লক্ষ্মণরেখা: সংবিধান সদনে এনডিএ বৈঠকে এসে তৃতীয় বারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সংবিধানকে প্রণাম জ্ঞাপন, নয়াদিল্লি, ৭ জুন। পিটিআই।
পর পর তিন বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার উজ্জ্বল দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেও নরেন্দ্র মোদীকে এ বার আর নবনির্মিত সংসদ ভবনের সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণামে দেখা গেল না। দেখা গেল তিনি সংবিধান গ্রন্থটিকে একেবারে পূজ্য দেবতার মতনই শিরোধার্য করে, সেটিকে বারংবার প্রণাম জানিয়ে নতুন সরকার গঠনের দিকে পা বাড়ালেন। সংবিধানের এই দেবত্ব প্রাপ্তি নিয়েই কিছু আলোচনা। তবে আগে বলে রাখা ভাল যে, পশ্চিমি বুদ্ধিজীবী মহল ও সংবাদমাধ্যমগুলির একতরফা বিদ্রুপ ও সমালোচনাকে গায়ে না মেখে এই গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হল। ইলেক্টোরাল অটোক্র্যাসি বলে যে নতুন বিশেষণটি ভারতের জন্য আবিষ্কৃত হয়েছিল সেটি আপাতত ঠান্ডা ঘরে চলে গেল।
সংবিধানের প্রসঙ্গে প্রবেশের কারণ, এ বারের নির্বাচনী প্রচারে বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন দলের বিভিন্ন দাবি ও পাল্টা দাবির বাইরে একটি নতুন প্রশ্ন বিরোধী দলেরা তুলেছে, শাসকদলও তা নিয়ে তাদের কথা বলেছে, প্রশ্ন উঠেছে ভারতীয় সংবিধানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। সংবিধানের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্নটি উঠেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর একটি নির্বাচনী স্লোগানকে কেন্দ্র করে: ইস বার চারশো পার। অর্থাৎ এ বার নির্বাচনে বিজেপি জোট (এনডিএ)-এর জন্য ৪০০-র বেশি আসন চাইলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ভারতের সংবিধানের কোনও ধারা পরিবর্তন, সংশোধন, বিলোপ বা যুক্ত করার জন্য প্রয়োজন লোকসভা ও রাজ্যসভায় উপস্থিত দুই-তৃতীয়াংশের সম্মতি। লোকসভায় প্রয়োজনীয় সর্বাধিক সংখ্যাটি দাঁড়ায় ৩৬২ জন সদস্য। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি জোট জিতেছিল ৩৫৩টি আসন।
১৯৫০ সালে সংবিধান প্রচলনের পর ভারতীয় সংবিধান ১০৬ বার সংশোধিত হয়েছে। গত ১০ বছরে নরেন্দ্র মোদী সরকারের আমলে হয়েছে ৮ বার। সুতরাং সংবিধান সংশোধন যে কোনও সরকারই নিয়ম মেনে করতে পারে, তা নিয়ে বিশেষ চিন্তার খুব একটা কারণ হতে পারে না। সংবিধানের সংশোধন আবার অন্য সরকার এসে পাল্টে দিচ্ছে তাও হয়েছে কয়েকবার। বিরোধীদের অভিযোগ ছিল যে, বিজেপি সরকার ব্যাপক বহুমত নিয়ে সরকারে এসে সংবিধানটিই পাল্টে দিতে চায়। ইঙ্গিতটি যে, নরেন্দ্র মোদী একটি হিন্দুত্ববাদী, সংরক্ষণ-বিরোধী সংবিধান প্রবর্তনের কথা ভাবছেন তাই প্রয়োজন ৪০০ আসনের। অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী মোদী এর বিরোধিতা করে বলছেন আম্বেডকর রচিত পবিত্র ভারতীয় সংবিধানকে তিনি কখনওই পরিবর্তিত হতে দেবেন না। যদিও ভারতীয় সংবিধান কোনও একক ব্যক্তির রচিত মৌলিক সৃষ্টি নয়, একটি কমিটির বিভিন্ন দেশের সংবিধান ও দেশীয় আইনের অধ্যয়নের ফসল। জানা দরকার যে, এই সংবিধান কতটা সংশোধনযোগ্য, কে তা নির্ধারণ করবে এবং একটি নির্দিষ্ট সংবিধান কি আদৌ প্রয়োজন।
বেশ কিছু সংশোধনের পর ভারতের সংবিধান কতটা সংশোধনযোগ্য তা প্রথম স্থির হল ১৯৭৩ সালে। সুপ্রিম কোর্টের কয়েকটি রায়ে অসন্তুষ্ট প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংসদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সংবিধানের কয়েকটি ধারা সংশোধন করেন। কেরলে ধর্মীয় জমি সংক্রান্ত বিখ্যাত কেশবানন্দ ভারতী মামলার রায়ে (১৯৭৩) সে-সব সংশোধন বাতিল হল এবং এই প্রথম সর্বোচ্চ আদালত জানাল যে, সংবিধানের মূল কাঠামোকে সংশোধিত বা পরিবর্তিত করা যাবে না। এই মূল কাঠামো কি তা আদালত বলেনি, কেবল কিছু সাধারণ নীতিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্রবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এর অংশ বলেছে। এই সিদ্ধান্তের পক্ষে ছিলেন ৭ জন বিচারক, বিপক্ষে ৬ জন। সংবিধানের মূল কাঠামো নিয়ে সংবিধানের প্রণেতারা কিছু বলেননি। আদৌ সে রকম কিছু আছে কি না বা থাকলে সেটা কী, তা ঠিক করে ফেললেন কয়েকজন বিচারক। সংসদ নয়, ভারতীয় সংবিধানের ভবিষ্যতের দায়িত্ব রইল আদালতের হাতে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আবার ব্যাপক সংবিধান সংশোধন আনলেন ১৯৭৬, ১৯৭৭-এ, জরুরি অবস্থার সময়ে। সরকার পাল্টালে এই সংশোধনগুলির অনেক ক’টিই বাতিল হল, কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর আনা সংবিধানের সংশোধিত সূচনা পাল্টানো হল না। ভারতের বহুবন্দিত সংবিধান প্রণেতাগণ সংবিধানের সূচনায় ভারতকে উল্লেখ করেছেন ‘সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’, ইন্দিরা গান্ধী তাকে বদলে করলেন ‘সার্বভৌম, সমাজবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক’। অর্থাৎ সংবিধান প্রণেতাগণ নয় প্রধানমন্ত্রী এগুলি অন্তর্ভুক্ত করলেন এবং আজ পর্যন্ত কোনও বিচারক এটিকে সংবিধানের মূল কাঠামোর পরিবর্তন মনে করলেন না। ১৯৮০ সালে মিনার্ভা মিলের মামলায় সর্বোচ্চ আদালত আবার রায় দিল যে, সংসদের ক্ষমতা নেই সংবিধানের মূল কাঠামোর পরিবর্তন করার। ১৯৯২ সালে বাবরি সৌধ ধ্বংসের পর ধর্মনিরপেক্ষতা আক্রান্ত কারণ দেখিয়ে সর্বোচ্চ আদালত বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিরুদ্ধে মামলা ১৯৯৪ সালে খারিজ করে দেয়। সংবিধানের প্রণেতারা ধর্মনিরপেক্ষতা কথাটা উল্লেখ করেননি, অথচ সেই ধর্মনিরপেক্ষতা এখন হয়ে গেল সংবিধানের মূল কাঠামোর অংশ!
এ-হেন সংবিধানের দায়িত্ব নিয়ে আদালতের উপর কতটা ভরসা করা যায়? একই তথ্যের উপর নির্ভর করে এক-একটি আদালত ভিন্ন ভিন্ন রায় দেয়। বিচারের শেষ পর্যায়ে আদালতের সিদ্ধান্ত অনেকটাই হয় বিচারকদের ব্যক্তিগত মতামতনির্ভর। কেশবানন্দ ভারতী মামলায় ৭ জন বিচারক এক দিকে, ৬ জন বিপরীতে। পশ্চিমবঙ্গের ভাগ্যনির্ধারক সিঙ্গুর মামলায় নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালত গড়াল। সেখানে দু’জন বিচারপতিই সিঙ্গুর জমি অধিগ্রহণের বিপক্ষে রায় দিলেন, কিন্তু দু’জনের কারণ ভিন্ন। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার বিরুদ্ধে বেআইনি সম্পত্তির মামলা শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। নিম্ন আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালতে কয়েকবার ঘুরেফিরেও কুড়ি বছর পর, ২০১৬ সালে জয়ললিতার মৃত্যু পর্যন্ত তার সমাধান হয়নি। সংবিধানের ভাগ্য এ রকম কয়েক জন অনির্বাচিত, দেশের নাগরিকদের কাছে দায়বদ্ধতাহীন ব্যক্তির উপর ছেড়ে রাখা কি ঠিক? গণতন্ত্রে দেশের সমাজের ভবিষ্যৎ কয়েক জন পেশাজীবী ঠিক করতে পারেন না, একমাত্র অধিকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরই।
ব্রিটেনে কোনও লিখিত সংবিধান নেই। দেশের গণতন্ত্র চলে সংসদে গৃহীত বিভিন্ন আইন, নীতি, ঐতিহ্যের দ্বারা। ১৯৮৯-তে ফরাসি বিপ্লবের দ্বিশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থ্যাচার যাননি, তিনি মনে করেছিলেন যে গণতন্ত্র মানবাধিকারের জন্য রক্তক্ষয়ী বিপ্লব, রাষ্ট্রের অভিভাবকত্বের প্রয়োজন নেই, গণতান্ত্রিক নির্বাচিত সরকারই যথেষ্ট। ফ্রান্সের অনেক আগে থেকেই ব্রিটেনে সেই গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের ধারা শুরু হয়েছে। এ বার আরও একটি মূল প্রশ্ন করা যেতে পারে যে, একেবারে স্থায়ী ভিত্তির সংবিধান কি একটি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হয়ে দাঁড়ায় না? আর তার প্রণেতা বলে প্রচারিত ব্যক্তিটি কি হয়ে যান না প্রায় এক দৈব পুরুষ? এই অবস্থাটাই কি গণতন্ত্রবিরোধী নয়? একটি সময়ের প্রেক্ষিতে রচিত একটি গ্রন্থ/ দলিল কি কখনও সর্বকালেই প্রযোজ্য হওয়া উচিত?
ধর্মপ্রবণ ভারতীয়দের কাছে গণতন্ত্র একটি ধর্ম। ধর্ম অর্থ, যা ধারণ করে। মানুষের বিভিন্ন অস্তিত্ব আছে, তা ধারণ করার জন্য প্রয়োজন হয় কিছু ন্যায়, নীতি, কর্তব্য সম্পর্কিত ধারণা। জগৎসংসার সম্পর্কিত ভাবনার বিভিন্ন ধর্ম রয়েছে। কোনও একটিমাত্র ভাবনা, একটিমাত্র মার্গ, একটিমাত্র উপাসনা পদ্ধতি, ভারতীয় ধর্ম ভাবনায় অনুপস্থিত। ভারতীয় ধর্ম সমাজের অঙ্গ বৌদ্ধ বা জৈন দর্শনে কোন বিশ্বস্রষ্টা ঈশ্বর নেই, নেই কোনও স্বর্গের প্রলোভন। নিরীশ্বরবাদীরাও ত্যাজ্য নন। ফলে একটি পবিত্র গ্রন্থ, সেই গ্রন্থের এক জন মহান প্রণেতা, ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে একেবারেই বেমানান। বেমানান সেই সংবিধানের দ্বাররক্ষী কিছু স্বনির্বাচিত অভিভাবক। সংবিধানের ভালমন্দ নির্ধারণের অধিকার একমাত্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। আদালতের অধিকার নেই সংবিধানের মূল কাঠামো ব্যাখ্যা করার। একটি সমাজ সময়ের সঙ্গে এগিয়ে চলে, সেই সমাজের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনও অলঙ্ঘ্য শাস্ত্র অপ্রয়োজনীয়। সংখ্যাধিক্যের জোরে কোনও দল সংবিধানকে নিজেদের মতো পরিবর্তন করতেই পারে, গণতন্ত্রের সেই সমস্যা সব বিষয়েই থাকে। কিন্তু বহুমতের সহাবস্থানে সমাজকে ধারণ করার ধর্ম এ দেশের কয়েক সহস্র বছরের ঐতিহ্য।