সংসদের নতুন ভবন আর সংবিধানের ক্রমবর্ধমান সঙ্কট
Special Session of Parliament

দেখি নাই কভু...

বিশেষ অধিবেশনের প্রাক্-মুহূর্তে কথা ছিল সরকারপক্ষ আটটি বিল নিয়ে আসবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই আটটি বিলের একটিরও দর্শন পাওয়া গেল না। চলে এল মহিলা সংরক্ষণ বিল।

Advertisement

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৩ অক্টোবর ২০২৩ ০৪:৩৩
Share:

অভিনন্দন: নারীশক্তি বন্দন বিল পাশ হওয়ার পরে বিজেপি অফিসে প্রধানমন্ত্রী মোদী, ২২ সেপ্টেম্বর। ছবি: পিটিআই।

সংসদের আকস্মিক বিশেষ অধিবেশন অবশেষে নির্ধারিত সময়ের এক দিন আগেই শেষ করে দেওয়া হল। মুম্বইয়ে ইন্ডিয়া জোটের বৈঠক শুরুর ঠিক প্রাক্কালে সহসা এই বিশেষ অধিবেশনের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই দেশ জুড়ে নানাবিধ জল্পনা শুরু হল। হয়তো এই জল্পনার বাজার গরম রাখাটাও সরকারের অন্যতম উদ্দেশ্যের মধ্যেই পড়ে। নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে, বর্তমান সরকার ততই যুদ্ধকালীন তৎপরতার সঙ্গে চমক সৃষ্টি করতে থাকবে এটাই তো প্রত্যাশিত।

Advertisement

বিশেষ অধিবেশনের প্রাক্-মুহূর্তে কথা ছিল সরকারপক্ষ আটটি বিল নিয়ে আসবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই আটটি বিলের একটিরও দর্শন পাওয়া গেল না। চলে এল মহিলা সংরক্ষণ বিল। কিন্তু অমৃতকালে সেঙ্গল-শোভিত সংসদে কি আর এ রকম সাদামাটা নাম চলে? তাই বিলের নাম হল নারীশক্তি বন্দন অধিনিয়ম, যা শোনায় দৈববাণীর মতো। আর বিল পাশ হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদী তো বলেই দিয়েছেন যে, এই সব ভাল কাজ সম্পন্ন করার জন্যই ভগবান তাঁকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। সুধী পাঠক নিশ্চয়ই খেয়াল করছেন যে, অধিকারসম্পন্ন নাগরিককে অনুগত ভক্ত প্রজায় পরিণত করতে এক দিকে সংসদ রাজদরবারে রূপান্তরিত হচ্ছে, অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠছেন ঈশ্বরের বরপুত্র।

পাঠক হয়তো বলবেন নামে কী যায় আসে। এত বছর ধরে পড়ে থাকা একটা বিলকে আইনে পরিণত করাটাই কি যথেষ্ট নয়? এ বিলকে আইনে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি কিন্তু বিজেপি দীর্ঘ দিন ধরেই দিয়ে এসেছে, আর আইনে পরিণত করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতাও মোদী সরকারের শুরু থেকেই রয়েছে। ২০১৯-এ দ্বিতীয় বার ক্ষমতা হাতে আসতেই কাশ্মীরের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হল, নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে দেওয়া হল, কোভিডকালে ঝড়ের গতিতে তিন-তিনটে কৃষি আইন বানিয়ে ফেলা হল। মহিলাদের জন্য সংসদে আসন সংরক্ষণের প্রশ্নটি কি তা হলে কোনও জ্যোতিষীর পরামর্শে নতুন সংসদ ভবনে গৃহপ্রবেশের অপেক্ষায় তুলে রাখা হয়েছিল?

Advertisement

প্রশ্ন হল, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর যখন বিল পাশ হচ্ছে তখন তাকে বাস্তবায়িত করতে আবার দীর্ঘ প্রতীক্ষা কেন? আমরা সবাই জানি, যে কোনও জনগণনাতেই দেখা যাবে নারীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার অর্ধেক। আর তেত্রিশ শতাংশ সংরক্ষণের মানে হল মোট আসনসংখ্যা যা-ই হোক না কেন তার এক-তৃতীয়াংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। তা হলে আগামী নির্বাচনেই এই নীতি প্রয়োগ করার পরিবর্তে পরবর্তী জনগণনা ও আরও জটিল ও সময়সাপেক্ষ ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করা কেন? ন্যায়সঙ্গত ভাবেই প্রশ্ন এটাও উঠেছে লোকসভার পাশাপাশি রাজ্যসভাতেও সংরক্ষণ চাই।

