বিদ্ধ: মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য নিয়ে যাওয়ার সময় আততায়ীর গুলিতে নিহত অভিযুক্ত-দ্বয়, প্রয়াগরাজ, ১৫ এপ্রিল। ছবি: পিটিআই।
ওরা তিন যুবক এল, চতুর্দিকে পুলিশ এবং মিডিয়ার ভিড়ে সাংবাদিক সেজে দাঁড়িয়ে পড়ল। তত ক্ষণে এগিয়ে আসছেন উত্তরপ্রদেশের ‘গ্যাংস্টার’ তথা সমাজবাদী পার্টির প্রাক্তন সাংসদ আতিক আহমেদ। সঙ্গে তাঁর ভাই আশরফ। বিএসপি বিধায়ক রাজু পাল ও সেই খুনের অন্যতম প্রধান সাক্ষী উমেশ পালকে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত দু’জনেই। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জেলবন্দি আতিক সবে বলতে শুরু করলেন, “আসল কথা হল...।”
‘আসল কথা’ হল তার পর। বাইশ সেকেন্ডে প্রায় কুড়ি রাউন্ড গুলি। ঝাঁঝরা হয়ে ভূমি নিলেন দুই ভাই। ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে চতুর্দিক চমকিত করে পুলিশের কাছে ‘আত্মসমর্পণ’ করল ঘাতক তিন যুবক। যে দিন আতিক ও আশরফ খুন হলেন, সে দিনই আতিকের পুত্র আসাদের শেষকৃত্য ছিল। তিনিও তাঁর বাবা ও কাকার মতো আইনজীবী উমেশ পাল হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ছিলেন। ১৩ এপ্রিল ঝাঁসিতে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের (এসটিএফ) সঙ্গে ‘এনকাউন্টার’-এ আসাদ ও তাঁর এক সহযোগী গুলাম নিহত হন। পুত্রের শেষকৃত্যে থাকতে চেয়ে আদালতে আর্জিও জানিয়েছিলেন আতিক। কিন্তু এ ব্যাপারে শুনানির আগেই আসাদের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়ে যায়।
তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, আতিক ও আশরফকে খুনের পরে আততায়ীদের ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি তোলা। এখানে ধর্মীয় স্লোগান তোলার কারণ কী? সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের মানুষের বড় অংশকে কাছে টানার চেষ্টা? হাতেনাতে ‘পাপের সাজা’ মিটিয়ে দেওয়ার বার্তা দেওয়া? না কি ‘সংঘর্ষে মৃত্যু’র নতুন পন্থা নেওয়া, যেখানে সরাসরি পুলিশের দিকে আঙুল তোলা যাবে না? পুলিশ অবশ্য তড়িঘড়ি জানিয়ে দেয়, ‘বিখ্যাত’ হওয়ার জন্যই আততায়ীরা এই কাজ করেছে বলে জেরায় জানিয়েছে। আরও একটি প্রশ্ন উঠছে। যদি আততায়ীরা দূর থেকে গুলি চালাত, তা হলেও নাহয় কথা ছিল। এ ক্ষেত্রে পুলিশি ঘেরাটোপে দাঁড়িয়েই তারা এ-হেন অপরাধ সংগঠিত করতে পারল কী ভাবে? আশা, বিচারবিভাগীয় তদন্তে পুলিশের ভূমিকাও খতিয়ে দেখা হবে।
মুশকিলটা হল, ২০১৭-র ১৯ মার্চ যোগী আদিত্যনাথ উত্তরপ্রদেশের তখ্তে বসার পর থেকেই পরিস্থিতির দ্রুত বদল হতে শুরু করেছে। সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতায় আসা কোনও সরকার যদি গণতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভ বিচারব্যবস্থাকেই কার্যত নস্যাৎ করতে থাকে, সে রাজ্যে ‘গুন্ডারাজ’-ই একমাত্র পরিণতি। এক বাহুবলীকে নিকেশ করতে গিয়ে জন্ম নেয় ভিন্নতর বাহুবলীর দল— কখনও তা উর্দিধারীর বেশে, কখনও বা রাজনীতির আঙিনায়।
