গত তিন বছরে একলা হয়ে পড়েছেন রাহুল গান্ধী।
মুজফ্ফরনগরে হিন্দু জাঠ ও মুসলিমদের মধ্যে হানাহানির রক্ত তখনও মুছে যায়নি। ৬২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। তার মধ্যে ৪২ জন মুসলিম। ২০ জন জাঠ। আহত অনেক। পঞ্চাশ হাজার মানুষ ঘরছাড়া। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ শীতের ঘন কুয়াশার মতো জমাট বেঁধে রয়েছে। এই পরিস্থিতির মধ্যেই রাহুল গান্ধী (ছবি) মুজফ্ফরনগরে হিংসা বিধ্বস্ত এলাকায় জাঠদের গ্রামে গেলেন। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তখন অখিলেশ যাদব। জাঠেরা ফুঁসছেন। অভিযোগ, মুসলিমদেরই ক্ষতিপূরণ, ত্রাণ মিলছে। কারণ তাঁরা অখিলেশের ভোটব্যাঙ্ক। জাঠরা কিছুই পাননি।
অন্য কোনও রাজনীতিক হলে সেই ক্ষোভ আরও উস্কে দিয়ে জাঠদের পাশে টানার চেষ্টা করতেন। কিন্তু ওই যে গুলাম নবি আজাদ বলেছেন, রাহুলের মধ্যে রাজনীতির স্বাভাবিক দক্ষতাটাই নেই। জাঠদের মনে মুসলিমদের প্রতি চরম বিদ্বেষের মুখে দাঁড়িয়ে ‘ভাইচারা’-র কথা শোনালেন তিনি। জাঠদের বললেন, মুসলিমরা তো আপনাদের ভাইয়ের মতো। তাঁদের শত্রু ভাবছেন কেন! খুনোখুনির পরে রাহুলের মুখে ‘সৌভ্রাতৃত্ব’-র কথা শুনে জাঠদের গ্রামের মোড়লরা হতবাক!
রাহুল যা করেননি, বিজেপি নেতৃত্ব সেটাই করেছিল। ২০১৩ সালের মুজফ্ফরনগরের সেই হিংসাকে হাতিয়ার করে, জাঠদের মুসলিম বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি তাঁদের কাছে টেনেছিল। তারই সুফল মিলেছিল ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচন ও ২০১৭-য় উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোটে। জাঠরা দু’হাত তুলে বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন। আর কংগ্রেস উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে আরও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিল।
নয় বছর কেটে গিয়েছে। রাহুল গান্ধী এখনও বদলাননি। এক সপ্তাহ পরে তিনি কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ শুরু করতে চলেছেন। প্রায় পাঁচ মাস ধরে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার এই পদযাত্রা চলবে। রাহুল নিজে হাঁটবেন। যাত্রার উদ্দেশ্য, বিজেপি-আরএসএসের ধর্মীয় বিভাজন, মেরুকরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে গোটা দেশকে ফের ঐক্যবদ্ধ করা।
সামনে গুজরাত ভোট। বিশ বছর আগে গুজরাত হিংসার সময় বিলকিস বানোর ধর্ষণ, তাঁর পরিবারের সদস্যদের খুনে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। বিজেপি নেতারা যুক্তি সাজিয়েছেন, ওরা ব্রাহ্মণ সন্তান। অতএব। কর্নাটকে আগামী বছর ভোট। সেখানে পড়ুয়াদের হিজাবে নিষেধাজ্ঞার পরে ইদগার ময়দানে গণেশ চতুর্থী আয়োজনের দাবি উঠেছে। এই চরম মেরুকরণ, ধর্মীয় বিভাজনের মুখে রাহুল ভাবছেন, কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পায়ে হেঁটে গোটা দেশকে ফের ঐক্যবদ্ধ করবেন। মুজফ্ফরনগরে যা পারেননি, এ যাত্রায় তা সম্ভব হবে। তাঁর বিশ্বাস, দেশের মানুষ বিদ্বেষের রাজনীতি নয়, সদ্ভাবের রাজনীতি চান। নাগরিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় রাহুল বলেছেন, “আমার সঙ্গে কেউ চলুক না চলুক, আমি একলাই চলব।”
এই একলা হয়ে পড়ার আশঙ্কা অমূলক নয়। ২০১৯-এ লোকসভা নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেসের ভরাডুবির পদে সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে রাহুল এই একলা হয়ে পড়ার কথা বলেছিলেন। খোলা চিঠিতে লিখেছিলেন, নরেন্দ্র মোদী ও আরএসএসের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে তাঁর মনে হয়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি একা, পাশে কেউ নেই।
গত তিন বছরে রাহুল গান্ধী আরও একলা হয়ে পড়েছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বৃত্তের নেতা দল ছেড়ে বিজেপি বা অন্য দলে পা বাড়িয়েছেন। কংগ্রেসে থেকে তাঁরা নিজেদের কেরিয়ারে কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। এখন গুলাম নবি আজাদের মতো প্রবীণ নেতারাও কংগ্রেস ছাড়ছেন, যাঁদের রাজনৈতিক কেরিয়ারের কয়েক বছর বাকি পড়ে রয়েছে। রাহুল আরও একলা হয়ে পড়ছেন। কিন্তু তিনি অনড়। ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ তাঁর কাছে নাকি তপস্যার মতো।
মুশকিল হল, রাহুলের এই তপস্যার সঙ্গে শুধু তাঁর ভাগ্য নির্ভর করছে না। গোটা কংগ্রেসের রাজনৈতিক ভাগ্যও জড়িয়ে। ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ আসলে কংগ্রেসের সেনাপতি হিসেবে রাহুলের পুনরভিষেক। কততম পুনরভিষেক, কংগ্রেস নেতারাও সে হিসাব গুলিয়ে ফেলেছেন! অনেকটা বলিউডের কোনও খানদানি পরিবারের সন্তানকে সিনেমায় নামানোর মতো। বার বার সিনেমা ফ্লপ করার পরে শেষ চেষ্টা হিসেবে তাঁকে নায়ক সাজিয়ে আরও একটা সিনেমা বানানো হচ্ছে। রাহুলের ভারত জোড়ো যাত্রার ধর্মীয় হানাহানি ভুলে হিন্দু-মুসলমান এক হল কি হল না, তাতে এখনও কংগ্রেসে থেকে যাওয়া নেতাদের কিছু যায় আসে না। তাঁরা চান, রাহুলের এই যাত্রায় কংগ্রেসের পালে ফের হাওয়া লাগুক। মোদীর বিরুদ্ধে সমর্থন মিলুক। ভারত জোড়ো-তে তাই সম্প্রীতির বার্তার সঙ্গে ফুটনোটে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্বের কথাও থাকবে।
ভোটারদের আস্থা অর্জন পরের কথা। রাহুল গান্ধী নিজের দলের লোকদেরই বিশ্বাস করাতে পারেননি, এ ভাবে কংগ্রেসের পালে হাওয়া তোলা সম্ভব! বরাবরই তিনি কংগ্রেসে থেকেও কংগ্রেসের চিরাচরিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। গান্ধী পরিবারের উত্তরসূরি হিসেবে কংগ্রেসের নেতৃত্বে উঠে এসে সংগঠনে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতা তুলে আনার কথা বলেছেন। কংগ্রেসকে তিনি ভোটে জেতার বাহন নয়, সকলকে নিয়ে চলা, আধুনিক, প্রগতিশীল বার্তাবাহক হিসেবে দেখার কথা বলেছেন। কংগ্রেসকে ধর্মীয় বিভাজন ভুলিয়ে সম্প্রীতির বার্তাবাহক হিসেবে দেখতে চাইছেন।
ইতিহাস বলে, এ ভাবে হয়নি। এ ভাবে হয় না। তার জন্য যে মতাদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান সংগঠন দরকার, কংগ্রেসের তা নেই। খোদ মহাত্মা গান্ধীই পারেননি। রিচার্ড অ্যাটেনবরো-র গান্ধী ছবির সেই দৃশ্যটা মনে করুন। অনশনরত গান্ধীর সামনে এক জন হিন্দু এসে বলছে, মুসলিমরা তার সন্তানকে খুন করেছে। তাই প্রতিশোধ নিতে সে-ও এক মুসলিম শিশুকে খুন করে এসেছে। তার জন্য সে নরকে যেতেও রাজি। গান্ধী বললেন, নরক থেকে মুক্তির একটা উপায় রয়েছে। হিন্দুদের হামলায় বাপ-মা হারানো এক মুসলিম শিশুকে খুঁজে বার করে নিজের সন্তান হিসেবে মানুষ করতে হবে।
জাতির জনকের কথা গত পঁচাত্তর বছরে এ দেশের মানুষ কানে তোলেননি। এখন দেশ স্বাধীনের পঁচাত্তর বছর পরে ইদগার ময়দানে গণেশ চতুর্থীর আয়োজনের দাবি তোলা জনতা, হিজাব পরিহিত ছাত্রীকে দেখলে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেওয়া তরুণরা বা বিলকিস বানোর ধর্ষণকারীদের সংবর্ধনা দিয়ে ফেরা প্রবীণরা কোনও এক রাহুল গান্ধীকে তিরঙ্গা হাতে পদযাত্রা করতে দেখে সব বিদ্বেষ ভুলে যাবেন, হিন্দু-মুসলমান একে অপরকে বুকে টেনে নেবে, এ বড়ই কষ্টকল্পনা।
রাহুল গান্ধী আগেও বিজেপির হিন্দুত্ব, উগ্র জাতীয়তাবাদ নিয়ে সরব হয়েছেন। মুশকিল হল, বিজেপিকে তার নিজের খেলাতেই হারানো কঠিন। ধর্ম, হিন্দুত্ব নিয়ে বিজেপির সঙ্গে লড়তে গিয়ে পাঁচ বছর আগে গুজরাতের ভোটের সময়ই এমন প্যাঁচে পড়তে হয়েছিল যে কংগ্রেসকে ছবি-সহ প্রমাণ দিতে হয়েছিল, রাহুল পৈতেধারী হিন্দু। আসলে বিজেপির হিন্দুত্ব, উগ্র জাতীয়তাবাদ, মেরুকরণের মতাদর্শের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতার মতাদর্শকে হাতিয়ার করে লড়তে নামা বস্তাপচা রণকৌশল। তার বদলে নতুন কোনও ভাবনার দরকার ছিল, যা দিয়ে সহজেই ভোটারদের নজর কাড়া যায়।
লক্ষণীয়, ২০১৪-য় লোকসভা ভোটে জিততে মোদী বিজেপি-আরএসএসের মতাদর্শকে হাতিয়ার করেননি। হিন্দুত্ববাদীদের নেতা তিনি ছিলেনই। কিন্তু ভোটে জিততে তাঁকে আরও টুপি পরতে হয়েছিল। কখনও উন্নয়নের আইকন, কখনও গরিব, অনগ্রসর পরিবারের সন্তান, কখনও চাওয়ালা, কখনও বয়সে প্রবীণ, মনে নবীন, কখনও অচ্ছে দিনের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। ক্ষমতায় বসে তার পর তিনি আরএসএস আদর্শকে সামনে এনেছেন।
রাহুল ভোটে জেতার আগেই ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মতাদর্শ আঁকড়ে ধরেছেন। শুধু তাতে ভর করে নরেন্দ্র মোদীকে হারানো কঠিন। “আমি চাই হিন্দু নেতার সালমা খাতুন পুত্রবধূ, আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু”— গানের কথা হিসেবেই চলে। রাজনীতির স্লোগানে নয়।