প্রতিস্পর্ধা: রাজভবনের সামনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিক্ষোভ কর্মসূচি। ৮ অক্টোবর ২০২৩। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
অনেকেরই প্রশ্ন, রাজ্যপাল আনন্দ বোসের হলটা কী? হঠাৎ কি তাঁর মনে ‘বদল’ এল? কোথাও কি তাঁর এমন কোনও গভীর উপলব্ধি হচ্ছে যে, নবান্ন এবং শাসকবর্গের সঙ্গে সংঘাত বাড়িয়ে তোলা এখন ‘সময়োচিত’ হবে না? তিনি কি কোনও ‘আদেশ’ বা ‘উপদেশ’ পেলেন? না কি, চোখের সামনে যা দেখা যাচ্ছে, যা শোনা যাচ্ছে এবং একটু একটু বোঝা যাচ্ছে, তা সবটাই মায়া?
উৎসবের আলো জ্বলে গিয়েছে। বিশেষ কারণ না থাকলে বছরের এই সময়টিতে সাধারণত রাজনীতি একটু আড়ালে থাকে। আসলে মানুষ এই ক’টি দিন রাজনীতির কূটকচালি চায় না। নেতারাও নিজেদের পুজোয় বা এলাকায় সময় কাটান। তবে এই সময়েই এমন দু’-একটি ঘটনা ঘটল, যা নজর এড়ায় না। রাজ্যপাল-প্রসঙ্গ তার একটি।
অল্প দিন আগেও রাজভবনের সঙ্গে নবান্ন তথা শাসকের সংঘাত কতটা জটিল আকার নিয়েছিল, সবাই তা জানেন। তাই সেই রাজ্যপালকে হঠাৎ কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের ‘পাওনা’র দাবিপত্র নিয়ে তড়িঘড়ি দিল্লিতে অমিত শাহের দরবারে পৌঁছে যেতে দেখে মূলত দু’ধরনের ভাবনা দানা বাঁধে। এক, হতে পারে রাজ্যপাল তাঁর উপরওয়ালার কাছ থেকে কোনও ‘বার্তা’ পেয়েছেন। তাই তাঁর এই তৎপরতা। দুই, সবটাই হয়তো তৈরি করা চিত্রনাট্য। ক্রমশ খোলসা হবে।
কারণ, মনে রাখতে হবে, রাজ্যপালেরা কোনওদিনই ‘প্রকৃত’ ক্ষমতাধর নন। পদ্মের পাপড়ির মতো যতই তাঁরা স্তরে স্তরে বিকশিত হয়ে উঠুন, সবই চলে কিন্তু নেপথ্যের নির্দেশে। পুতুল নাচানোর সুতো ধরা থাকে ‘দক্ষ’ বাজিকরের হাতে। আমরা তার টানের নড়াচড়া দেখি। কেন্দ্রীয় শাসকের আজ্ঞাবহ বলে চিহ্নিত ওই ‘মহামহিম’রা চাকরি রাখতে কেন্দ্রের তাঁবেদারি করবেন, এটা স্বতঃসিদ্ধ। তবে হাল আমলে রাজ্যপালদের দিয়ে বিরোধী সরকারগুলিকে কোনও না কোনও অছিলায় সর্বদা প্যাঁচে ফেলার ও উত্ত্যক্ত করার কর্মসূচি মোদী জমানার সুপরিকল্পিত অবদান।
পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যপাল থাকাকালীন জগদীপ ধনখড় এই ব্যাপারে দৃষ্টান্ত গড়েছিলেন। তাঁকে রাজ্যপালের পদ থেকে তুলে উপরাষ্ট্রপতি করে দিয়ে দেশের শাসকবর্গ কার্যত এটাও বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন, একটি বিরোধী রাজ্যে রাজভবনের সঙ্গে সরকারের নিরন্তর ‘সংঘাত’কে ধনখড় যে ভাবে যে পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন, তাতে তাঁদের পূর্ণ মদত ছিল। যার ‘স্বীকৃতি’ তাঁকে দেওয়া হল। অতএব ধনখড়ের উত্তরসূরি হিসাবে সি ভি আনন্দ বোস ‘সিলেবাস’-এর বাইরে পা ফেলেছেন, এমন ভাবার প্রশ্ন ওঠে না। অবশ্য দু’জনের কাজের ধারা এক নয়। ধনখড়ের মতো বোস রোজ সকাল-বিকেল সরকারের বাপবাপান্ত করে সমাজমাধ্যমে বিষোদ্গার করেন না। রাজভবনে প্রায় নিয়মিত রাজ্যের বিরোধী নেতাদের চা-চক্রও বসে না।
