দলমত নির্বিশেষে নেতাদের অহমিকা, বাগাড়ম্বর, স্পর্ধা
Political Violence

আমাদের আমল কবে আসবে

সরকার-শাসক-বিরোধী, সব বড়, মেজো, সেজো ছোট নেতাই প্রণাম নিতে অভ্যস্ত। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেলে কিন্তু কেউ আটকান না, কারণ তাঁরা মনে করেন ওটাই প্রাপ্য।

Advertisement

ঈশানী দত্ত রায়

শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৩ ০৬:৩০
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

সেলুলয়েডের পর্দায় ভারতসম্রাট আকবরের সামনে আনারকলি গাইছেন, পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া। ভালবাসায় ভয় কিসের— খুদা আর বান্দার মধ্যে কোনও আড়াল নেই, তাই গোপনীয়তাও কিছু নেই। স্বয়ং খুদা আর আমার মধ্যেই যখন কোনও আড়াল নেই, তা হলে খুদার আর এক বান্দা ভারতসম্রাটকে ভয় পাওয়ারই বা কী আছে? বান্দাই তো।

Advertisement

হায় আনারকলি! খুদার সামনে সব অকপটে বলতে পারলেও খুদার বান্দার সামনে সেই সাহস দেখানোর পরিণতি হয়েছিল জ্যান্ত কবর।

আমাদেরও সেই দশা, বান্দাদের এত দাপট যে মানুষ যাচ্ছে হারিয়ে। জ্যান্ত কবরই বটে। ইউএপিএ দিয়ে কারাগারে ঠেলে দেওয়া, হঠাৎ ‘ভ্যানিশ’ করে দেওয়া, মাওবাদী, সন্ত্রাসবাদী, দেশদ্রোহী বলে দেগে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের লোকজনের হাবভাব এই রকম হবে কেন?

Advertisement

কিছু উদাহরণ নেওয়া যাক। এক, আমার সরকারের আমলে এই হল, আপনাদের সরকারের আমলে কী হয়েছিল। দুই, আমার সরকারের আমলের আগে তো কিছুই হয়নি। তিন, বিজলি, রাস্তা হয়েছে কি হয়নি? চার, অনেক দিয়েছি, আর দিতে পারব না।

দলমত নির্বিশেষে এই বাগাড়ম্বর শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত। গণতন্ত্রে সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত, জনগণের অর্থ তাদের কল্যাণে কাজে লাগাবে, এটাই তো মূল কথা। কিন্তু তা হয় কোথায়? ক্ষমতায় যে-ই আসুক, জনগণকে তারা ‘দিচ্ছে’, আর জনগণ ‘পাচ্ছে’, এই বুলিতে শাসক দলের নেতা-নেত্রী, প্রশাসক, বিরোধী নেতা-নেত্রী বলতে অভ্যস্ত, আমরাও শুনতে অভ্যস্ত। আমরা-ওরা শুধু শাসক-বিরোধী দলের বিভাজন নয়, প্রশাসক, রাজনৈতিক দল এবং জনগণেরও বিভাজন।

শাসক দলের এক কুচো নেত্রীর ভাষণ দেখলাম ভিডিয়োয়। বলছেন, “উনি যদি মনে করতেন, ক্ষমতায় এসে গিয়েছি, এর পর টাকা কামাব, আরামে থাকব, ফুলে ফেঁপে উঠব, তা তো উনি করেননি...।” প্রশ্ন হল, করবেনই বা কেন? না-করাই তো স্বাভাবিক। মুশকিল হল, সাধারণের প্রতিনিধি সাধারণ থাকবেন, এটাই এখন যেন অস্বাভাবিক। খুদা আর বান্দার মাঝখানে পর্দা নেই, কিন্তু জনগণ আর ‘জনসেবক’-এর মধ্যে ব্যবধান বিস্তর।

কয়েক সপ্তাহ আগে এই সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় এক বান্দার ছবি ছাপা হয়েছিল। গলায় গাছবোমার মালা, মোটরবাইকে বসে আরামসে জয়ের উৎসব পালন করছে। ছবি দেখেই বোঝা যায়, এই ভাবে এলাকার লোককে ভয় দেখাতে সে খুব অভ্যস্ত এবং এতে তার মজাও লাগে। সে যদি নিজেকে এলাকার বা পাড়ার মালিক ভাবে, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। আসলে সে ভাল ভাবেই জানে, সে বান্দার বান্দারও বান্দা। এই মোটরবাইক, এই বোমার মালা, এই প্রতিপত্তি, এই ভয় দেখানো সবই আর এক কুচো বান্দার দেওয়া। তার পুরো অস্তিত্বই নির্ভরশীল ওই মোটরবাইক আর বোমার মালার উপরে। সেগুলো সরিয়ে নিলে সে কেউ নয়। তার মালিকও আদতে কেউ নয়। এই ভাবে উপরে উঠতে উঠতে দেখা যাবে, জনগণের ভোটে পাওয়া একটি চেয়ার শক্তির উৎস। সেটা ক্রমশ টাকা, অস্ত্র, মোটরবাইক, এমনকি, একটি সাদা থানে গিয়ে পৌঁছয়। যেমন এই মোটরবাইক বাহিনী সব দলই পোষে। ৫টি ষণ্ডাগুন্ডা ছেলেও যদি মোটরবাইক হাঁকিয়ে এক সঙ্গে যায়, তবেও আপনি ভাববেন কী দাপট, অনেকেই ভয়ে ঘরে ঢুকে যাবেন। সেটাই স্বাভাবিক। মুখে বলা হবে জনগণের সরকার, অথচ তার অস্তিত্বটা দাঁড়িয়ে থাকবে ভয়ের উপর।

আর একটা উদাহরণ দেখুন। সরকার-শাসক-বিরোধী, সব বড়, মেজো, সেজো ছোট নেতাই প্রণাম নিতে অভ্যস্ত। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেলে কিন্তু কেউ আটকান না, কারণ তাঁরা মনে করেন ওটাই প্রাপ্য। অসহায় মানুষ পা জড়িয়ে ধরলে তো আরও ভাল। যে ভোটে নেতা হয়েছেন বা চেয়ারে বসেছেন, তাতে ওই মানুষটারও ভোট ছিল। কিন্তু অবস্থা এমনই যে তিনি ‘জনসেবক’কে ‘হুজুর মা-বাপ’ বলে পা জড়িয়ে ধরছেন, আর হুজুরও ভাবছেন, এ তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকার। আর শাসক দলের নেতা-নেত্রী বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তাঁদের দল সংযত না থাকলে আরও কিছু ঘটতে পারত। সংযত থাকারই তো কথা। যা স্বাভাবিক, যা ন্যায্য, তা তো কৃতিত্ব হতে পারে না, হতে পারে না দম্ভের অঙ্গ।

আসলে রাজধর্ম পালন করাটাই ধর্ম, সেটা পালন করলে কৃতিত্ব জাহির করা হাস্যকর। অবশ্য রাজধর্ম পালন করার প্রশ্নই তো আসছে না।

মণিপুরের ঘটনা তো তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। মাথা নিচু করে ক্ষমা চাওয়া দূরে থাক, ‘আপনার রাজ্যে এই হয়েছে, তার বেলা?’ ইত্যাদি শুরু হয়ে গিয়েছে। একেই বলে দুঃসহ স্পর্ধা। মূলে কিন্তু ওই এক মনোভাব। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে জনগণকেই জুতোর সুখতলা ভাবা। ভাবখানা হল, দুয়েকটা ভাতের দানা ছুড়ে দেব, খাবি আর ধন্য ধন্য করবি। মাংস দিলে তো কথাই নেই। নইলে দিলাম, পেলেন, করে দিয়েছি, বিজলি মিলা কি নহি, শব্দবন্ধ আসে কোথা থেকে? কে চাল দিল, কে জল দিল, কে বাড়ি করে দিল, তার ছাপ দিতে ব্যস্ত আপনারা। টাকাটা জনগণের করের, তাঁদের প্রাপ্র্য তাঁরা পাবেন। সেখানে অন্নদাতা সাজার প্রতিযোগিতা কেন? আমার দল, আপনার দল করে মৃতদেহের হিসাব হয়? নগ্ন করে দেওয়ার তুলনা হবে রাজ্য দেখে?

রোগটা নতুন নয়। কিন্তু এখন ফেটে পুঁজ, রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

বেশি দিনের পুরনো কথা তো নয়, মণিপুরে আধা সামরিক বাহিনীর কয়েক জন জওয়ান ধর্ষণ করে, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছিল মনোরমা নামের একটি মেয়েকে। তার প্রতিবাদে মায়েরা নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। বাকি ভারত ভয়ে চোখ বন্ধ করেছিল। সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা সংক্রান্ত আইন তোলার দাবিতে অনশন শুরু করেছিলেন শর্মিলা ইরম চানু নামের একটি মেয়ে। একা। তাঁর মা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন এবং করিয়েছিলেন, ওই আইন প্রত্যাহার না হলে মেয়ের মুখ তিনি দেখবেন না। শর্মিলার সমর্থনে হাসপাতালের সামনে তাঁবু খাটিয়ে রিলে পদ্ধতিতে অনশন করতেন অসংখ্য মহিলা, মাসের পর মাস সংসার ছেড়ে। তাঁদের প্রণাম করলে তাঁরা আশীর্বাদ করতেন চাল, নারকোল আর চাঁপাফুল দিয়ে। যাতে সমৃদ্ধি, জ্ঞান হয়, অন্তর হয় চাঁপাফুলের মতো সুগন্ধে ভরা। নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ জানানো এক মা ঝরঝর করে কেঁদেছিলেন মনোরমার কথা বলতে গিয়ে। তিনি মনোরমাকে চিনতেন না। যে নিরাপত্তাকর্মীদের দায়িত্ব ছিল হাসপাতালে শর্মিলাকে পাহারা দেওয়ার, তাঁরাই আগলে রাখতেন শর্মিলাকে। বাইরে দেশেরই সেনার বেয়নেট তাক করা দেশেরই মানুষের দিকে। ভালবাসা, সহমর্মিতা কাকে বলে, এই দেশই শেখায়। কিন্তু ক্ষমতায় পুচ্ছভারী বান্দারা তা শেখেন না। বরং ছোট ছোট লঙ্কা গড়ে রাবণ হয়ে বসেন। ওই গাছবোমাধারী যুবকের মতো।

তাঁরা ভুলে যান, একটা চেয়ার সরতে সময় লাগে না। ভারতের প্রতিটি খেতে না-পাওয়া মানুষ, প্রতিটি নিগৃহীতা মেয়ে এক দিন যদি নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে যায় ভারত জুড়ে, কৃষক মিছিলে হাঁটা ঘায়ে দগদগে পা যদি উঠে আসে মুখের সামনে!

সহ্য করতে পারবেন তো জনগণের বান্দারা?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement