ম্যাটিল্ডার বর্ণনায় সিঁদুরের এমন রক্তাক্ত রূপ দেখে বড় একটা শিক্ষা পাওয়া গেল। প্রতীকী ছবি।
এই তো, ম্যাটিল্ডাকেই দেখো না কেন। কেমন সিঁথি ভরে সিঁদুর পরেছে। ওর ইচ্ছে, ও পরেছে। এটাই তো আসল কথা, যার যা ইচ্ছে সে তা-ই পরবে।” মানুষের উপর সমাজ ও রাষ্ট্রের আচরণবিধি চাপিয়ে দেওয়া নিয়ে বক্তৃতায় জব্বর উদাহরণটা দিতে পেরে বেশ শ্লাঘা হল। বিবাহিতা মেয়েদের মধ্যে সিঁদুর পরার যে-রীতি আমাদের দেশের অনেক গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের মেয়েদের মধ্যে আছে, সাঁওতাল মেয়েদের মধ্যে, এবং বিশেষ করে খ্রিস্টধর্মী সাঁওতাল মেয়েদের মধ্যে সেটা সাধারণত দেখা যায় না। কিন্তু ম্যাটিল্ডা সাঁওতাল ও খ্রিস্টধর্মী হওয়া সত্ত্বেও তার সিঁথিতে বিবাহচিহ্ন হিসেবে সিঁদুরের প্রলেপ। শ্লাঘা বিষম বস্তু, বাড়তেই থাকে। অতএব, নিজের মহত্ত্ব প্রদর্শনে আরও যোগ করা গেল, “ব্যক্তিগত ভাবে আমি যদিও বিবাহিতা মেয়েদের সিঁদুর পরা প্রথার বিরোধী, কারণ এটা একটা বন্ধনচিহ্ন— কিন্তু, ম্যাটিল্ডা যদি মনে করে যে, সে সিঁদুর পরবে, তা হলে সে অবশ্যই পরবে। এখানে তার পছন্দটাই শেষ কথা।”
বক্তৃতার পর, এক অবকাশে, ম্যাটিল্ডা আমার কাছে এল: “আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল।” হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, কী কথা? খুব উৎসাহ দেখিয়ে বললাম। উৎসাহের কারণ আর কিছু না, শ্লাঘা থেকে উঠে আসা প্রত্যাশা, আমার বক্তৃতা নিয়ে প্রশংসা শোনার। সেটা সে অবশ্যই করল, খুবই ভদ্র তার আচরণ। কিন্তু, প্রশংসার সঙ্গে বিনীত ভাবে যেটা যোগ করল, তার জন্য আমি আদৌ তৈরি ছিলাম না: “স্যর, আপনি আপনার বক্তৃতায় আমার উদাহরণটা না দিলেই পারতেন। আমার ওটা ভাল লাগেনি।” কেন, কেন, কী ব্যাপার? আই অ্যাম ভেরি সরি, যদি তোমার খারাপ লেগে থাকে। কিন্তু, কেন খারাপ লেগেছে, যদি বলো। “মিটিং-এর মধ্যে আপনি বলে দিলেন, সিঁদুরটা আমি নিজের ইচ্ছায় পরেছি। বাকিরাও তাই ভাববে। হয়তো ভাববে, আমি হিন্দু মেয়েদের মতো নিজেকে দেখাতে চাই। কিংবা, খ্রিস্টান পরিচয় গোপন রাখতে চাই। জানেনই তো আমাদের অঞ্চলে ইশাই সাঁওতাল আর সারনা সাঁওতালদের মধ্যে রেষারেষি আছে।… আমার সিঁদুর পরার কারণটা কিন্তু একেবারে আলাদা। কাজের জন্য শহর বাজারে আসতে হয়। কখনও একা একা পথে ঘাটে ঘুরে বেড়াতে হয়। সেই সময় সিঁদুরটা হচ্ছে আমার রক্ষক। পুরুষরা ছোঁক ছোঁক করতে আসে না।… জানেন স্যর, পুরুষদের কাছে মেয়েদের কোনও জাত-ধর্ম থাকে না, সবাই মেয়ে, তার মধ্যে যাদের বিয়ে হয়ে গেছে তাদের উপর ছোঁকছোঁকানিটা একটু কম।”
