগণনার কাজ শুরু করে দিয়েছেন। ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র, কর্নাটকের মতো রাজ্যে জনসংখ্যায় ওবিসি-দের অনুপাত অনুযায়ী সংরক্ষণের দাবি উঠছে। বস্তুত বিজেপি ছাড়া এখন সব রাজনৈতিক দলেরই দাবি, জাতিগণনা হোক। জনসংখ্যায় ওবিসি-দের ভাগ কতখানি, তা গুনে দেখা হোক। ২০০৬-এ পরিসংখ্যান মন্ত্রকের নমুনা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, জনসংখ্যায় ওবিসি-দের ভাগ আনুমানিক ৪১ শতাংশ। জাতিগণনায় সত্যিই সেই হিসাব উঠে এলে ওবিসি-রা ২৭ শতাংশের বদলে ৪১ শতাংশ আসন সংরক্ষণের দাবি তুলবেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ওবিসি-দের মসিহা হিসেবে তুলে ধরা বিজেপি কি উচ্চবর্ণের ভাগ কমিয়ে ওবিসি-দের জন্য সরকারি চাকরি-শিক্ষায় আরও আসন সংরক্ষণ করতে পারবে?
কেন্দ্রীয় সরকার তাই এখন বলছে, স্বাধীনতার পর থেকে গত সত্তর বছরে কোনও জনগণনার সময়ই জাতিগণনা হয়নি। অন্য সব বিষয়ে বিজেপি দাবি করে, গত সত্তর বছরে কোনও কাজ হয়নি। মোদী জমানাতেই সব কিছু প্রথম হচ্ছে। কিন্তু জাতিগণনার ক্ষেত্রে মোদী সরকার সত্তর বছরের প্রথা ভাঙতে নারাজ।
২০২৪-এর লোকসভা ভোটকে পাখির চোখ করে মোদী সরকার সম্প্রতি খাদ্য সুরক্ষা আইনের অধীন ৮১ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। আইন অনুযায়ী, গ্রামের ৭৫ শতাংশ ও শহরের ৫০ শতাংশ মানুষকে খাদ্য সুরক্ষা দিতে হবে। দশ বছর আগের জনগণনার হিসাবে এই সংখ্যাটা ৮১ কোটি। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান জনসংখ্যার নিরিখে আরও ১০ কোটি মানুষকে রেশন দিতে হবে। জনগণনা হচ্ছে না বলে তাঁরা বিনামূল্যে রেশন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। মোদী সরকার কি এই বাড়তি বোঝা নিতে চাইছে না? না কি সবাইকে বিনামূল্যে রেশন বিলির কৃতিত্ব খাটো হয়ে যাবে ভেবে ভয় পাচ্ছে?
জনগণনা হলে জানা যাবে, দেশে এই মুহূর্তে কতগুলি পরিবার রয়েছে। কতগুলি বাড়ি রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় মোদী সরকার সকলের জন্য পাকা বাড়ির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সব বাড়িতে নলবাহিত জল পৌঁছে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। সব বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পে সব বাড়িতে শৌচাগার তৈরি করে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে। মোদী সরকার যত বাড়িতে জল, বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে, শৌচাগার তৈরি হয়েছে বলে দাবি করেছে, জনগণনা হলে হয়তো দেখা যেতে পারে, বাস্তবে এ দেশে তার তুলনায় পরিবার বা বাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি। মোদী সরকার কি ভোটের আগে সেই অস্বস্তির মুখোমুখি হতে চাইছে না?
মোদী সরকারের দাবি ছিল, এ বারের জনগণনার সঙ্গে ‘ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার’ (এনপিআর) তৈরির কাজও হবে। এনপিআর হল জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজ়েন্স বা এনআরসি) তৈরির প্রথম ধাপ। সে সময় বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, নয়া নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) ও এনআরসি-এনপিআর তৈরি করে কি মোদী সরকার বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষকে ভারতের স্বাভাবিক অধিবাসীর তালিকার বাইরে রাখতে চাইছে? অসমে নাগরিকপঞ্জি তৈরি করতে গিয়ে সমস্যার মুখে পড়ার পরে মোদী সরকার এখন আর এনপিআর নিয়ে উচ্চবাচ্য করে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এখনও সিএএ-র বিধিনিয়মই তৈরি করে উঠতে পারেনি। জনগণনার কাজে গড়িমসির পিছনে কি এনপিআর নিয়ে দ্বিধাও অন্যতম কারণ?
পরিসংখ্যানের সঙ্গে মোদী সরকারের এই লুকোচুরি নতুন নয়। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে পরিসংখ্যান মন্ত্রকের রিপোর্ট জানিয়েছিল, নোট বাতিলের পরে বেকারত্বের হার ৪৫ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। ভোটের আগে সেই রিপোর্ট ধামাচাপা দিয়ে ভোট মিটতে মোদী সরকার সেই রিপোর্ট প্রকাশ করে। তার পরে কোভিড-পর্বেও মোদী সরকার যখনই অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে পড়েছে, একটাই বাঁধা গতের বুলি শোনা গিয়েছে। তা হল, পরিসংখ্যান নেই। অতিমারিতে কত জন অক্সিজেনের অভাবে মারা গিয়েছেন, লকডাউনে কত জন কাজ হারিয়েছেন, কত জন পরিযায়ী শ্রমিক পায়ে হেঁটে শহর থেকে গ্রামে ফিরতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, সব ক্ষেত্রেই মোদী সরকারের একটাই উত্তর ছিল। এ বিষয়ে সরকারের কাছে পরিসংখ্যান নেই।
দেশের জনসংখ্যা সম্পর্কে যথাযথ পরিসংখ্যান না থাকলে কোনও সরকারের পক্ষেই যথার্থ নীতি নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। কারণ, কত মানুষকে কোন সুবিধা দিতে হবে, সেটাই সরকারের জানা নেই। অতিমারির পরে কোনও রাজ্যে নির্বাচন পিছিয়ে যায়নি। নির্বাচনের প্রচারেও কোথাও সমস্যা হয়নি। নতুন সরকার গঠনেও বাধা আসেনি। ২০২৪-এও নির্ধারিত সময়ে ভোট হবে। নতুন সরকার গঠন হবে। আফসোসের কথা হল, সেই সরকারের হাতে দেশের জনসংখ্যা কত, তার উত্তরটুকুও থাকবে না।