প্রতিরোধরত সন্দেশখালির মেয়েরা আর জনবাদী রাজনীতি
Sandeshkhali Incident

এই মেয়েরা কি পারবেন?

মহিলা জনপ্রতিনিধি ও নেতা সংখ্যায় বাড়ানোর দাবির সঙ্গেই আসে মহিলা নির্বাচকদের ‘স্বার্থ’ আইনসভা ও শাসনযন্ত্রে তুলে ধরার প্রসঙ্গও।

Advertisement

প্রমা রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:১৫
Share:

সাহসিকা: প্রতিবাদে প্রতিরোধে শামিল ক্ষুব্ধ মহিলারা, সন্দেশখালি, ২৫ ফেব্রুয়ারি। — ফাইল চিত্র।

সন্দেশখালি কিছু কথা আমাদের মনে করিয়ে দিল। বিগত কিছু নির্বাচনে মহিলা ভোটারদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি ও স্বকীয়তা ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে তাঁদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামাজিকবর্গ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। রাজ্যে রাজ্যে দলীয় মতাদর্শ নির্বিশেষে তাই মহিলাদের জন্য জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের ছড়াছড়ি ও আগামী লোকসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখে বিভিন্ন প্রকল্পের বরাদ্দ বাড়ানো ও অন্যান্য প্রতিশ্রুতির মেলা। আপাত স্থিতিশীল এই ‘লাভার্থী’ মহিলা ভোটবর্গকে আন্তঃসামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিশ্লেষণ করলে অবশ্য তাঁদের দাবিদাওয়ার বৈচিত্র, আর্থসামাজিক অবস্থানের বিভিন্নতা চোখে পড়বে। এর সঙ্গেই আসে মহিলা নির্বাচকমণ্ডলী ও ক্ষমতাসীন জনপ্রতিনিধি ও নেতৃবর্গের মধ্যেকার সম্পর্কটিও যা পশ্চিমবঙ্গে ইদানীং কালে সন্দেশখালির মতো ঘটনাপ্রবাহকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে।

Advertisement

রাজনৈতিক ক্ষমতায় পুষ্ট সমাজবিরোধীদের দীর্ঘকালীন শোষণের বিরুদ্ধে সন্দেশখালির মহিলাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের দৃশ্য আমাদের প্রভাবিত করার সঙ্গে সঙ্গে জনবাদী রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের সংজ্ঞা নতুন ভাবে চিনতে শেখায়। নির্বাচনী গণতন্ত্রে মহিলা জনপ্রতিনিধিদের স্বল্প উপস্থিতি এক সুদীর্ঘকালীন কাঠামোগত সমস্যা। এর দাওয়াই হিসাবে মহিলাদের জন্য আইনসভায় আসন সংরক্ষণ অনেক দেশেই প্রণয়ন করা হয়েছে, যেমন গত বছরে তৈরি নারী শক্তি বন্দন অধিনিয়ম। জেন ম্যানসব্রিজ-সহ বিভিন্ন নারীবাদী গবেষকেরা পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে লিখেছেন যে, মহিলা জনপ্রতিনিধিরা সংখ্যায় বাড়লে একটা নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়। সেটা হল— তাঁরা তাঁদের বিশেষ আর্থসামাজিক অবস্থান-সঞ্জাত মূল্যবান অভিজ্ঞতা আইনসভায় এনে আইন প্রণয়নকে সংবেদনশীল হতে সাহায্য করতে পারেন। কার্যক্ষেত্রে এই সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হবে কি না, তা নির্ভর করে দলীয় নীতি, মহিলা জনপ্রতিনিধিদের শ্রেণিপরিচয়, ব্যক্তিগত মতাদর্শ ইত্যাদি বিভিন্ন বাহ্যিক উপাদানের উপরে।