ম্যাটিল্ডার বর্ণনায় সিঁদুরের এমন রক্তাক্ত রূপ দেখে বড় একটা শিক্ষা পাওয়া গেল। জনপরিসরে কথা বলার ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার চেষ্টা করলাম। হায়, সতর্কতা এক জিনিস, আর শিক্ষা অন্য এক। আর তাই বার বার ‘শিক্ষা’ পেতে হয়। এই যেমন, এক দল সদ্য চাকরিতে ঢোকা ছেলেমেয়েদের জনজাতিদের সমস্যা নিয়ে জ্ঞান দেওয়ার জন্য আমাকে ডাকা হয়েছিল। তাদের মধ্যেই এক জন ছিল ভরত তিরকে, উত্তরবঙ্গের ছেলে, ওরাওঁ জনজাতি গোষ্ঠীভুক্ত। ওর পূর্বজদের একদা ছোটনাগপুর অঞ্চল থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল উত্তরবঙ্গ ও অসমে চা-বাগানের মজুর হিসেবে। ওরাওঁ এবং সাঁওতাল, মুন্ডা, হো, মাহালি, প্রভৃতি ঝাড়খণ্ড সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র থেকে যাওয়া জনজাতিরা পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, ও ত্রিপুরাতে তফসিলি জনজাতি তালিকাভুক্ত হলেও, আমাদের বিচিত্র ব্যবস্থার কারণে, অসমে তা নন। সমস্যাটা বোঝাতে বললাম, “কী আশ্চর্য ব্যাপার, এই যে ভরত, ও যদি জলপাইগুড়ির চা বাগানে না জন্মে, একটু দূরে অসমের কোনও চা-বাগানে জন্মাত তা হলেই ও এসটি তালিকাভুক্ত হত না।” একেবারে হাতে-গরম উদাহরণটা দিতে পেরে যারপরনাই খুশি হয়ে উঠলাম। অথচ, ভরতের ওটা ভাল লাগেনি। পরে সে আমাকে আলাদা করে ডেকে তার অস্বস্তির কথা বলল। বহির্জগতের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটেছে নিত্য দিন তার জনজাতি পরিচিতি ও সংরক্ষণের ‘অনৈতিক’ সুবিধা পাওয়া নিয়ে নানা ব্যঙ্গবিদ্রুপ ও শত্রুভাবাপন্নতার প্রকাশ সইতে সইতে: “ক্লাসে অন্য স্টুডেন্ট থেকে নিয়ে স্যররা পর্যন্ত সবাই আমাকে আলাদা করে রাখত। সোনার চাঁদ (এসসি), সোনার থালা (এসটি) বলে খ্যাপাত। আমি একা, কী করব, সয়ে এসেছি। এখানেও আমি একা জনজাতি। কেউ কিছু বলেনি বটে, কিন্তু, সত্যই বলছি স্যর কার মনে কী আছে তা তো জানি না। আপনি যে আলাদা করে মার্কা করে দিলেন তাতে ওরা কী মনে করবে, তাই ভেবে ভয় লাগছে।” বাস্তবিক, আমারই ভয় করতে লাগল। কেমন পৃথিবীতে বাস করছি আমরা, যেখানে এক-এক জনের মনের পৃথিবী গড়ে ওঠে ভয়ের আঘাত সইতে সইতে। তার চেয়ে ভয়ের কথা, আরোপিত বিচ্ছিন্নতার এ-রকম একটা ভয় নিয়ে এত লোককে বেঁচে থাকতে হচ্ছে, যার খবরটুকুও আমার কাছে নেই। যথেষ্ট নয়, তবু মার্জনা চাওয়ার বেশি কী-ই বা করতে পারি? তা-ই চাইলাম, ও তাতে লজ্জায় পড়ে গেল, “না না, এ কী স্যর, এতে ক্ষমা চাওয়ার কী আছে? আমি তো এমনিই বললাম।”
