—প্রতীকী চিত্র।
দুপুরের ঘুম শেষ করে মোবাইল হাতে তুলতেই দেখি একটা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ। এক বন্ধুর প্রশ্ন— আমেরিকা-কে কি ‘ইললিবারাল ডেমোক্র্যাসি’ বলা যাবে?
প্রশ্ন খুব সহজ, উত্তর ততটা নয়। পেরু, ফিলিপিনস, হাঙ্গেরি, তুরস্ক, পোল্যান্ড বা ভেনেজ়ুয়েলাকে যত সহজে ‘ইললিবারাল ডেমোক্র্যাসি’ বলে দেওয়া গিয়েছিল, অথবা বলে দেওয়া যায়; ‘ইউনাইটেড স্টেটস’-এর ক্ষেত্রে সেটা বলা অত সহজ নয়। তত্ত্বগত ভাবে, যদি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন লিবারাল ডেমোক্র্যাসির প্রাথমিক সংজ্ঞা হয়, তবে এই কথাও স্মরণে রাখা বিধেয় যে— ট্রাম্পের আমলে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ উঠেছে।
‘ইললিবারাল ডেমোক্র্যাসি’-র বাংলা কী হয়? রক্ষণশীল গণতন্ত্র? না কি সঙ্কীর্ণ গণতন্ত্র? সঙ্কীর্ণ গোষ্ঠীতন্ত্র আমরা শুনেছি, অলিগার্কি। কিন্তু, ‘সঙ্কীর্ণ গণতন্ত্র’ কথাটা কেমন কানে লাগছে না? লাগারই কথা। কেননা, গণতন্ত্রের সঙ্গে রক্ষণশীল অথবা সঙ্কীর্ণ কথাগুলো এক সঙ্গে যায় না। গণতন্ত্র, যা অনেক লড়াইয়ের ফল, একটি আধুনিক ধারণা, তা কী করে রক্ষণশীল বা সঙ্কীর্ণ হয়?
নির্বাচনী সন্ত্রাসের পরে গণতন্ত্র ভূলুণ্ঠিত কথাটা ব্যবহৃত হলেও, গণতন্ত্রের অর্থ এখন আর কেবল ভোটাধিকার এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। গণতন্ত্র একটা স্পেস, একটা ভাবনা, একটা আদর্শ— যা নিজের বিপরীত কিছুকে স্বীকৃতি দিতে এবং তাকে গ্রহণ করতে শেখায়। ভিন্ন মত, ভিন্ন রুচি-সহ সব রকমের ভিন্নতাকে স্বীকৃতি দিতে শেখায়। আর এই কারণেই হয়তো গণতন্ত্রের আগে রক্ষণশীল বা সঙ্কীর্ণ কথাগুলো কেমন যেন বেঁধে।
‘ইললিবারাল ডেমোক্র্যাসি’ নিয়ে এখন আবার নতুন করে কথাবার্তা চলছে। উঠে আসছে গত শতকের শেষ দশকের মাঝামাঝি ড্যানিয়েল বেল, ডেভিড ব্রাউনদের লেখা বইয়ের কথা। কী থেকে এই স্ফুলিঙ্গ জন্ম নিল? কয়েক দিন আগে দেশবিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত থাকার অভিযোগে নিউজ়ক্লিক-এর সম্পাদক ও এক আধিকারিককে ইউএপিএ আইনে গ্রেফতার করে দিল্লি পুলিশ। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যমের উপর এই রোষ নতুন নয়। গত বছর ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইট অল্ট নিউজ়-এর সাংবাদিক মহম্মদ জ়ুবেরকে গ্রেফতার করেছিল দিল্লি পুলিশ।
গণতন্ত্র, যা আসলে বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলে, পূর্বতন বাম শাসনে আমরা তার বিপরীত, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি বহু বার শুনেছি। এই বছর বিশিষ্ট চিন্তক অধ্যাপক অম্লান দত্তর জন্মশতবর্ষ চলছে। অম্লান দত্ত সারা জীবন বলে গিয়েছেন গণতন্ত্রের উচ্চ আদর্শের কথা। এখন মনে হয়, গণতন্ত্র এমন এক উচ্চস্তরের ধারণা— যার সঙ্গে সুবিধামতো সব কিছুই যেন ফিট করিয়ে দেওয়া যায়। এই ক্ষণে স্মরণ রাখা বিধেয় যে, উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতের গণতন্ত্র কিন্তু একটা জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়েও গিয়েছে। আবারও তেমন সময় এসেছে, এ বারের জরুরি অবস্থা আরও কঠিন, অনেকে বলছেন।
একটি বাংলা অনলাইন পোর্টালে পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা লিখেছেন, সম্প্রতি ইউএপিএ আইনে আটক হওয়ার অভিজ্ঞতা। কী ভাবে ভোরবেলা ন’জন পুলিশকর্মী তাঁর বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, প্রথমে ঘরে ঢুকে প্রায় দু’ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এর পর ওঁকে নিয়ে যান স্পেশাল সেলের অফিসে। সকাল দশটা থেকে সন্ধে ছ’টা পর্যন্ত চলে স্পেশাল সেলের অফিসে আটক ও জিজ্ঞাসাবাদ। সিজ়ার মেমো দিয়ে ফোন, সিম কার্ড নিয়ে খুঁটিয়ে দেখা। কী কী বিষয়ে লিখেছেন, কাদের সঙ্গে কথা হয়— সব জানতে চাওয়া।
পাশ্চাত্যে এই গণতন্ত্র যেমন নিজের রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াই করে বুঝে নেওয়া অধিকার, উত্তর-ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলির ক্ষেত্রে এই গণতন্ত্র উপনিবেশ-বিরোধী লড়াইয়ের ফসল হিসাবে ঔপনিবেশিক শাসন মুক্তির সঙ্গেই সমান্তরাল ভাবে এসেছে। গণতন্ত্র আসলে কোনও ‘ওয়ান টাইম ইনভেস্টমেন্ট প্রজেক্ট’ নয়। গণতন্ত্রেরও নিজস্ব ওঠাপড়া থাকে। তাই, নাগরিকেরও দায়িত্ব থাকে ক্রমাগত তার উপর নজর রাখার। সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনে নাগরিকের সচেতন যোগদান গণতন্ত্রের যথাযথ অভিমুখ নির্ধারণ করতে পারে।