মাত্র কয়েক দিন আগেই বিজেপির প্রাক্তন সাংসদ হরিনারায়ণ রাজভর মন্তব্য করেন, গ্যাংস্টার তথা রাজনীতিক আতিককে জেল থেকে বার করে এনকাউন্টারে মেরে ফেলা উচিত। যে অফিসারেরা এই কাজ করবেন, ভবিষ্যতে তাঁদের জন্য স্বর্গের দরজা খোলা আছে। নানা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই ২০১৯-এ আতিক ও তাঁর ভাই আশরফকে উত্তরপ্রদেশের জেল থেকে গুজরাতের সবরমতী জেলে সরানো হয়। সম্প্রতি উমেশ পাল হত্যা মামলায় আতিকদের হেফাজতে পায় উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। তখন আতিক দাবি করেন, তাঁকে ওই রাজ্যের পুলিশ মেরে ফেলতে চায়। সুপ্রিম কোর্টেও এই মর্মে আর্জি জানিয়েছিলেন আতিক। সবরমতী জেল থেকে বেরোনোর সময়েও সাংবাদিকদের একই কথা বলেছিলেন তিনি।
তার পরেও কেন তাঁদের নিরাপত্তা আরও আঁটসাঁট করল না পুলিশ? এই প্রশ্ন তুলে বিশেষ কোনও লাভ নেই। যোগী ও তাঁর পারিষদেরা জানেন, বিচারপ্রক্রিয়ায় কালাতিপাত না করে ‘অপরাধী’দের বাড়িঘর বুলডোজ়ার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিলে অনেক বেশি হাততালি পাওয়া যায়। পরিচিত হওয়া যায় ‘বুলডোজ়ার বাবা’ হিসাবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমানসে ভেসে ওঠে ‘মসিহা’ ভাবমূর্তি।
মনে রাখতে হবে, ক্ষমতায় আসার পরে এই যোগী আদিত্যনাথ বলেছিলেন, “অপরাধীদের গুলি করে নিকেশ করে দেওয়া হবে।” কখনও বলেছেন, দুষ্কৃতীদের মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হবে। বার্তা খুবই পরিষ্কার, কোনও অস্পষ্টতা নেই। তবে, এই সব ভাষ্যের মধ্য দিয়ে আরও একটা বিষয় সামনে চলে আসে। সেটি হল, গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং বিচারপ্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করে দেওয়া।
নিহত ব্যক্তিরা সহজ-সরল মানুষ ছিলেন না, উল্টো দিকের রাজনীতিতে তাঁরা ছিলেন ভয়াল দুষ্কৃতী-ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠার নেতা ও হোতা। কিন্তু সব রকম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নস্যাৎ করে নিশ্চয়ই তাঁদের শাস্তি বিধানের কথা ছিল না। এ ক্ষেত্রে প্রথম কাজ ছিল, অভিযুক্তকে পাকড়াও করা। দ্বিতীয়ত, তাঁকে কাঠগড়ায় তোলা। তৃতীয়ত, বিচারপ্রক্রিয়ার শেষে দোষ প্রমাণিত হলে সাজা ঘোষণা। কিন্তু আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থা এত দীর্ঘসূত্র যে, গোটা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে বেশ কয়েক বছর কেটে যেতে পারে।
তা হলে বড় মুখ করে ‘সুশাসন’ আনার কথা বলার পরে সেই মুখ থাকে কোথায়? না কি, এ সব প্রশাসনিক দায় ও দায়িত্বের কথা এ দেশে এখন কেবল লোক-দেখানো? এখন কেবল আইনের শাসন কুলুঙ্গিতে তুলে রেখে পুলিশ-প্রশাসনকে বার্তা দেওয়া, শাসকের মুখ ও অন্তরের কথা বুঝে নিয়ে সেই অনুযায়ী কাজ করতে।
আর তার ফল? পরিসংখ্যান বলছে, গত ছ’বছরে উত্তরপ্রদেশে পুলিশি এনকাউন্টারে ১৮৩ জন নিহত হয়েছেন। এর আগে, ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই সংসদে বিজেপি সাংসদ বরুণ গান্ধীর এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছিলেন, ২০১৭-র ১ জানুয়ারি থেকে পাঁচ বছরে গোটা দেশে এনকাউন্টারে ৬৫৫ জন মারা গিয়েছেন। তার মধ্যে ১১৭ জনই উত্তরপ্রদেশে। ২০২১-এর ডিসেম্বরে সংসদে নিত্যানন্দ রাই জানিয়েছিলেন, গত তিন বছরে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যত ঘটনা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কাছে নথিভুক্ত হয়েছে, তার ৪০ শতাংশই উত্তরপ্রদেশের।
আর এ সব ক্ষেত্রে নিয়মনীতি মেনে প্রশাসনিক পদক্ষেপের বহর? ২০১৭-র মার্চে যোগী আদিত্যনাথ ক্ষমতায় বসার পর থেকে গ্যাংস্টার বিকাশ দুবের ঘটনা পর্যন্ত পুলিশের সঙ্গে ‘সংঘর্ষ’-এ মোট ১১৯ জন অভিযুক্তের মৃত্যু হয়। এই ১১৯টির মধ্যে ৭৪টির ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্ত শেষ হলেও এই প্রতিটি তদন্তের ক্ষেত্রেই পুলিশ ভুয়ো সংঘর্ষের অভিযোগ থেকে রেহাই পায়। ৬১টি ভুয়ো সংঘর্ষের মামলার ক্ষেত্রে পুলিশ আদালতে রিপোর্ট পেশ করে জানায়, তদন্তে কিছু পাওয়া যায়নি; আদালতে তা গ্রাহ্যও হয়। ভিন্নতর বিশ্লেষণে যাওয়ার জন্য সরকারি এই পরিসংখ্যানের গুরুত্বও অপরিসীম।
ভুয়ো সংঘর্ষের ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের একটি মন্তব্যও তাৎপর্যপূর্ণ। ২০১১ সালে প্রকাশ কদম বনাম রামপ্রসাদ বিশ্বনাথ গুপ্ত মামলায় সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল, পুলিশের দ্বারা ভুয়ো সংঘর্ষ ঠান্ডা মাথায় খুন ছাড়া কিছু নয়। সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্য ছিল, ‘ট্রিগার হ্যাপি’ যে সব পুলিশকর্মী ভাবছেন যে, সংঘর্ষের নামে তাঁরা সাধারণ মানুষকে হত্যা করবেন এবং রেহাই পাবেন, তাঁদের জেনে রাখা ভাল, ফাঁসির মঞ্চ তাঁদের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু, যাঁরা একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষকে ভয় দেখাতে চান, অপরাধীর ধর্মীয় পরিচয় যেখানে বড় হয়ে ওঠে, যেখানে ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যার ঘটনাতেও অভিযুক্ত পুলিশকর্মীদের নামে অনায়াসে জয়ধ্বনি ওঠে, উৎসবের আবহে দেদার মিষ্টি বিলি হয়, সেখানে সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার কথা মনে রাখবে প্রশাসন ও সমাজ, সেটা হয়তো একটু বেশিই প্রত্যাশা।
আতিক বা আশরফ নয়, প্রয়াগরাজের হাসপাতাল চত্বরে আসলে পড়ে রয়েছে গণতন্ত্রের লাশ। উত্তরপ্রদেশ ক্রমেই বুঝিয়ে দিচ্ছে গণতন্ত্রের চেহারাটা এ দেশে কেমন হতে চলেছে। তাতে দেশবাসীর কী প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা, সেটা তাঁদেরই ভাবতে হবে।