তবুও তো কেউ কেউ এমনি-এমনি বলে, তাই সমাজে শিকড়-গেড়ে-বসা ভয়ের বীভৎস চেহারাটা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ অনুমান করা যায়। একটা ঘরোয়া আড্ডায় সালমা নামের মেয়েটি বলেছিল, “আমার নামটা যদি বাঙালি নাম হত, ভাল হত। কেন যে মা-বাবা মুসলমানি নাম রাখতে গেল?” কেন, সালমা বাঙালি নাম নয় কেন? সংস্কৃত ভাষা থেকে কোনও নাম যদি বাঙালি নাম হয় তা হলে আরবি ভাষা থেকে আসা কোনও নামের বাঙালি হতে দোষ কোথায়? বেশ একটা নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা করে ফেললাম। সালমা চুপ করে গেল বটে, তবে একটু আড়াল হতে জানাল, “কাকু, ব্যাপারটা অত সোজা না। আপনি মুসলমান হলে বুঝতেন, শুধু নামের জন্য আমাকে কেমন জড়োসড়ো হয়ে থাকতে হয়। আমি গান গাইতে পারি, কাঁথা স্টিচের কাজ পারি, অঙ্কে আমার মাথা ভাল, তবু, আমি সবার আগে সালমা, মানে মুসলমান। আর মুসলমান মানে চারটে বিয়ে, কাঁড়ি কাঁড়ি বাচ্চা, ওরা গরু খায় বলে ওদের রক্ত গরম, তাই জন্মেই সন্ত্রাসবাদী!” নামের মতো একটা নিরীহ জিনিস যে মানুষের মনে এত বিচ্ছিন্নতা ও ভয়ের জন্ম দিতে পারে, সেটা যে খেয়াল করি না, এর চেয়ে বড় ভয়ের আর কী থাকতে পারে?
পারে, ভয়টা যে কত গভীর, তার একটা ধারণা পাওয়া যায়, তিনটি উদাহরণের মধ্যেকার একটি সাধারণ সূত্র থেকে: ম্যাটিল্ডা, ভরত ও সালমা, এদের তিন জনেরই ভয় কী জিনিস সেটা নিরন্তর টের পাওয়া থেকে। এদের কেউই নিজেদের অস্বস্তির কথা তৎক্ষণাৎ জাহির করেনি, পরে আলাদা করে ডেকে বলেছে। কারণ জানতে চাওয়ায় তিন জনেই যে উত্তর দেয়, তার মর্মার্থ এক। না, সেটা বয়স বা পদমর্যাদার পার্থক্যের কারণে নয়। আমি তাদের ও-নিয়ে বকে দেব, সেই ভয় থেকেও নয়। জিনিসটা নিয়ে আলাদা করে কথা বলাটা ছিল তাদের এক গভীরতর, বহু তাড়নার মধ্যে দিয়ে জাগ্রত অনুভূতির ব্যাপার: “আপনার একটা সম্মান আছে। সবার সামনে যদি আপনার কথার উপর কিছু বলতাম, তা হলে আপনার খারাপ লাগত। খারাপ লাগা কী জিনিস, সেটা তো হাড়ে-হাড়ে টের পাই। আমাদের খারাপ লাগাটা যেমন খারাপ, তেমনই আপনার খারাপ লাগাটাও তো খারাপ।”
বারংবার বিড়ম্বিত হই। শিক্ষা পাই, অথচ শিক্ষা হয় না। শিক্ষা বলে, নিজেকে না, নিজের জায়গায় ‘অপর’ করে রাখা প্রতিবেশীকে রাখো। অথচ, অভ্যাস আমাকে দিয়ে এমন কিছু করিয়ে নেয়, যাতে অপরত্ব শুধু বেড়েই যায়। অভ্যাস শক্তিশালী, তাকে বশে আনতে শিক্ষা পাওয়ার ধরনটাও বদলাতে হবে। প্রথার বিরুদ্ধে যেতে হবে। তার জন্য চাই প্রথা-বহির্ভূত, কঠোর, নির্মম এক সামাজিক শিক্ষাপদ্ধতি, যা খারাপ লাগা জিনিসটা ‘বুঝিয়ে’ ছাড়বে।