—ফাইল চিত্র।
ভালবেসে শুধু ঘর ছাড়েননি, ধর্মও ছেড়েছিলেন তিনি। অথচ সেই স্বামী তাঁকে তালাক দিয়েছিলেন ভাষা আন্দোলনে যোগ দেওয়ার ‘অপরাধ’-এ! প্রমথনাথ বিশীর ভাগ্নি কল্যাণী রায়চৌধুরী মাত্র ছেচল্লিশ বছরের জীবনে ‘ভালবাসা’ শব্দটির ব্যঞ্জনা পাল্টে দিলেও তিনি আজ বিস্মৃত। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের রজতজয়ন্তীর দোরগোড়ায় পৌঁছে সদ্য শতবর্ষ পেরোনো কল্যাণী রায়চৌধুরী ওরফে মমতাজ় বেগমের আত্মত্যাগের কাহিনি স্মরণ করতেই পারি আমরা।
ঘটনাস্থল, বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ। সেখানে রহমতউল্লা মুসলিম ইনস্টিটিউট ময়দানে ভাষা আন্দোলন বিষয়ে কথা বলছিলেন প্রধান অতিথি আবুল হাশিম। নৃশংস ছাত্রহত্যার সংবাদ নারায়ণগঞ্জবাসী জানতে পারলেন প্রধান অতিথির বক্তব্যে। নিমেষে জনসভা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন সাধারণ মানুষ। সিদ্ধান্ত হয়, প্রতিবাদ মিছিল বার করা হবে।
ময়দানের কাছেই মর্গ্যান হাই স্কুল। তার প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ় বেগম সেই মিছিলে একা যোগ দিলে ঘটনাটি অতি সাধারণ বলেই বিবেচিত হত। কিন্তু তিনি যে স্কুলের ছাত্রীদের প্রিয় ‘বড় আপা’। সর্বোপরি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে সমগ্র পূর্ব বাংলা তখন ঐক্যবদ্ধ। বিদ্যালয়ের বড়দিদির ডাকে মিছিলে যোগ দিল প্রায় তিনশো ছাত্রী! এ ছাড়াও আরও অনেক মহিলা মমতাজ়ের দেখানো পথে হাঁটলেন সে দিন। রক্ষণশীল সমাজের মধ্যে বাস করেও নারীদের এমন ভূমিকা পালন সে দিন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে নাড়া দিয়েছিল স্বাভাবিক ভাবেই। শাসক পক্ষের শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে উঠল একটা নাম— মমতাজ় বেগম। দীর্ঘ চার বছর ধরে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে আন্দোলন চলছে, কোনও নারীকে এই ভাবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে দেখেনি শাসক।
২৭ ফেব্রুয়ারি উপরমহল থেকে নির্দেশ এল মমতাজ় বেগমকে গ্রেফতার করতে হবে। স্কুলের টাকা তছরুপের মিথ্যে মামলায় অভিযুক্ত করে দুই দিন পর গ্রেফতার করা হল তাঁকে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল এই খবর। মর্গ্যান হাই স্কুলের শিক্ষিকা ও ছাত্রীরা ক্লাস বয়কট করে, মিছিল নিয়ে এগিয়ে চলল কোর্টের দিকে। যোগ দিল অন্য স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা। কয়েক হাজার মানুষ ঘিরে ফেলেছে নারায়ণগঞ্জ থানা। এক দিদিমণির জন্য মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবাবেগ দেখে আতঙ্কিত প্রশাসন। মহকুমা পুলিশ অফিসার উত্তেজনা প্রশমনের জন্য জানালেন মমতাজ়কে জামিনে ছেড়ে দেওয়া হবে। তা অবশ্য হল না, আদালতের নির্দেশ এল ঢাকার জেলে পাঠাতে হবে তাঁকে।
‘বড় আপাকে নিয়ে যেতে দেব না’, নারায়ণগঞ্জ এই প্রতিজ্ঞায় উত্তাল। দু’পাশের বড় বড় গাছ কেটে রাস্তার উপর ফেলে রেখে পথ অবরোধে শামিল মানুষ। পুলিশের লাঠিচার্জে বৃদ্ধ থেকে বালক, গৃহবধূ থেকে ছাত্রী রক্তাক্ত, আহত। নির্বিচারে তাদের গ্রেফতার করে চলেছে পুলিশ। মানুষের বিভ্রান্তি ও ক্লান্তির সুযোগে অনেক রাতে মমতাজ়কে ঢাকায় নিয়ে যেতে সফল হল প্রশাসন।
ঢাকায় খাদ্য পরিদর্শকের চাকরি করতেন আব্দুল মান্নাফ। দেশভাগের আগে গোপালগঞ্জের এই ছাত্রটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়তেন। চাকরিও করেছেন কলকাতায়। ব্যাঙ্ককর্মী কল্যাণী রায়চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর পরিচয়, ভালবাসা, বিয়ের সিদ্ধান্ত, কোনওটাই মেনে নেননি কল্যাণীর পিতা রায়বাহাদুর মহিমচন্দ্র রায়চৌধুরী, কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি। অত্যন্ত রক্ষণশীল। কল্যাণীকে কোনও স্কুলে ভর্তি হতে দেননি, প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পাশ করতে হয় মেয়েকে। স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনার জন্য একরোখা কল্যাণী অবশ্য বেথুন কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন, সেই জেদেই বাবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে ব্যাঙ্কে চাকরি নিয়েছিলেন। মামা প্রমথনাথ বিশীর একটা প্রভাব আদরের ভাগ্নি ‘মিনু’র উপর পড়েছিল। ভিন্ন ধর্মের ছেলেকে বিয়ে করার জন্য কল্যাণী পরিবার-চ্যুত হলেন। কোনও কিছুর পরোয়া না করে আত্মীয়পরিজন ছেড়ে ভালবাসার মানুষটির হাত ধরে পূর্ববঙ্গে চলে এসেছিলেন মিনু, নতুন নামে ‘মমতাজ় বেগম’।
ঢাকার কয়েদখানায় সেই ভালবাসার মানুষটি দেখা করতে এসেছেন মমতাজ়ের সঙ্গে। পাশাপাশি অনুরোধ মিনু যেন ক্ষমাপ্রার্থনা করে সরকারি মুচলেকা পত্রে স্বাক্ষর করে মুক্তি নিয়ে নেয়, তাতেই পরিবারের সকলের মঙ্গল। স্ত্রীকে দিয়ে এই কাজ করাতে না পারলে মান্নাফ সাহেবকে চাকরিটি হারাতে হবে। মমতাজ়ের দৃঢ় উত্তর, কিছুতেই এই কাজ তিনি করবেন না। মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় তাঁর পক্ষে কোনও আপস, সমঝোতা করা অসম্ভব।
ক্রুদ্ধ মান্নাফ সাহেব জেলখানাতেই তালাক দিলেন। নিজের সিদ্ধান্তে অটল মমতাজ় মেনে নিলেন স্বামীর এই সিদ্ধান্ত। যাঁর হাত ধরে সব ছেড়ে চলে এসেছিলেন এক দিন, তিনিই আজ হাতটা ছেড়ে দিলেন। দেড় বছর পর মুক্তি পান মমতাজ়। ভাষা আন্দোলনে যে মহিলারা গ্রেফতার হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে বন্দি ছিলেন তিনিই। কারাগারে তাঁর সহবন্দি ছিলেন তেভাগা আন্দোলনের ‘রানিমা’ ইলা মিত্র। ছাড়া পাওয়ার পর মমতাজ় অভাবে, দারিদ্রে দিন কাটিয়েছেন একাকী, কিন্তু কলকাতায় ফিরে আসেননি। জেলের অত্যাচারে তাঁর শরীর রোগজীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। ১৯৬৭ সালে অসুস্থ হলে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। ৩০ মার্চ সেখানে প্রয়াত হলেন। আজিমপুর কবরস্থানে কবর দেওয়া হলেও কোথায় তিনি শায়িত আছেন আজ পর্যন্ত জানে না কেউ। হারিয়ে যাওয়া কবরের মতো দুঃসাহসী এই নারী ভাষা সৈনিকের কথা তাঁর শতবর্ষেও ভুলেই থাকলাম আমরা।