প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
কোনও পরিস্থিতি, কার্যসূচি বা নয়া উদ্যোগে যদি কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের যথার্থ স্বার্থ থাকে, তা হলে তাকে বলা হয় ‘স্টেকহোল্ডার’। রাজ্য সরকারের নতুন শিক্ষানীতি উল্টে-পাল্টে দেখতে গিয়ে মনে প্রশ্ন উঠল, শিক্ষার ‘স্টেকহোল্ডার’ কারা? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ভালমন্দের সঙ্গে যাঁদের স্বার্থ নিবিড় ভাবে জড়িত, তাঁরা হলেন ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, অভিভাবক এবং ব্যবস্থাপক। শেষের গোষ্ঠীটির মধ্যে শিক্ষা দফতরের আধিকারিকরা যেমন আছেন, তেমনই আছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা রাজনৈতিক নেতা, যাঁরা বিদ্যালয় বা কলেজগুলি পরিচালনা করেন। অথচ, রাজ্যের শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার সময় হোক, কিংবা স্কুল-কলেজের পরিচালনা সংক্রান্ত মিটিং, যারা প্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ‘স্টেকহোল্ডার,’ সেই ছাত্রছাত্রীদের মতামত কোথাও শোনা হয় না। কলেজগুলির পরিচালনা সংক্রান্ত ব্যাপারে ছাত্র-সংসদের প্রতিনিধিত্ব ছিল বটে, তবে এখন তা অনেকটাই কাগজ-কলমে। অধিকাংশ সময়ে সেই ছাত্র-প্রতিনিধিরা স্থানীয় রাজনীতির কারবারিদেরই মুখপাত্র।
চিরকালই আমাদের দেশে ছাত্রছাত্রীদের নিছক প্রজা হিসাবেই গণ্য করা হয়ে এসেছে, আর বাকি তিনটি পক্ষ বসে থেকেছে তাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে। প্রায় দুই দশকের স্কুল-শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় দেখে আসছি, প্রতিটি অভিভাবক সভাতে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি ব্যতিরেকেই শিক্ষক-অভিভাবকরা যৌথ ভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন যে, আইন যা-ই বলুক না কেন, বিদ্যালয়ে নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে গেলে, এবং ছেলেমেয়েদের থেকে পড়া আদায় করতে হলে, একটু-আধটু মারধর করতেই হবে।
যে রাজা রাজ্য পরিচালনা সংক্রান্ত ব্যাপারে প্রজাদের মতামতের তোয়াক্কা করেন না, তাঁর বিরুদ্ধে প্রজারা এক দিন বিদ্রোহ করবেই। সেই বিদ্রোহ কিন্তু শুরু হয়ে গেছে ভিতরে ভিতরে। বিদ্যালয়-স্তরের কম-বেশি সমস্ত শিক্ষকই একমত হবেন যে, বছর কয়েক ধরে ছাত্রছাত্রীদের আচরণে কিছু গুরুতর পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। তারা যেন আর ততটা অনুগত এবং শ্রদ্ধাশীল নেই— মুখে মুখে তর্ক করা, অনুশাসন বা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা, অথবা শিক্ষকদের উপদেশ হেসে উড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা ক্রমবর্ধমান।
গোটা শিক্ষাব্যবস্থার উপরেই আস্থা উঠে যাওয়ার কিছু কিছু দুর্লক্ষণও কি প্রকট নয়? রাজ্য জুড়ে কলেজগুলোতে এ বছর বিভিন্ন ‘অ্যাকাডেমিক’ বিষয়ে অধিকাংশ আসন খালি থাকাই তার প্রমাণ। ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। অন্য দিকে, অতীতে যে সমস্ত নন-অ্যাকাডেমিক বিষয় তোলা থাকত তথাকথিত ‘পিছিয়ে পড়া’ ছাত্রছাত্রীদের জন্য, ভিড় বাড়ছে সেখানে। যেমন নার্সিং, আইটিআই, পলিটেকনিক, প্যারামেডিক্যাল ইত্যাদি। রাজ্যে কর্মসংস্থান নেই, শিক্ষান্তে আয়ের নিশ্চয়তা নেই, উচ্চশিক্ষায় গিয়ে বৃত্তি লাভ করে গবেষণা ইত্যাদির সুযোগও ক্রমে সীমিত হয়ে আসছে। ছেলেমেয়েরা তা হলে পড়াশোনা করবে কেন? শিক্ষান্তে একটা সম্মানজনক কাজ জোগাড় করতে না পারা কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থারই অপমান।
সময় এসেছে ছাত্রছাত্রীদের মুখোমুখি বসার। অন্তত ক্লাস এইট-নাইন থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন স্তরের সমস্ত ছাত্রছাত্রীরই অভাব-অভিযোগ এবং দাবি-দাওয়াগুলি মন দিয়ে শুনতে হবে। পাশাপাশি কর্তৃপক্ষের তরফে গৃহীত প্রতিটি সিদ্ধান্তের কার্য-কারণও তাদের কাছে খুব স্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। কারণ, গত পাঁচ-সাত বছরে মোবাইলের কল্যাণে সমাজমাধ্যমে ঘোরাফেরার সূত্রে তাদের মনোজগতে বিপুল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। অনেক বেশি আত্মসচেতন এবং সমাজসচেতন, দুই-ই হয়ে উঠেছে তারা। সোজা কথা সোজা ভাবে বলতে শিখেছে।
ছাত্রছাত্রীদের অন্দরমহলে কান-পাতলে শোনা যাবে: “স্কুলে আসা মানে তো গোটা দিনটা নষ্ট, আটটা ক্লাসের মধ্যে তিনটে হবে না। হয় স্যর-ম্যাডাম অনুপস্থিত, নয়তো অন্য কাজে ব্যস্ত।” কিংবা “স্কুলের ক্লাস করে কী হবে, ইউটিউবে তার থেকে অনেক ভাল ভাবে বিষয়গুলো বোঝানো হয়।” অর্থাৎ, এক দিকে যেমন শিক্ষাদান পদ্ধতির ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে তারা অবহিত, অন্য দিকে ব্যবস্থাটার পরিচালনার গলদগুলি সম্পর্কে তারা যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। তা হলে কেন তাদের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মূল্যায়ন করার সুযোগ দেওয়া হবে না? আর কেনই বা শিক্ষা-নিয়ামকেরা তাদের সঙ্গে কথা বলে, ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলি শুধরে নেওয়ার প্রয়াস করবেন না নতুন শিক্ষানীতিতে? শিক্ষাও কিন্তু একটি পরিষেবা, এবং ছাত্রছাত্রীরা সেই ব্যবস্থার হকদার। সেই পরিষেবায় গলদ থাকলে ছাত্রছাত্রীরা আগে চুপচাপ মেনে নিত, ইদানীং তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে।
রাজ্যের প্রত্যন্ততম গ্রামের স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ স্তরের শিক্ষানীতি প্রণেতা, সকলেরই জেনে রাখা দরকার যে, মূল্যায়ন শুধুমাত্র ছাত্রছাত্রীদেরই হয় না, তাঁদেরও হয়ে চলে, প্রতিনিয়ত। আর সেই গোপন মূল্যায়ন ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে— অজস্র গ্রুপে পোস্ট হয় মিম, মন্তব্যের আকারে। এ ভাবেই কিন্তু জনমত তৈরি হয়। সেই দেওয়াল লিখনগুলি যদি আমরা পড়তে না শিখি, বিপদ আমাদেরই।