সবচেয়ে জোরের সঙ্গে যে প্রশ্ন উঠে এসেছে তা হল ভারতীয় সমাজের চরিত্র অনুযায়ী দলিত, জনজাতি, ওবিসি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলাদের প্রতিনিধিত্বের নিশ্চয়তা থাকা দরকার। অর্থাৎ, সংরক্ষণের ভিতর সংরক্ষণ। দলিত এবং জনজাতিদের জন্য কিছু আসন সংরক্ষিত আছে বলে তার এক-তৃতীয়াংশের সুবাদে দলিত ও জনজাতি মহিলাদের আংশিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা হলেও অন্যদের জন্য কোনও ব্যবস্থা বিলে নেই। পঞ্চায়েতে কিন্তু অনেক রাজ্যেই ওবিসি বা ইবিসি (অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া জাতি) সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে। মহিলা সংরক্ষণের জন্য যখন এক বার সংবিধান সংশোধন করতেই হচ্ছে তখন একই সঙ্গে ওবিসি ও অন্যান্য বঞ্চিত অংশের প্রতিনিধিত্বের নিশ্চয়তা প্রদান করাই বাঞ্ছনীয়।

এই বিতর্ক ও দাবি নিয়েই সংসদের উভয় কক্ষেই বলতে গেলে সর্বসম্মতিক্রমে বিল পাশ হয়ে গেছে। চার দশক ধরে সমাজবাদী সাংসদ প্রমীলা দন্ডবতে ও কমিউনিস্ট সাংসদ গীতা মুখোপাধ্যায়দের প্রজন্মের জোরালো উদ্যোগ এবং সংসদের বাইরে সমাজে ও রাস্তায় ধারাবাহিক মহিলা আন্দোলনের চাপের ফসল আজকের এই বিলম্বিত, অসম্পূর্ণ ও কিঞ্চিৎ অনিশ্চিত বিল। স্বাধীনতা আন্দোলনের পর্যায়ে ক্রিপস মিশনের ডোমিনিয়ন স্টেটাস প্রস্তাবকে গান্ধী ‘পোস্ট-ডেটেড চেক’ আখ্যা দিয়েছিলেন। আজকের বাজারযুগের শব্দাবলি অনুযায়ী অনেকে এই বিলকে ‘ফরওয়ার্ড ট্রেডিং’ বা অনাগত প্রতিশ্রুতির আগাম কারবার হিসাবেও চিহ্নিত করছেন। তবুও বলব মহিলা সংরক্ষণ ভারতের পুরুষ-আধিপত্যের কাঠামোতে এক জরুরি আঁচড়।

দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। নব্বই বছর আগের জনগণনা অনুযায়ী অবিভক্ত ভারতের বাহান্ন শতাংশ জনসংখ্যা পিছিয়ে পড়া জাতি বা ওবিসি। অর্থাৎ মোটামুটি নারী সমাজ এবং ওবিসি সমাজের অনুপাত একই রকম। তবে ১৯৩১ সালের পর থেকে জাতিভিত্তিক জনগণনা আর হয়নি। অথচ ভারতে সংরক্ষণের মূল ভিত্তি হল জাতি— শিক্ষা ও সামাজিক বিচারে পিছিয়ে পড়া বর্গ। ২০১১ সালে জাতিগত পরিসংখ্যান সংগৃহীত হলেও তা প্রকাশ হয়নি। আর ২০২১ সালের জনগণনা কবে হবে তা এখনও আমরা জানি না। তাই গোটা দেশ জুড়ে জোরালো দাবি উঠেছে দ্রুত জাতিভিত্তিক জনগণনা সম্পন্ন হোক, যাতে সংরক্ষণ নীতির বিন্যাস সঠিক পরিসংখ্যানগত ভিত্তিতে হতে পারে।

বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের সরকার যখন মণ্ডল কমিশনের কিছু সুপারিশকে বাস্তবায়িত করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন দেশ জুড়ে সংরক্ষণ বিরোধী একটা জিগির তোলার চেষ্টা হয়েছিল। মাঝে-মাঝেই এই জিগির আজও শোনা যায়। মহিলা সংরক্ষণ এই সংরক্ষণ বিরোধী সঙ্কীর্ণতার বিরুদ্ধে এক জোরালো প্রত্যাঘাত। অতীতে ওবিসি সংরক্ষণের প্রশ্নে মহিলা সংরক্ষণের বিল সংসদে কয়েক বার আটকে গেলেও এ বার সামাজিক ন্যায় শিবিরের কেউ ‘ওবিসি সংরক্ষণ না হওয়া পর্যন্ত মহিলা সংরক্ষণ মানছি না’ এই অবস্থান গ্রহণ করেননি। এটা তাঁদের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা। সংরক্ষণের মূল ভিত্তি অর্থাৎ সামাজিক অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠার নীতিকে নস্যাৎ করার চেষ্টা হলে তা কিন্তু হবে নতুন এক অন্যায়।

সামাজিক ন্যায়ের অবধারণা সঙ্কুচিত হতে-হতে আজ চালু ভাষায় তার অর্থ দাঁড়িয়েছে ‘সোশ্যাল এঞ্জিনিয়ারিং’। এই সঙ্কটকালে মহিলা সংরক্ষণকে সামাজিক ন্যায়ের অঙ্গ হিসাবে দেখতে পারলে যুগপৎ জাতি এবং লিঙ্গের সম্মিলিত ভিত্তিতে এক সমৃদ্ধ সামাজিক ন্যায়ের ধারণা ও অনুশীলনে পৌঁছনো সম্ভব। একই সঙ্গে আজ প্রয়োজন সামাজিক ন্যায় ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে একযোগে দেখা। ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংখ্যালঘু-তোষণ হিসাবে চিহ্নিত করে সঙ্ঘবাহিনী সর্বত্র জোর করে সংখ্যাগুরুর আধিপত্য চাপিয়ে দিতে চায়। আর এর ফলে আজ দেশের সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক কাঠামো কী ভাবে প্রহসনে পরিণত হতে চলেছে তার উদাহরণ আমরা দেখলাম সংসদের এই বিশেষ অধিবেশনেই। দক্ষিণ দিল্লি দেশের অন্যতম সম্ভ্রান্ত সংসদীয় কেন্দ্র। সেই কেন্দ্রের বিজেপি সাংসদের মুখে শোনা গেল এক জন মুসলিম সাংসদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও অপমানের ভাষা। আর ক্যামেরার সামনে এক বার বা দু’বার নয়, প্রায় দশ বার যখন সেই ভাষা উচ্চারিত হয় তখন সাংসদ রমেশ বিধুরির ঠিক পিছনে বসে সমর্থনের হাসি হাসছিলেন দু’জন বড় মাপের বিজেপি নেতা, প্রাক্তন বিজ্ঞান-বিষয়ক মন্ত্রী হর্ষবর্ধন এবং প্রাক্তন আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ। অপমানিত বিএসপি সাংসদ দানিশ আলি সঠিক ভাবেই প্রশ্ন করেছেন, সংসদের ভিতরে এক জন নির্বাচিত মুসলিম প্রতিনিধিকে যদি এই অপমান ও আক্রমণ সহ্য করতে হয়, তা হলে দেশের সাধারণ মুসলিম নাগরিক কোথায় যাবে।

স্বাধীনতা, সাম্য ও বন্ধুত্বের উপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সংবিধান। অথচ এ বারের স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে নরেন্দ্র মোদী বললেন সামাজিক ন্যায়ের সবচেয়ে বড় শত্রু নাকি সংখ্যালঘু তোষণ। ইশারা অত্যন্ত স্পষ্ট, সংবিধানকে নস্যাৎ করে সামাজিক ন্যায়কে তিনি মিশিয়ে দিতে চান মুসলিমবিদ্বেষের রাজনীতিতে। আম্বেডকর চেয়েছিলেন সংবিধান সব ধরনের বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াক। কেউ যেন ভাষা ও ধর্মের বিচারে সংখ্যালঘু হিসাবে বিপন্ন না হয়, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য যেন মহিলাদের অগ্রগতির পথ আটকাতে না পারে, দলিত-জনজাতি-ওবিসি সমাজ যেন স্বাধীন নাগরিক হিসাবে এগিয়ে আসতে পারে।

নতুন সংসদের বিশেষ অধিবেশন বুঝিয়ে দিল এই সংবিধান আজ কতটা বিপন্ন। সংরক্ষণ বা অন্য যে কোনও অধিকার অর্জন করতে হলে সংবিধানকে বিপদ-মুক্ত করতেই হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement