অবমানিতা: টুম্পা কয়াল আর মৌসুমী কয়ালকে নিয়ে কামদুনির শিক্ষকদের মিছিল, বারাসত, ২৯ জুন ২০১৩।
আইনসভা আইন পাশ করে, কিন্তু আইনের দাবি আসে জনসাধারণের থেকে। আজকের দাবি— ধর্ষণের অভিযোগ পুলিশ গ্রহণ করার পরে, অভিযোগের সত্যতা নিয়ে সর্বসমক্ষে প্রশ্ন তোলা আইনত নিষিদ্ধ করতে হবে। মামলায় যিনি অভিযুক্ত, সেই ব্যক্তি(রা) আত্মপক্ষ সমর্থনে জনসমক্ষে বক্তব্য রাখতে পারেন। কথা বলতে পারেন অভিযোগকারিণীও। আর কেউ, বিশেষত পুলিশ-প্রশাসনের পক্ষে কোনও ব্যক্তি, প্রশ্ন করতে পারেন না, মেয়েটি মিথ্যা অভিযোগ করেছে কি না, কী তার ‘প্রকৃত’ উদ্দেশ্য।
ধর্ষিতার বয়ান নিয়ে সংশয় তোলে, তেমন ভিডিয়ো-অডিয়ো প্রভৃতি সাক্ষ্য তৃতীয় পক্ষের কারও হাতে থাকতেই পারে। কিন্তু তার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য পেশ করতে হবে পুলিশের কাছে, বা আদালতে। অপরীক্ষিত তথ্য প্রচার করা অনৈতিক, সৎ সাংবাদিকতার পরিপন্থী। সেই নৈতিক বিধি গণমাধ্যম উপেক্ষা করছে। অতএব আইনই ভরসা। ধর্ষিতার বয়ানে সন্দেহ জাগাতে পারে, এমন বয়ানের প্রচার বেআইনি করা দরকার। সমাজমাধ্যমে তা কেউ ‘শেয়ার’ করলে শাস্তি হওয়া চাই সেই ব্যক্তি বা সংগঠনের।
এই আইনের প্রয়োজন দেখাল সন্দেশখালি। রাজ্যের শাসক দল ‘স্টিং অপারেশন’-এর অপরীক্ষিত ভিডিয়ো ব্যবহার করে ধর্ষিতাকে মিথ্যাবাদী বলে দাবি করছে। কী উদ্দেশ্যে ওই ভিডিয়ো তৈরি হল, সেটা ‘ফেক’ কি না, উত্তর মেলার আগেই মেয়েদের উপর প্রবল চাপ তৈরি হল। কেন্দ্র এবং রাজ্যে ক্ষমতাসীন দু’টি দল ধর্ষিত মেয়েদের সুরক্ষিত রাখা, সুবিচারের আশ্বাসের পরিবর্তে বিবেকহীন ভাবে তাদের ব্যবহার করছে। চাপ দিয়ে অভিযোগ দায়ের, চাপ দিয়ে প্রত্যাহার, এ সব মর্মান্তিক ঘটনার নাটকীয় প্রচার চলছে। ধর্ষণকে নির্বাচনী ‘খেলা’-য় নামিয়ে এনেছে দু’টি দলই।
পাশাপাশি, রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের বিরুদ্ধে এক মহিলা কর্মী যৌন হয়রানির অভিযোগ করলে, রাজভবনের তরফে কিছু সিসিটিভি-র ফুটেজ দেখানো হয় জনসমক্ষে। তাতে অভিযোগকারিণীর মুখ গোপন করা হয়নি। এ কেমন বিবেচনা?
