কলকাতার এক মিশনারি মেয়েদের স্কুলে পড়িয়েছি টানা ত্রিশ বছর। প্রতীকী ছবি।
করিডরে দেখা হতেই দৌড়ে এল ছোট্ট মেয়েটা, “ম্যাম, উইল ইউ প্লিজ় হাগ মি?” কিছু দিন আগে সে তার মাকে হারিয়েছে, রোজই কোনও না কোনও অছিলায় সে আসে আমার কাছে। কিছু কথা, একটু গাল টিপে আদর করে দেওয়া, একটু জড়িয়ে ধরা, এটুকুই। হয়তো এর মধ্যেই সে তার মায়ের ছোঁয়া খোঁজে।
তখন স্কুল-বাসে, বাচ্চাদের সঙ্গেই স্কুলে যেতাম। বেশ কিছু দিন রোজ একটি মেয়ের পাশে বসতে হত। রোজ সে কাঁদত— তার নাকি খুব পেটে ব্যথা হচ্ছে, বাড়ি যাবে। জানতাম, তার বাবা-মা’র সদ্য বিচ্ছেদ হয়েছে। তাকে জড়িয়ে বসে থাকতে হত। নানা গান, কবিতা, গল্প দিয়ে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম স্কুল পৌঁছনো অবধি।
কলকাতার এক মিশনারি মেয়েদের স্কুলে পড়িয়েছি টানা ত্রিশ বছর। শিক্ষকতার জীবনে এ রকম কতই তো ঘটেছে। বিশেষ কারণ ছাড়াও বাচ্চারা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে, এক জনের গাল টিপে দিলে আরও কত জোড়া চোখ জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে, কখন তাদের গালগুলোও একটু টিপে দেব! এই তো কিছু দিন আগে এক ছাত্রীর বিয়েতে দেখা হল আরও অনেক পুরনো ছাত্রীর সঙ্গে। তারা সকলেই এখন জীবনে প্রতিষ্ঠিত। গল্প করছি তাদের সঙ্গে, হঠাৎ এক জন পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, “ম্যাম, একটু পিছন থেকে ঘাড়ে কিলিবিলি করে দাও না, যে রকম স্কুলে দিতে! খুব মিস করি।”
আরও বছর চারেক চাকরিজীবন বাকি থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত কারণে দু’বছর হল শিক্ষকতা থেকে ইস্তফা দিয়েছি। কিন্তু এখন যখন দেখছি যে, শিক্ষক/শিক্ষিকাদের জন্য তৈরি হচ্ছে আদর্শ আচরণবিধি, যেটা তাঁদের মেনে চলতে হবে— মনে হচ্ছে, দু’বছর আগে যদি চাকরি না-ও বা ছাড়তাম, এখন হয়তো বাধ্য হতাম ছেড়ে দিতে। সেই আচরণবিধি কেন তৈরি করতে হচ্ছে, কারণটা বুঝতে পারি— সত্যিই তো, স্কুলের শিক্ষকের হাতে যদি একটা শিশুর যৌন নিগ্রহ ঘটে, তা হলে তো বিশ্বাসের ভিতটা নড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। মনে হতেই পারে যে, একেবারে নিয়ম বেঁধে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষকের স্পর্শ থেকে দূরে রাখাই ভাল।
কিন্তু, শিক্ষকতা মানে কি শুধু ক্লাস নেওয়া, খাতা দেখা আর পরীক্ষা নেওয়া? বিশেষ করে নিচু ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা, তাদের বিশ্বাস অর্জন করা, তাদের ভালবাসা পাওয়া শিক্ষকতার একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক। আর ওই আদর্শ আচরণবিধি মেনে সেটা করা বেশ কঠিন। একটা স্নেহভরা স্পর্শ, একটা ভালবাসার ডাক যা দিতে পারে, তা তুলনাহীন। আজ আমার এই ষাট ছুঁই-ছুঁই বয়সেও সেই কোন ক্লাস ওয়ান/টু-তে স্কুলের করিডরে খুব প্রিয় এক দিদিমণির স্নেহভরা পিঠে হাত রাখার ভাল লাগার অনুভূতি এখনও মনে আছে।
বর্তমানে যখন জীবনযাপন অনেক কঠিন, যার থেকে বাচ্চারাও ছাড় পায়নি, সেখানে একটা বাচ্চা তার স্কুলের শিক্ষক বা শিক্ষিকার কাছে যদি একটু আদর পায়, একটু ভালবাসার আশ্রয় পায়, এই আদর্শ আচরণবিধি দিয়ে সেটা কি কেড়ে নেওয়া উচিত? এমনিতেই তো জীবন বড় যান্ত্রিক হয়ে গেছে। শিক্ষা, চাকরি, এমনকি সম্পর্কগুলোর মধ্যেও যেন মানবিক অনুভূতিগুলো হারিয়ে গিয়েছে। শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কও ছাড় পায়নি। তাই মনে হয়, যতটুকু মানবিকতা আছে, থাক না সেটুকু বেঁচে।
যে দুর্ঘটনাগুলোর খবর সংবাদপত্রের পাতায় পাচ্ছি, স্কুলগুলোতে যে সব ঘটনা ঘটছে, সেগুলোও তো কোনও ভাবেই কাম্য নয়। এ সব শুনলে নিজেকে শিক্ষিকা হিসাবে পরিচয় দিতেও দ্বিধা হয়। কিন্তু, আদর্শ আচরণবিধি দিয়ে কি এই ঘৃণ্য মানুষগুলোর অশুভ অভিপ্রায় আটকানো যাবে? শুধু আইন করে কি অপরাধ আটকানো যায়? এখানে স্কুল কর্তৃপক্ষ, স্কুলের অন্য কর্মীদের আরও সহানুভূতিশীল, আরও সজাগ হতে হবে। কর্তৃপক্ষকে মানুষ চিনতে হবে। বাচ্চাদেরও সচেতনতা বাড়াতে হবে। তবে, একই সঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন, সচেতন হওয়া আর কারও প্রতি অকারণে বিদ্বিষ্ট হওয়া বা অহেতুক সন্দেহ করা কিন্তু এক জিনিস নয়। এখানে সূক্ষ্ম ভারসাম্যের প্রশ্ন রয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষকে তা বুঝতে হবে, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও সে ভাবেই তৈরি করতে হবে সচেতনতার বোধ।
সেই ভারসাম্যেরই একটা দিক হল, শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কের স্বাভাবিকতাকে বজায় রাখতে পারা। এক জন শিক্ষকও যে স্নেহশীলতার ভঙ্গিতে কোনও ছাত্র বা ছাত্রীর সঙ্গে অশালীন আচরণ করতে পারেন না, এমন দাবি করার কোনও প্রশ্নই নেই। এমন দাবি করার পথ তো অভিযুক্ত শিক্ষকদের মতো মানুষরাই রাখেনি। কিন্তু, স্নানের জলের সঙ্গে শিশুটিকেও বিসর্জন দেওয়া বিচক্ষণতার কাজ নয়। যেখানে গোলমাল আছে, সেখানে সংশোধন করা হোক। কিন্তু, আদর্শ আচরণবিধির নামে ছাত্র আর শিক্ষকদের মধ্যে অলঙ্ঘ্য দেওয়াল খাড়া করলে শেষ অবধি ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতিই হবে।
শিক্ষকদেরও কি হবে না?