—ফাইল চিত্র।
ছোটবেলায় পুরস্কার পেয়েছিলাম দু’খণ্ড শরদিন্দু অমনিবাস। এই বই পড়ে আশ্চর্য সব শব্দ শিখতে শিখতে যে দিন জেনেছিলাম অমনিবাস আসলে ইংরেজি শব্দ, উচ্চারণ ‘ওমনিবাস’ সে দিন খুব অবাক হয়েছিলাম। ‘শরদিন্দু-সমগ্র’, ‘শরদিন্দু সংগ্রহ’ ইত্যাদি চালু বাংলা শব্দ থাকতে কেন বাংলা বইয়ের নামে ইংরেজি শব্দ (যাকে বাংলা শব্দ বলে ভুল হয়) ব্যবহার হবে! পরে বাংলা ভাষা নিয়ে নানা রকম চিন্তা-ভাবনার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে বুঝতে পেরেছিলাম এই উদাহরণটি হেলাফেলার নয়।
ভাষা শহিদ দিবসকে যদি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে দেখা হয় তা হলে সামনে এসে দাঁড়ায় মাতৃভাষা। আমরা যারা উনিশে মে আর একুশে ফেব্রুয়ারির সন্তানসন্ততি, অর্থাৎ যারা তেমন কোনও প্রাণপাত-করা আন্দোলন না করেও নিজের মাতৃভাষাকে মোটামুটি সম্মানজনক জায়গায় প্রতিষ্ঠিত অবস্থায় পেয়েছি, ভাষার প্রতি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কী?
এক কথায় উত্তর হল, ভাষাকে মা-মাসি কিচ্ছু না ভেবে শুধু ভাষা হিসাবেই গুরুত্ব দেওয়া; মানে বাংলা ভাষায় কথা বলা, লেখালিখি, পড়াশোনা করা ইত্যাদি। কিন্তু এইটুকুই সব নয়, যে কোনও ভাষাকে তার সম্মানের অবস্থানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাকে শুধু ব্যবহারযোগ্যই নয়, প্রয়োজনীয় এবং অপরিহার্য করে তোলাও দরকার। এক ভাবে চেষ্টা করেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ধর্মতলার দোকানে দোকানে গিয়ে অনুরোধ করেছিলেন দোকানের নাম-ধাম ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতেও লেখা হোক, কারণ স্থানীয় ভাষার এই ব্যবহার সংবিধানে উল্লিখিত। সে কাজ ঠিক ‘পুলিশ’-এর মতো হয়নি, তাই সবাই ভয়ে ভয়ে সব দাবি মেনে নেননি। তবে কিছু কাজ নিশ্চয়ই হয়েছিল, তাই আজ ধর্মতলায় দাঁড়ালে কিছু বাংলা শব্দ, দোকানের নাম, নির্দেশ বাংলায় লেখা চোখে পড়ে। আর এক ভাবে চেষ্টা করতে পারি আমরা সবাই, যদি পড়াশোনাটা যতটা সম্ভব বাংলা ভাষায় চালিয়ে যেতে পারি। কিন্তু ঘটনা হল, বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনাকে, বিশেষ করে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা যে বেশি দূর টেনে নিয়ে যেতে পারি না, তার একটা কারণ হল বাংলায় লেখা বইয়ের অভাব। আর বাংলায় আন্তর্জাতিক মানের বই লিখতে গেলে বা অনুবাদ করতে গেলে আমরা আটকে যাই
পরিভাষায় বা প্রতিশব্দতে। আর এই পরিভাষা ঠিকঠাক না হলে পাঠ্যবই হোক বা সাহিত্য— একেবারেই নীরস হয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক ‘গুগল অনুবাদক’-এর কিছু অনুবাদের নমুনা পরীক্ষা করলেই সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়।
বাংলা ভাষার প্রসারের ক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়, কিন্তু দ্বাদশ শ্রেণি পেরিয়ে স্নাতক স্তর পর্যন্তও বিজ্ঞানের পড়াশোনা যে এখন আমরা বাংলাতে করতে পারি, তার পিছনে আর যাঁর বিরাট অবদান রয়েছে, তাঁর কথা আমরা অনেকেই ততটা জানি না। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একেবারে সমসাময়িক বন্ধু অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০)। বাংলা ভাষায় শিক্ষা বিস্তারের জন্য বিশেষ করে বিজ্ঞানের শিক্ষা প্রসারের জন্য উনি যে অবদান রেখে গিয়েছেন, তার কেন্দ্র হল বাংলা পরিভাষা সৃষ্টিতে।
পাশ্চাত্য শিক্ষার সেই উষালগ্নে (এমনকি প্রাক্-বঙ্কিম বাংলা গদ্য সাহিত্যেরও উষালগ্নে) অক্ষয়কুমার নিজে নিজে শুধু বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গভীর পড়াশোনাই করেননি, সে সব বাংলায় সরস ও সরল করে পরিবেশন করেছেন বিভিন্ন বয়সের ছোটদের জন্য। তার সবটাই ঠিক অনুবাদ বলা চলে না, বরং বিজ্ঞানমূলক প্রবন্ধ-সাহিত্য বলা যায়, আর সেই কাজের দরকারেই তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তা হল বিজ্ঞানের বিচিত্র পরিভাষা। সৃষ্টি করতেই হয়েছিল, কারণ পরিভাষা ছিল না আর পরিভাষা নিজে নিজে তৈরি হয় না।