মহিলা জনপ্রতিনিধি ও নেতা সংখ্যায় বাড়ানোর দাবির সঙ্গেই আসে মহিলা নির্বাচকদের ‘স্বার্থ’ আইনসভা ও শাসনযন্ত্রে তুলে ধরার প্রসঙ্গও। নির্বাচকমণ্ডলীর প্রতি জনপ্রতিনিধিদের গণতান্ত্রিক দায়িত্ব বোঝাতে রাজনীতি তাত্ত্বিক হানা পিটকিন এনেছিলেন তাঁর ‘রেসপনসিভনেস’ বা ‘প্রতিবেদনশীলতা’র ধারণা। যদিও ‘মহিলা স্বার্থ’ বিষয়টি জটিল ও বিবিধ অন্তর্দ্বন্দ্বে দীর্ণ তবুও মহিলা জনপ্রতিনিধি ও নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মহিলা-ভোটারদের কিছু সাধারণ আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আবেগ জড়িয়ে থাকে। এস্থার দুফলোর গবেষণায় যেমন উঠে আসে বাংলার গ্রামসভায় মহিলাদের সক্রিয় যোগদানের সঙ্গে মহিলা পঞ্চায়েত প্রধানের উপস্থিতির সম্পর্ক।

Advertisement

জনপ্রতিনিধি ও নেতৃত্বের সঙ্গে নির্বাচকমণ্ডলীর এই আবেগপূর্ণ যোগাযোগ সমসাময়িক জনবাদী রাজনীতিরও এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গে জনবাদী ব্যক্তিকেন্দ্রিক দল তৃণমূল কংগ্রেসের ধারাবাহিক নির্বাচনী জয়ের পিছনের অন্যতম কারণ হিসাবে অনেক পর্যবেক্ষকই তুলে এনেছেন নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মহিলা-ভোটারদের আবেগময় সংযোগকে। বিভিন্ন বয়সের ও আর্থসামাজিক বর্গের মহিলাদের জন্য তাঁর সরকারের জনকল্যাণমূলক প্রকল্প মহিলা-ভোটারদের তৃণমূলের প্রতি সমর্থন দৃঢ় করেছে, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজস্ব ভাবমূর্তি ও বিশেষ রাজনৈতিক রূপকল্পনা, যা তাঁকে ‘দিদি’ বা ‘বাংলার ঘরের মেয়ে’ হিসাবে পরিবেশন করেছে আম জনসাধারণের কাছে ।

জনবাদী রাজনীতির তাত্ত্বিকদের মধ্যে অনেকেই এই মত পোষণ করেন যে, এই ধরনের রাজনীতিতে ‘জনতা’ বা ‘পিপল’ চিরন্তন ভাবে বিদ্যমান থাকে না, জনবাদী আন্দোলন ও তার নেতৃত্বের ভাষ্যের মাধ্যমে তা আকার পায়। ক্ষেত্রবিশেষে এই ‘মানুষ’ বা ‘জনতা’র ধারণার গঠনে মতাদর্শগত বৈচিত্র থাকলেও কিছু নির্দিষ্ট গুণাবলি দেখা যায়, যেমন রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা, নৈতিক বিশুদ্ধতা ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের জনবাদী রাজনীতির ক্ষেত্রে এই ‘মানুষ’ গঠনের প্রক্রিয়া প্রতিভাত হয়। যেমন, মুখ্যমন্ত্রী তাঁর জনসভায় একাধিক বার শ্রোতামণ্ডলীর মধ্যে মহিলাদের চিহ্নিত করেন ‘কন্যাশ্রী’, ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ রূপে।

জনবাদী রাজনীতিতে ‘পিপল’, ‘জনতা’ বা ‘মানুষ’-এর ধারণা গড়ার সঙ্গে সমান্তরাল আর একটি প্রক্রিয়াও চলে। তা হল, ‘এলিট’ বা উচ্চবর্গ রূপে একটি গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা, যাঁদের জনতা বা সাধারণ মানুষের শত্রু হিসাবে দাগিয়ে দেন জনবাদী নেতারা। অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষত দক্ষিণপন্থী জনবাদী রাজনীতিতে এর সঙ্গেই যুক্ত হয় একটি ‘অপর’-এর ধারণা, যাদের এই কল্পিত জনতার সামাজিক ‘অপর’রা ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও লিঙ্গভিত্তিক সংখ্যালঘু, সরকারের সমালোচক ইত্যাদি হয়ে থাকেন। পশ্চিমি দুনিয়ায় যেমন, পশ্চিম এশিয়া থেকে আগত শরণার্থীরা দক্ষিণপন্থী জনবাদী রাজনৈতিক দলগুলির ভাষ্যে হয়ে যান ‘অপর’। ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেও এই অপরীকরণের প্রক্রিয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি ইদানীং কালে।

পশ্চিমবঙ্গের শাসক জনবাদীরা মানুষ/জনতাকে সংগঠিত আকার দিয়েছে মূলত বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের সুবিধাভোগী বা লাভার্থী হিসাবে। এর বিপরীতে অবশ্যই উঠে আসে বিরোধী বিজেপির ভাষ্যে ‘হিন্দু’ জনতা বা বামপন্থীদের ‘মেহনতি মানুষ’-এর ধারণা। তৃণমূলের কল্পিত জনতা/মানুষ একই সঙ্গে সরকারি প্রকল্পের সুবিধাভোগী ও অনুগত। তাঁরা ভোটদাতা নাগরিক হয়েও দলনেত্রীর সঙ্গে এক আপাত অবিচ্ছেদ্য আবেগের সম্বন্ধে জড়িত, যা নির্বাচনী গণতন্ত্রের দেনাপাওনার সম্পর্কের ঊর্ধ্বে। মহিলা-ভোটারদের অবস্থান এই কল্পিত মানুষ/জনতার কেন্দ্রে, কারণ তাঁদের স্থিতিশীলতা যা অনেক সময় আনুগত্য বলে ব্যাখ্যা করতে পারেন জনবাদীরা।

সন্দেশখালির নিগৃহীতা মহিলাদের প্রতিরোধ এই আপাত স্থিতিশীলতায় চিড় ধারাতে পারবে কি না, তা আগামী লোকসভা নির্বাচনে স্পষ্ট হবে। কিন্তু এ কথা হয়তো বলা যেতে পারে যে, এই ঘটনাপ্রবাহ ও প্রতিবাদী মহিলাদের ভাষ্য শাসক জনবাদীদের জন্য এক চিহ্নিত ‘অপর’ তৈরি করেছে। শাসকের সন্দেহ ও বিরাগের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত এই ‘অপর’ মহিলাদের স্থান হতে পারে পার্ক স্ট্রিট বা কামদুনির নিগৃহীতাদের পাশে। নিগৃহীতার ভাষ্যকে সন্দেহ বা খারিজ করা ও চরিত্রহননের চেষ্টা অবশ্য দল-মত নির্বিশেষেই শাসকের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, যা দেখা গিয়েছে নব্বইয়ের দশকের বিরাটির গণধর্ষণের ঘটনায় বা সাম্প্রতিক কালে দিল্লিতে মহিলা ক্রীড়াবিদদের ক্ষেত্রে।

বিগত কিছু দিন ধরে শাসক দলের দ্বারা সন্দেশখালির মহিলাদের ক্রমাগত অপরীকরণ চলছে, যা জনবাদী রাজনীতির এক অন্যতম অঙ্গ। সমান্তরালে আর একটি প্রক্রিয়াও চোখে পড়ছে যার দ্বারা মহিলা মুখ্যমন্ত্রী বিভিন্ন সভায় মহিলা লাভার্থীদের থেকে আগামী নির্বাচনে স্থায়ী আনুগত্যের আশ্বাস চাইছেন, তাঁর ও মহিলা-ভোটারদের আবেগের বন্ধনকে সাক্ষী রেখে। দু’টি প্রক্রিয়ার মধ্যে আপাত দৃষ্টিতে অমিল থাকলেও জনবাদী প্রতিনিধিমূলক রাজনীতিতে এই দুই ঘটনা একে অপরকে দৃঢ় করে। দু’টি জনবাদী রাজনৈতিক প্রক্রিয়া মহিলা ভোটবর্গকেও দু’টি ভাগে বিভক্ত করতে উদ্যত হয়, যা গতানুগতিক লিঙ্গ রাজনীতির ধ্যানধারণাকে মেনে ‘ভাল মেয়ে’ বনাম ‘খারাপ মেয়ে’র সংজ্ঞাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ঝাঁটা-লাঠি হাতে প্রতিরোধরত সন্দেশখালির ‘খারাপ মেয়ে’রা রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ও জনবাদী রাজনীতির নিহিত সত্যগুলির পাঠ পড়ালেন আমাদের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement