—ফাইল চিত্র।
এই পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ গণতন্ত্রের ইতিহাস লিখতে গিয়ে রামচন্দ্র গুহ তাঁর গাঁধী-উত্তর ভারতবর্ষ নামক বইতে ‘শেষের কথা’ নামক অধ্যায়ে প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী জে বি এস হ্যালডেন-এর কথা উল্লেখ করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে এই মানুষটি লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের চাকরি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন, ষাট বছর পার হওয়া মানুষটি ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। সে সময়ে একটি চিঠিতে উনি লেখেন যে, এক জন নাগরিকের অন্যতম প্রধান কর্তব্য হল, তাঁর রাষ্ট্রের সরকারকে উত্ত্যক্ত করা। আরও লেখেন যে, তৎকালীন ভারত সরকারের একটা গুণ হল, প্রচুর সমালোচনা করার অনুমতি দেওয়া। হ্যালডেন বলেন, তিনি ভারতের নাগরিক হওয়ার জন্য গর্বিত, কেননা এই দেশ, ইউরোপের তুলনায় তো বটেই, এমনকি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েট ইউনিয়ন বা চিনের চেয়েও অনেক বৈচিত্রপূর্ণ, সম্ভাব্য বিশ্ব সংগঠনের মডেল হিসাবে উন্নততর।
দারিদ্র, অনাহার, দেশভাগ, দাঙ্গা, নির্যাতন, বৈষম্যের পরও হ্যালডেনের মন্তব্য বুঝিয়ে দেয়, ভারত সে দিন কেমন অভূতপূর্ব পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল, আর গোটা বিশ্ব তা অবাক চোখে দেখেছিল। মোদী-ভক্তরা ইতিহাসকে বিকৃত করে যতই অপপ্রচার করুন না কেন, ভারত বহু আগেই এক অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। উইনস্টন চার্চিল ভারতের স্বাধীনতা-বিরোধী হিসাবে সুপরিচিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, “ভারতের হাতে শাসনভার ছেড়ে আসাটা হবে অন্যায়, ভারত দেখতে না দেখতে শত শত বছর পিছিয়ে গিয়ে ফিরে যাবে সেই মধ্যযুগের বর্বরতা আর দুঃখ-দুর্দশার যুগে...।” না, তেমন হয়নি। ১৯৬৯ সালে চারটি সাধারণ নির্বাচনের পর ইংরেজ সাংবাদিক জন টেলর ভারতের গণতন্ত্রের বিষয়ে লেখেন, “...এই প্রকাণ্ড দেশটিতে আছে ৫২.৪ কোটি লোক, প্রধান পনেরোটি ভাষা চালু আছে। ধর্মে ধর্মে রয়েছে সংঘাত, রয়েছে নানা জাতবর্ণ। এমন একটি দেশকে মনের মধ্যে ধারণ করাই তো দুঃসাধ্য, অথচ ভারতের মধ্যে কোথায় যেন আছে একটা নমনীয়তা, যা টিকে থাকার একটা নিশ্চয়তা রূপে কাজ করে।” এই নমনীয়তা আমাদের গণতন্ত্রকে লালন করেছে, শত হিংসা ও অসাম্যের মাঝেও বপন করেছে এক সম্পূর্ণতার বীজ। অথচ দেশের মাটি থেকে সেই বীজ উপড়ে ফেলে সেখানে আজ বিদ্বেষ ও বর্বরতার বীজ বপন করছেন বর্তমান শাসক।
২০০২ সালে গুজরাত দাঙ্গার ওই ভয়াবহতার পর আলিগড়ে বক্তৃতা দিতে গিয়ে লেখিকা অরুন্ধতী রায় বিজেপিকে ফ্যাসিস্ট বলে চিহ্নিত করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর জীবন ও চর্যার নিবিষ্ট রচনাকার, বহু সম্মানে ভূষিত রামচন্দ্র গুহ-র মনে হয়েছিল তখন, যে এটা নেহাতই বাড়াবাড়ি। ওঁর মনে হয়েছিল, বিজেপিকে ফ্যাসিস্ট আখ্যা দিলে ইটালি আর জার্মানিতে আদি ফ্যাসিস্টরা যা করেছিল তার তীব্রতা আর ভয়াবহতাকে কমিয়ে দেখা হয়। এর পর আমরা অনেক কিছুর সাক্ষী থেকেছি। দেখেছি, কী ভাবে হিংস্র সাম্প্রদায়িকতা ও বিভাজনের বিষবাষ্প আচ্ছন্ন করেছে আমাদের মস্তিষ্ক। এই ২০ এপ্রিল দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এই রামচন্দ্র গুহ-ই তাঁর একটি কলামে লিখেছেন, ১৯৭৭ সালের পর এই সাধারণ নির্বাচন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হতে চলেছে। তাঁর ভাষায়, নরেন্দ্র মোদী স্বৈরতান্ত্রিক মতবাদের পাশাপাশি তাঁর শাসনকালে যুক্ত করেছেন হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠবাদের মিথ্যে অহং, যা বিষিয়ে দিয়েছে মানুষের বিবেচনা ও হৃদয়।
এমনই এক গভীর সঙ্কটের মুখোমুখি আমরা। একই আশঙ্কা শোনা যাচ্ছে গোটা দেশ জুড়ে। সাধারণ মানুষ, যাঁরা নিজেদের প্রতি দিনের জীবনযাপনের অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারছেন নরেন্দ্র মোদীর এবং ভারতীয় জনতা পার্টির নির্বাচনী সঙ্কল্পপত্র ভাঁওতা ছাড়া আর কিছু নয়। তাঁরাও কী ভাবে ভেসে চলেছেন এক গোয়েবলসীয় প্রচারের স্রোতে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সমাজকর্মী যোগেন্দ্র যাদবের বয়ানে আছে এক বিচিত্র কথোপকথন:
‘কেমন চলছে?’ ‘খুব খারাপ।’
‘রোজগারপাতি?’ ‘কিছু হচ্ছে না, বাবু।’
‘ছেলেমেয়ের লেখাপড়া, চাকরি?’ ‘কোথায় কী? কিচ্ছু নেই। রোজকার জিনিসের দাম যা, কী করে সংসার চলবে বুঝতে পারছি না।’
‘আপনার গ্রামের হাল?’ ‘একই রকম, বাবু, সবার হাল খারাপ।’
‘দেশের খবর রাখেন?’ (এই বার মানুষটির চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল) ‘দেশ এগিয়ে চলছে, বাবু। খুব উন্নতি হচ্ছে। সবাই তো তা-ই বলছে।’
মানুষ বুঝছেন, তিনি ও তাঁরা ভাল নেই, তবু ‘অচ্ছে দিন’-এর মগজধোলাই যন্ত্রে পড়ে তিনি ভাবছেন, দেশের উন্নতি হচ্ছে। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় জানা গেছে (দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং আর্থিক ভাবে বলশালী টেলিভিশন চ্যানেলগুলি যে কথাগুলো আমাদের জানায় না), ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজ়েশন (আইএলও) বা ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান ডেভলপমেন্ট (আইএইচডি) জানিয়েছে, এ দেশের কাজ না পাওয়া জনতার ৮৩% নবীন প্রজন্মের। প্রধানমন্ত্রী যখন রামনবমীতে আমিষ খাওয়া-কে ‘মোগল মানসিকতা’ বলে আক্রমণ করছেন, তখন অন্য দিকে পুষ্টির অভাবে ধুঁকতে থাকা শিশুদের সংখ্যাটি ভয়াবহ। আমিষ-নিরামিষের তর্ক অনেক পরের কথা— তাদের পাতে কিছুই জোটে না, তারা ‘জ়িরো ফুড চিলড্রেন’।
টেলিভিশনের বিতর্কে এ সব প্রসঙ্গ ওঠে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি— ওঠে না। জানা গেছে ছ’টি প্রধান চ্যানেলের ৪২৯টি অনুষ্ঠানের মধ্যে ২২৪টি অনুষ্ঠান হয়েছে দেশের বিরোধী দলগুলিকে আক্রমণ করে, ১১৬টি অনুষ্ঠানে হয়েছে মোদী-বন্দনা, ২৪টি হয়েছে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে উস্কানিমূলক প্রচার, ছ’টি কেন্দ্রীয় সরকার-বিরোধী এবং মাত্র একটি বা দু’টি কর্মসংস্থান বা বেকারত্ব নিয়ে। লক্ষণীয়, নির্বাচনী বন্ডের সাঙ্ঘাতিক দুর্নীতির কথা গণমাধ্যম পৌঁছতেই দিল না মানুষের মধ্যে।