অক্ষয়কুমার যে সব পরিভাষা সৃষ্টি করেছিলেন, সেগুলো আজও আমাদের ইস্কুলের বিজ্ঞান বইয়ে ব্যবহার হয়। যেমন স্থিতিস্থাপকতা, রসায়ন, রোধ, ভরকেন্দ্র ইত্যাদি। এমনকি অতিপরিচিত পরমাণু, গতি, ধূমকেতু, ব্যাস, অণুবীক্ষণ, চুম্বক, জ্যোতির্বিদ্যা, দাহ্য পদার্থ, জড়, তড়িৎ, পরিমিতি, ধ্রুবতারা, অঙ্গার, বজ্র, জোয়ার, রামধনু, সৌরজগৎ, মাধ্যাকর্ষণ, গ্রহণ, সুমেরু, মানমন্দির, জ্বালামুখী, আগ্নেয়গিরি— এ সবই তাঁর তৈরি করা প্রতিশব্দ, যা উদ্ভাবনের প্রায় দেড়শো বছর পরেও একই ভাবে চালু রয়েছে। এই সৃষ্টির পিছনে অক্ষয়কুমারের গভীর চিন্তাভাবনা ও মানসিক পরিশ্রম ছিল। এই শব্দগুলো লক্ষ করলে বোঝা যাবে, বেশির ভাগ শব্দ সরাসরি সংস্কৃত থেকে নেওয়া (তৎসম), কিছু তদ্ভব শব্দ, দেশি-বিদেশি শব্দও আছে যাদের দরকারমতো জুড়ে নতুন একটি শব্দ তৈরি হয়েছে। এর জন্য বিজ্ঞানের বিষয়টি সম্পর্কে অত্যন্ত স্পষ্ট ধারণা তো চাই-ই, কিছুটা সাহিত্যবোধও দরকার যাতে রচনাটি বা অনুবাদটি নীরস বা আড়ষ্ট হয়ে না পড়ে। সেই কাজে তিনি কতটা সফল হয়েছিলেন তা বোঝা যায় তাঁর বিজ্ঞানমূলক বই ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, চারুপাঠ (তিন ভাগ) পড়লে। বইগুলি সেই যুগে অতীব জনপ্রিয় হয়েছিল এবং বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে একটা শক্ত ভিত রচনা করেছিল, যার উপর প্রাসাদ গড়া যায়।
সুতরাং, বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে আমরা অক্ষয়কুমারেরও সন্ততি। পরবর্তী কালে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা ও পরিভাষার উপযুক্ততা বিষয়ে তাঁর মতামত জানিয়েছেন রাজশেখর বসু। আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুও বলেছেন, “যাঁরা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা হয় না, তাঁরা হয় বাংলা জানেন না, নয় বিজ্ঞান বোঝেন না”— এবং বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ স্থাপন করে বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার একটা পরিসর তৈরি করেছিলেন। কিন্তু বাংলা ভাষার রাজপ্রাসাদ যে গড়ে ওঠেনি, তার কারণ বিবিধ। সব সমস্যার কাটাছেঁড়ায় না গিয়ে অক্ষয়কুমারের উত্তরসূরি হিসেবে কয়েকটি কাজ আমরা করতেই পারি। যেমন, বাংলায় বিজ্ঞাপনের ভাষাকে যথাযথ করে তোলা। মনে রাখতে হবে সাহিত্যই সব নয়; চোখের সামনে ঝুলে থাকা, কানে ঢুকে আসা বিজ্ঞপ্তি ও বিজ্ঞাপনের ভাষা অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছয়। যে সব বিজ্ঞাপন হিন্দি থেকে বাংলায় অনুবাদ হয়, দেখা যায় সেগুলোর বাংলা প্রতিশব্দ এবং বাক্যগঠন— উভয় দিক অত্যন্ত দুর্বল। যেমন, বছর কয়েক আগে একটি দূরভাষ কোম্পানির পাতাজোড়া বাংলা বিজ্ঞাপনে ‘রিলেশনশিপ’ শব্দটির বাংলা হয়েছিল ‘সম্পর্কতা’। সিগারেটের ক্ষতিকর প্রভাব বোঝাতে যে বিজ্ঞপ্তি ছবি শুরুর আগে দেখানো হয় তার ভাষা শুনে মনে হবে হিন্দি ‘চেহেরা’ (মুখ) আর বাংলার চেহারা (আকৃতি) একই শব্দ। এই সব কিছুই আসলে চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার ফলাফল।
এই দায় আমাদেরও। প্রদীপের নীচেই অন্ধকারের মতো অক্ষয়কুমার, রবীন্দ্রনাথ, পরশুরাম, সুকুমার রায়ের উত্তরাধিকারের সঙ্গে আমরা বহন করছি এক চূড়ান্ত উদাসীনতা। বাংলা ভাষা গোল্লায় গেলে আমাদের কিছু যায় আসে না। প্রযুক্তি এগোচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজিতেও নতুন শব্দ যোগ হচ্ছে। তার পাশাপাশি প্রয়োজন নতুন বাংলা পরিভাষা সৃষ্ট করা এবং ঝরঝরে সুললিত বাংলা বাক্য রচনা করা। পরিবর্তে বাংলা বাক্যের মধ্যে আমরা অনায়াসে মিশিয়ে দিই অজস্র ইংরেজি-হিন্দি শব্দ যাদের বাংলা প্রতিশব্দ রয়েছে। যেমন অমনিবাস।
ভুল বানান আর আক্ষরিক অনুবাদ কণ্টকিত দুর্বোধ্য বাংলা বাক্য ছাপা হয় বিজ্ঞাপন ক্রোড়পত্রে, যা পড়লে মনে হয় এর চেয়ে ইংরেজিই ভাল। আর একুশে ফেব্রুয়ারিকেও আমরা আবেগজর্জর শহিদ দিবসে পরিণত করে ফেলেছি, যার আগে-পরে শুধু পড়ে থাকে “জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না” (ভবানীপ্রসাদ মজুমদার)।