বরং রাজ্যপাল হয়ে প্রথম কিছু দিন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করে রাজ্যের শাসক শিবিরের প্রশংসা আদায় করে নেওয়া ছিল প্রাক্তন আইএএস বোসের অন্যতম কুশলী পদক্ষেপ। একেবারে সরস্বতী পুজোর দিন বাংলা শেখার ‘হাতেখড়ি’ পর্যন্ত! তার পরে ক্রমে শিক্ষাক্ষেত্র দিয়েই ‘কাজ’ শুরু করলেন তিনি। শাসকের অভিযোগ হল, রাজ্যপাল এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য উভয় ভূমিকাতেই বোসের বিভিন্ন কার্যকলাপ রাজভবনের ‘সর্বগ্রাসী’ প্রবণতার লক্ষণ। শুধু তা-ই নয়, নানা ঘটনায় প্রশ্ন তোলা হয়েছে রাজভবনের সৌজন্যবোধ নিয়েও। বিধায়কের শপথ যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। বস্তুত এই প্রথম রাজ্যপাল নিজে এক বিধায়ককে শপথগ্রহণ করালেন, যেখানে ডাকই পেলেন না বিধানসভার স্পিকার, পরিষদীয় মন্ত্রী এবং ডেপুটি স্পিকার। পরিষদীয় প্রথায় ঘটনাটি সম্ভবত নজিরবিহীন।
রাজ্যের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগে যা চলেছে, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপ ইতিমধ্যেই প্রকাশ্যে এসেছে। আদালত সর্বদা শিরোধার্য। তবে তার বাইরেও কয়েকটি বাস্তব চিত্র মনে করতে বাধা নেই। আমরা দেখেছি, আচার্য-রাজ্যপাল ‘ক্ষমতাবলে’ কখনও কোনও প্রাক্তন বিচারপতিকে, কখনও বা ভিন রাজ্যের অবসরপ্রাপ্ত কোনও আইপিএস-কে এখানে অস্থায়ী উপাচার্য করে দিয়েছেন। অভিজ্ঞদের অনেকের মতে, উপাচার্য পদে ইউজিসি-র বেঁধে দেওয়া যোগ্যতামানের দিকটি বিবেচনায় থাকলে এমন করা যায় না।
শোনা যায়, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে দ্রৌপদী মুর্মু যে দিন প্রথম কলকাতায় এসে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ঘুরলেন, সে দিন রাতে নাকি রাজভবন থেকে সরকারকে হঠাৎ ফোন করে বলা হয়েছিল, রবীন্দ্রভারতীর তৎকালীন উপাচার্যকে অবিলম্বে সরিয়ে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দিতে হবে! বিস্মিত সেই সরকারি পদাধিকারী রাজভবনকে বোঝান, যিনি দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপনা করেছেন, তাঁকে প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বদলি করা অযৌক্তিক ও অসঙ্গত। বহু বাক্য বিনিময়ের পরে বিষয়টি তখনকার মতো স্থগিত হয়েছিল। তবে রাজভবনের মনোভাব বোঝার পক্ষে ঘটনাটি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।
এখন যদি কেউ ভেবে থাকেন, বোসের এই ধরনের ক্রিয়া-কাণ্ড সম্পর্কে তাঁর দিল্লির ‘বস’রা অবহিত নন, তবে তা মানা কঠিন। আবার বলছি, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের অগোচরে অথবা সেখানকার সবুজ সঙ্কেত না পেয়ে বোস কিছু করছেন না। রাজ্যপালের পদে বসে সেই সাধ্য তাঁদের মতো কারও হওয়ার কথা নয়। বরং যেন তেন প্রকারেণ বিরোধী সরকারকে চাপে এবং বিপাকে রাখতে বিরোধী রাজ্যগুলির রাজ্যপালদের দিল্লি ‘নৈতিক’ (পড়ুন, রাজনৈতিক) মদত জোগায় বলেই বোসের মতো সাংবিধানিক প্রধানেরা এখন রাজনীতির ‘উপকরণ’ হয়ে উঠেছেন। আর সেই নিরিখেই আনন্দ বোসের আকস্মিক ‘নব’ প্রকাশ নিয়ে ভাবার অবকাশ তৈরি হয়েছে।
একশো দিনের কাজ ও আবাস যোজনার ‘বকেয়া’ টাকা দাবি করে দিল্লি ফেরত অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়েরা যখন রাজভবনের সামনে মঞ্চ বেঁধে ধর্নায় বসলেন আনন্দ বোস তখন উত্তরবঙ্গ এবং দিল্লি যাতায়াত করছেন। সেখান থেকেই তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, রাজভবন এলাকায় ১৪৪ ধারার মধ্যে এ ভাবে অবস্থান হয় কী করে? প্রশ্নটি হয়তো খুব অযৌক্তিক ছিল না।
কিন্তু সেই বল গড়ানোর আগেই রাজ্যপাল কলকাতায় ফিরে ধর্নাকারীদের সঙ্গে দেখা করে দাবিপত্র নিয়ে সে দিনই উড়ে যান অমিত শাহের কাছে। পর দিন তৃণমূলের দাবিপত্রটি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়ে চিঠি লিখে জানিয়ে দেন অভিষেককে এবং আপাতত ধর্না তুলে তৎক্ষণাৎ অভিষেকও রাজ্যপালকে ‘আন্তরিক কৃতজ্ঞতা’ জানান। দিল্লির অঙ্গুলিহেলন ছাড়া রাতারাতি রাজ্যপালের এমন তৎপরতা দেখা যেত না, এটা যেমন যুক্তিগ্রাহ্য, তেমনই তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানানোর মধ্যে অভিষেকের কোনও ‘বার্তা’ নিহিত আছে কি না, সেটাও বিচার্য।
ওই দাবিপত্র নিয়ে কেন্দ্র কী করবে, জানা নেই। তবে একই সঙ্গে দেখার, দিল্লি এখন বাংলার রাজ্যপালকে কী ভাবে ‘পরিচালনা’ করতে চায় এবং তৃণমূল তাতে কতটা ‘প্রভাবিত’ হয়। বিশেষ করে লোকসভা ভোটের আগে এটা উভয়ের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ।
ইতিমধ্যেই আনন্দ বোসের পুজোর শপথ, “দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন। ভ্রষ্টাচার ও হিংসার বিরুদ্ধে লড়াই।” কলকাতার পুজো মণ্ডপে দাঁড়িয়ে অমিত শাহ বলেছেন, “বাংলা দ্রুত দুর্নীতি ও অত্যাচার থেকে মুক্ত হোক।” পাল্টা প্রতিক্রিয়াও এসেছে যথারীতি। তবে কিনা, রাজনীতি সদাচঞ্চল। রাজপথে তার এক রূপ, চোরাগলিতে অন্য। রাজ্যে ২০১৯-এর বিজেপি ২০২১ থেকেই সঙ্কুচিত। কংগ্রেসও (বাম-সহ) এখন পর্যন্ত তৃণমূলের পক্ষে বড় চ্যালেঞ্জের জায়গায় এসেছে বলা যায় না। সে ক্ষেত্রে লোকসভায় বাংলার ৪২ আসনে তৃণমূল যদি আধিপত্য পায়, তা হলে দেশের সামগ্রিক ফলের উপরে তার কিছু প্রভাব পড়া স্বাভাবিক।
এক দিকে ‘ইন্ডিয়া’, অন্য দিকে এনডিএ। পরিস্থিতি অনুযায়ী কোন ‘অঙ্ক’ কখন কী ভাবে কষতে হবে, কে বলতে পারে! বোসের গতিবিধিও তাই নজরে থাক।