তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিচেপ তাইপ এর্ডোয়ান। —ফাইল চিত্র।
টানা তৃতীয় বার নির্বাচনে জয়ী হয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট পদে রয়ে গেলেন রিচেপ তাইপ এর্ডোয়ান (ছবি)। আমেরিকার নিরলস প্রচার, তুরস্কের সমাজের উদারপন্থীদের আপ্রাণ বিরোধিতা, কিছুই তাঁর ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন আটকাতে পারল না। এর্ডোয়ান এর আগে তিন বার দেশের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। সব মিলিয়ে মোট ২০ বছর ধরে তিনি তুরস্কের শাসনক্ষমতা নিজের হাতে ধরে রেখেছেন।
স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে, এর্ডোয়ানের এই জয় তুরস্কের আশেপাশের অঞ্চলে কী প্রভাব ফেলবে? বহির্বিশ্ব, বিশেষ করে আমেরিকা ও রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের উপর কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে? তাঁর এই জয়ে তুরস্কের উদারপন্থী, শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা যেমন হতাশ, তেমনই হতাশ সমাজের সংখ্যালঘু অংশের একাংশও, যাঁদের মধ্যে ছিলেন সমকামী, রূপান্তরকামীরাও (এলজিবিটিকিউ)।
দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকার জেরে এর্ডোয়ান এখন খুবই উদ্ধত ও অসহিষ্ণু। বিন্দুমাত্র বিরোধিতা সহ্য করতে পারেন না। ২০১৬ সালে তাঁকে সরানোর জন্য ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষক, বিচারক, সেনাবাহিনীর সদস্য, সাংবাদিক, আইনজীবী এবং বিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের জেলে পুরেছেন। প্রকাশ্যেই অভিযোগ করেছেন যে, কিছু শক্তি আমেরিকায় বসে তাঁকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে সক্রিয়। তুরস্কের প্রধান শহরগুলিতে তাঁর জনপ্রিয়তা এখন নিম্নমুখী হলেও, গ্রামাঞ্চলের গরিব শ্রেণির মধ্যে, তুরস্কের সমাজের রক্ষণশীল অংশের মধ্যে, এবং বিশেষ করে নারীদের মধ্যে ইসলামি পরিচিতি ধরে রাখার টানে এর্ডোয়ান এখনও আগের মতোই জনপ্রিয়।
অথচ, এর্ডোয়ানের ব্যর্থতাগুলি বার বার সামনে এসেছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসের ভূমিকম্পে তুরস্কের ৫০,০০০ মানুষের প্রাণহানি হলেও তিনি নড়েচড়ে বসতে অনেক সময় লাগিয়ে দেন। দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে, এবং ভোটের আগে মুদ্রাস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম পরাতেও তিনি সফল হননি। তা সত্ত্বেও তাঁর ভোটব্যাঙ্ক তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছে। এমনকি নতুন ভোটারদের (মোট ভোটদাতাদের ৮ শতাংশ) মধ্যে বেশির ভাগই তাঁকে সমর্থন করেছেন।
এক দিক থেকে দেখলে, আধুনিক তুরস্কের জনক মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের পরে আর কোনও নেতা তাঁর মতো তুরস্কের পরিবর্তন ঘটাতে পারেননি। যে বালক দু’পয়সা বাড়তি রোজগারের আশায় লেমোনেড ও তিলের রুটি ফেরি করে বেড়াত, রাজধানী আঙ্কারায় তারই জন্য ৬১৫ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার ব্যয়ে নির্মিত ১১১৫ কামরার রাজকীয় প্রাসাদ এখন সাধারণ তুরস্কবাসীর কাছে সম্ভ্রমমিশ্রিত বিস্ময়ের ব্যাপার।
রাজনীতিতে যোগ না দিলে এই এর্ডোয়ানই ফুটবলার হিসাবে সফল হতে পারতেন। অল্প বয়সে পেশাদার ফুটবলার হিসাবে স্থানীয় ক্লাবের অধিনায়ক হয়ে সাত বছরের মধ্যে পাঁচ বার দলকে চ্যাম্পিয়ন করেন। কিন্তু পরে খেলা ছেড়ে দিতে হয়। ইস্তানবুলের মারমারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্টের ডিগ্রি পেতে ভর্তি হন। প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে উন্নয়নের উপর জোর দেওয়ায় তুরস্কের অর্থনীতি বেশ চাঙ্গা হয়, এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ দারিদ্রের আওতা থেকেবেরিয়ে আসতে পারেন। আমেরিকাকে তিনি বোঝাতে পেরেছিলেন, ইসলাম এবং আর্থিক উন্নয়ন হাত ধরাধরি করে চলতে পারে। এ ভাবেই আমেরিকার ‘পোস্টার বয়’ হয়ে ওঠেন এর্ডোয়ান।
কিন্তু ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর কট্টর স্বৈরাচারীতে পরিণত হন তিনি। বিরোধীদের কড়া হাতে দমনপীড়ন করতে শুরু করেন। এখন নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তাঁকে সিরিয়া থেকে তুরস্কে এসে আশ্রয় নেওয়া ৩৬ লক্ষ শরণার্থীকে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, এটা তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল। দেশের মুদ্রাস্ফীতিতে লাগাম পরানো ও অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার চ্যালেঞ্জও তাঁর সামনে রয়েছে।
পশ্চিমি দুনিয়ার বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান সত্ত্বেও অনেক বিশেষজ্ঞই তাঁকে এক জন বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন নেতা বলে মনে করেন। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে তুরস্কের ভূমিকা ইতিমধ্যেই বহু প্রশংসিত। নেটো সদস্য হিসাবে এক দিকে তুরস্ক ইউক্রেনকে শক্তিশালী ড্রোন এবং অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র সরবরাহ করে চলেছে, অন্য দিকে রাশিয়ার সঙ্গেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। যুদ্ধের মধ্যেই যাতে ইউক্রেনের গম বিভিন্ন দেশে রফতানি অব্যাহত থাকে, সে ব্যাপারে তুরস্ক রাশিয়াকে বুঝিয়ে রাজি করেছে।
তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন এখন তুরস্কে বড় মাপের বিনিয়োগ করছেন। ইতিমধ্যেই রাশিয়া সে দেশের প্রথম পরমাণুকেন্দ্র তৈরি করে দিয়েছে ২০০০ কোটি আমেরিকান ডলার ব্যয়ে। অন্য দিকে, তুরস্কও রাশিয়া থেকে সস্তা দরে তেল কিনে এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চালিয়ে গিয়ে রাশিয়াকে পশ্চিমি দুনিয়া আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করছে। রাশিয়ার সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠতা দেখে বিরক্ত হলেও আমেরিকার এই মুহূর্তে কিছু করার নেই। দেখেশুনে, একটা প্রশ্ন উঠতে বাধ্য— আমেরিকা কি অন্য দেশের সরকার বদলানোর শক্তি অবশেষে হারিয়ে ফেলছে?