আরও ভীতিপ্রদ সরকারের ভূমিকা। মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধর্ষণের অভিযোগকে মিথ্যা বলে দাবির পাশাপাশি তা ‘রাজ্যের লজ্জা’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি ‘এক্স’ হ্যান্ডেলে লিখেছেন, একটা গোটা রাজ্য এবং তার সমস্ত নাগরিককে বদনাম (‘ম্যালাইন’) করার জন্য কেন্দ্রের শাসক দল সন্দেশখালিতে ধর্ষণের অভিযোগ এনেছে, যা ইতিহাসে নজিরবিহীন।
মেয়েরা দেখছে আর এক নজির, তা উত্তরপ্রদেশের। সেখানেও ধর্ষিতার বয়ান নস্যাৎ করছিল সরকার। হাথরসে ঠাকুর সম্প্রদায়ের চার দুষ্কৃতী এক উনিশ বছরের দলিত কন্যাকে ধর্ষণ ও খুনের চেষ্টার (২০২০) পরে রাজ্যের তথ্য ও জনসংযোগ দফতর ওই ঘটনাকে ‘ফেক নিউজ়’ আখ্যা দিয়েছিল। একাধিক পুলিশ আধিকারিক বিবৃতি দিয়েছিলেন, ধর্ষণ ঘটেনি, এই অভিযোগ যোগী সরকারের সম্মানহানির জন্য আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। যোগী আদিত্যনাথ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তাঁর সরকারের উন্নয়নের কাজে যাঁরা বিচলিত, তাঁরা হাথরসের ঘটনার ফয়দা ওঠাচ্ছেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সমাজমাধ্যমে বলেছেন, বাংলার প্রগতিশীল চিন্তা ও সংস্কৃতির প্রতি যারা বিদ্বেষী, সেই বাংলা-বিরোধীরা গণধর্ষণের অভিযোগ এনেছে।
দু’টি রাজ্যে দু’টি ক্ষমতাসীন দল যে ভাবে অবস্থান নিয়েছে ধর্ষিতার বিরুদ্ধে, তাদের অপদস্থ করতে রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যবহার করছে, এই দু’টি ঘটনা তার দৃষ্টান্তমাত্র। বহু ঘটনায় পুলিশ বা সরকারি চিকিৎসক মন্তব্য করেন, মেডিক্যাল পরীক্ষায় (বা প্রাথমিক তদন্তে) ধর্ষণের প্রমাণ মেলেনি। এ-ও ধর্ষিতার বয়ানে সংশয় তৈরি করে। রাশ টানতে আইন সংশোধন প্রয়োজন।
কেউ আপত্তি করতে পারেন, এই নিষেধাজ্ঞা কি বাক্স্বাধীনতার বিরোধী নয়? রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে ধর্ষণের অভিযোগ করা হয়েছে বলে যদি কেউ মনে করে, তা সকলকে বলায় বাধা কোথায়? এর উত্তর— ধর্ষণকে রাজনৈতিক বিতর্ক থেকে বাদ দেওয়া হবে না। ধর্ষণের তথ্য-পরিসংখ্যান, তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা, পুলিশ-আদালতের তৎপরতা, এমন সব কিছু নিয়েই শাসক-বিরোধী তরজা চলতে পারে। কেবল অভিযোগের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। কারণ, নিগৃহীত মেয়েদের বয়ানকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে ভারতের আইন। যেমন, অভিযুক্ত যদি সহমতের ভিত্তিতে সহবাসের দাবি করে, তা হলে তাকেই সহমতের প্রমাণ দিতে হবে। এই সুরক্ষা বরাবর ছিল না। মথুরা ধর্ষণ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট পুলিশ থানায় দুই পুলিশকর্মীর দ্বারা ষোলো বছরের এক আদিবাসী বালিকার ধর্ষণকে ‘সহমতের ভিত্তিতে সহবাস’ আখ্যা দেওয়ার পরে (১৯৭৪) দেশ জুড়ে আন্দোলন করেন মেয়েরা। তাঁরা মনে করান, নিগৃহীত মেয়েটিকেই ‘অপরাধী’ বলে দেখে সমাজ, নানা লাঞ্ছনা তাকে সইতে হয়। ভয়, লজ্জা অতিক্রম করে যে মেয়েরা থানায় যান, তাঁদের কথাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার। বহু লড়াইয়ের পরে ১৯৮৩ সালে আইন সংশোধন হয়, কিছুটা হলেও সুরক্ষা বাড়ে মেয়েদের।