খুব স্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের মাত্রাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমালোচনা, আন্দোলন বাম-কংগ্রেস করতেই পারে, কিন্তু বিজেপি তা করে কোন মুখে? ২০১৪ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত যে পঁচিশ জন নেতার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সংস্থা তদন্ত শুরু করেছিল, সেই সবাইকে বিজেপি আপন করে নিয়েছে। তাঁরা শুধু বিজেপিতে যোগদানই করেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে চলা সমস্ত তদন্ত প্রত্যাহারও করা হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতি, গুন্ডাবাজি, অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে মানুষ গর্জে উঠবেন, কিন্তু রাতারাতি ‘ঈশ্বর’ হয়ে ওঠা এক প্রাক্তন বিচারপতি তৃণমূলের চুরির বিরুদ্ধে গিয়ে আরও বড় চোর বিজেপিতে যোগদান করলে সেটা তাঁরা মেনে নেবেন কি? গান্ধী না গডসে, বেছে নিতে যাঁকে ভাবতে হয়, এবং উত্তর না পেয়েও যাঁকে বলতে হয়, ‘পরে বলব’, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না এঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ শুধু ভুল তা-ই নয়, ভয়ঙ্কর।
বিজেপির নেতা-নেত্রীদের এই দ্বিচারিতা এবং যে কোনও ভাবে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার লোভের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ অবশ্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই। গোটা বিশ্ব যে কারণে আমাদের সম্মান করে, সেই সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়েছে তাঁর আমলে। প্রথম দফার নির্বাচনের পর ‘চারশো পার’ হওয়ার স্বপ্নে সামান্য আঁচড় পড়তেই উনি এবং ওঁর দল ফিরে গেছেন দেশের সংখ্যালঘু মানুষদের বেলাগাম আক্রমণ করার নিকৃষ্ট রাজনীতিতে। দেশের মানুষ কি মেনে নেবেন এমন বিভেদকামী, বৈষম্যমূলক রাজনৈতিক ভাষ্য?
প্রধানমন্ত্রী মোদী এখনও তুমুল জনপ্রিয়, কিন্তু অপ্রতিরোধ্য নন। ২০১৪ কিংবা ২০১৯-এর মোদী-ম্যাজিক আজ বহু প্রশ্নের মুখে। মানুষ তাঁদের দৈনন্দিন জীবনযন্ত্রণার আঘাতে অবসন্ন। সমস্যা হচ্ছে দেশের বিরোধী দলগুলি শুধু যে ঐক্যবদ্ধ নয় তা-ই নয়, তারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে বিভ্রান্ত। সর্বভারতীয় স্তরে বিরোধী জোট তৈরির সময় তাঁরা বার্তা দিয়েছিলেন যে, বিজেপি ক্ষমতায় ফিরে আসা মানে দেশের সংবিধান, ইতিহাস সমস্ত কিছুকেই গভীর খাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া। বিজেপি যদি প্রধান শত্রু না হয়, তা হলে এই জোট মূল্যহীন। অথচ এরই মধ্যে দেখা গেল, কেরলের ওয়েনাড় কেন্দ্রে সিপিআই প্রার্থী অ্যানি রাজা এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, এ বার বিজেপি ফিরে এলে গণতন্ত্র বলে আর কিছু থাকবে না। অন্য দিকে, রাহুল গান্ধী একই বিপদের সম্ভাবনা আশঙ্কা করেও জনসভায় বলছেন, কেরলের মুখ্যমন্ত্রী সিপিআই(এম)-এর নেতা পিনারাই বিজয়ন তলে তলে বিজেপির সহযোগী এবং অবিলম্বে তাঁকে গ্রেফতার করা উচিত। বিজেপিকে প্রধান বিপদ হিসাবে চিহ্নিত করেও মাঠে নেমে এই যে বিভ্রান্তি, তার মাসুল শুধু যে বিরোধী জোটকে দিতে হবে তা-ই নয়, বিজেপি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জমতে থাকা ক্ষোভের আগুনেও জল ঢেলে দেওয়া হবে।