সুপ্রিম কোর্ট বেশ কিছু রায়ে নিগৃহীতার বয়ানকে অপরাধের সমর্থনকারী সাক্ষ্য-প্রমাণের (করোবরেটিভ এভিডেন্স) চাইতেও বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। একটি মামলায় (ভারওয়াড়া বনাম গুজরাত সরকার, ১৯৮৩) সুপ্রিম কোর্ট বলে, “ধর্ষণ বা যৌন নিগ্রহের অভিযোগ যে মহিলা বা বালিকা করবে, কেন তার সাক্ষ্যকে সংশয় বা অবিশ্বাসের চশমা দিয়ে দেখা হবে? তেমন করলে পুরুষ-প্রধান সমাজে পুরুষের প্রতি পক্ষপাতিত্বকেই (মেল শভিনিজ়ম) প্রতিষ্ঠা করা হয়।”
চার দশক পরে দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো মেয়েদের কথার প্রতি সংশয়কে রাজনৈতিক লড়াইয়ের হাতিয়ার করে তুলেছে। ধর্ষণকে ‘পরিবারের লজ্জা’ থেকে নেতারা এখন ‘রাজ্যের লজ্জা’ বলে দাগিয়ে দিচ্ছেন। কোনও দল প্রশ্ন করছে না, এর মানে কী দাঁড়ায়? ‘আমার জন্য বাবা-মায়ের বদনাম হবে, বোনেদের বিয়ে হবে না’ এই অপরাধবোধ থেকে মেয়েরা ধর্ষণের অভিযোগ লেখাত না। পুলিশও ‘পারিবারিক কেলেঙ্কারি’-র ভয় দেখিয়ে বাইরে মিটমাট করে নিতে বলত।
এ বারে সেই ভয় দেখানো ফিরিয়ে আনা হচ্ছে আরও জোরের সঙ্গে— ‘তুই কি রাজ্যের বদনাম করতে চাস?’ ধর্ষণের অভিযোগের সঙ্গে লজ্জাবোধকে সংযুক্ত করার এ হল এক অবধারিত পরিণাম। ভারতে নারী আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুমাত্র ধারণা থাকলে বোঝা যায় যে, ধর্ষণের অভিযোগকে ‘অপবাদ’ আখ্যা দিলে দেশকে পিছিয়ে দেওয়া হয়।
স্বয়ং পুলিশমন্ত্রী যদি এক বিচারপ্রার্থীর বয়ানে সংশয় প্রকাশ করেন, তা হলে তার অভিযোগের যথাযথ তদন্ত পুলিশ করবে, তার সম্ভাবনা কতটুকু? একটি মেয়ের প্রতি পুলিশ-প্রশাসন প্রকাশ্যে সংশয় প্রকাশ করলে সব মেয়েরই বিপন্নতা বাড়ে।
এ কেমন রাজনীতি, যা বার বার ধর্ষিতাকে সরকারের প্রতিপক্ষ করে তোলে? পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের মেয়েটি ‘মিথ্যেবাদী’, কামদুনির টুম্পা-মৌসুমী ‘মাওবাদী’, বীরভূমের সাত্তোরে পুলিশের হাতে নির্যাতিতা গৃহবধূ ‘ডেঞ্জারাস মেয়ে’— রাজনীতির এই বয়ান কার স্বার্থে? কোন মুখে এই নেতা-নেত্রীরা মেয়েদের ভোট চান?
নিগৃহীত মেয়েদের সুরক্ষা যদি না-ই দিতে পারে সরকার, অন্তত অসম্মান করা বন্ধ করুক। ধর্ষিতার বয়ানের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা আইনত নিষিদ্ধ হোক। ধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে প্রকাশ্যে সন্দেহ প্রকাশ করলে শাস্তি হোক জনপ্রতিনিধিদের।