পুরুষ ও নারী— এই দুই চেনা পরিসরের বাইরে একটি পরিসর আছে। সেই ‘তৃতীয় পরিসর’ আজ সমাজের একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। কিন্তু যদি প্রশ্ন করি, আমাদের দেশের ক’জন নাগরিক সেই তৃতীয় সত্তা নিয়ে বেঁচে আছেন? উত্তর মিলবে না। ২০১৪ সালের চেয়ে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই শ্রেণির ভোটার বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। কিন্তু এলজিবিটি জনতার সংখ্যা নিরূপণে এই তথ্য কাজে আসবে না। কারণ, সমাজের মূলস্রোত এখনও ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ বিষয়টিকে এমন অচ্ছুত করে রেখেছে যে, বহু মানুষ তাঁদের সঠিক সত্তাকে প্রকাশ করতে সাহস পান না।
বাংলাদেশ সরকারের সাম্প্রতিক ঘোষণা, কোনও বেসরকারি সংস্থা সমলিঙ্গ, লিঙ্গান্তরিত বা রূপান্তরকামীকে চাকরি দিলে বিশেষ কর ছাড় দেওয়া হবে। সরকারি ঘোষণা সমাজে কি কোনও পরিবর্তন আনে? বাল্যবিবাহ-বিরোধী আইন পাশ হলেও শিশুকন্যার বিয়ে আটকায়নি। সতীদাহ-বিরোধী আইনের ক্ষেত্রেও একই কথা। সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই সমাজ বদলায়। তৃতীয় পরিসরের বাসিন্দারা তখনই আমাদের অভ্যাসের অন্দরে আসবেন, যখন আমরা দরজা খুলে দেব। আর বঞ্চিতদের অধিকারের স্বীকৃতির পথে আইনের সমর্থন নিশ্চয়ই প্রথম ধাপ হিসেবে পরিগণিত হবে।
ভারতের সরকারি, বেসরকারি সংস্থাগুলিতে এলজিবিটি শ্রেণির মানুষের সংখ্যা আণুবীক্ষণিক। তাঁদের কথা আলোচনা করলেও সমাজ ভ্রুকুটি হানে। মাদ্রাজ হাই কোর্ট সম্প্রতি একটি অসাধারণ রায় দিয়েছে— রাজ্য সরকার, এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদেরও সমলিঙ্গ সংক্রান্ত আইনকে সম্মান করতে হবে এবং সমাজের মূলস্রোতে তাঁদের শামিল করার চেষ্টা করতে হবে। এই কাজ করতে গেলে শুধু তৃতীয় পরিসরের মানুষজনকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রে টেনে আনলেই হবে না, সেইমতো পরিকাঠামো ও প্রশিক্ষণ চাই। সহনাগরিকদের মনকেও সেই ভাবে তৈরি করতে হবে।
বিতর্কিত ‘ট্রান্সজেন্ডার বিল’ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কর্মসংস্থানের অধিকারের বিষয়ে ইতিবাচক ভাব দেখিয়েছে। ৩৭৭ নম্বর ধারা নিয়ে ২০১৮ সালে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের রায়ও লিঙ্গবৈষম্যের বিরোধিতার ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে চাকরি বা প্রোমোশন দেওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য করা চলবে না। দুর্ব্যবহার করলে শাস্তি হবে। এমন অনেক কিছু বলা হলেও বাস্তবে ৯২ শতাংশ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ভারতে স্বীকৃত অর্থনৈতিক পরিসর থেকে বঞ্চিত। বাকি ৮ শতাংশও পদে পদে সমস্যার সম্মুখীন হন।
বিবাহের স্বাভাবিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে মানুষের সামাজিকীকরণের প্রচেষ্টা মাঠে মারা যায়। সমকাম ‘অপরাধ’ নয়, এ কথা সাব্যস্ত হওয়ার পরও বেশ কিছু কাল ধরে তৃতীয় লিঙ্গের বিবাহ নিয়ে সরকারি তরফে আমরা অদ্ভুত আচরণ দেখছি। দিল্লির উচ্চ আদালতে ‘হিন্দু বিবাহ আইন’-এ এই ধরনের বিবাহের মান্যতা চেয়ে পিটিশন দাখিল হলে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা সমকামী মানুষের বিবাহের অধিকারকে ‘আইনসঙ্গত’ মানতে অসম্মত হন। সমকামীদের আমরা ‘সংখ্যালঘু’ হিসেবে দেখতে পারি। ভারতে নারী, অহিন্দু, দলিত ইত্যাদি শ্রেণির মানুষের মতো এই মুহূর্তে তাঁরাও সঙ্কটে। তার দোসর হয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদ। কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়ে দিল, “বিবাহের মতো একটি বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পবিত্রতা জড়িয়ে রয়েছে। দেশের একটি বড় অংশে এটি ধর্মবিশ্বাস হিসেবে বিবেচিত হয়। বিবাহ মানে জন্মগত ভাবে এক নারী এবং এক পুরুষের বন্ধন। বহু রীতিনীতি, আচারের উপর দাঁড়িয়ে থাকে বিবাহ।” ফলে ‘সহবাস’, এমনকি ‘রেজিস্ট্রি’ বিবাহও বিপদে পড়তে চলেছে।
আমাদের ‘ঐতিহ্য সচেতন’ দেশে সমকামীদের অধিকারের দাবি নিয়ে কথা বলা অস্বাভাবিক, কিন্তু ব্যঙ্গ করা স্বাভাবিক। ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে ১৮৬১ সালের আইন সমকামিতাকে ‘অপ্রাকৃতিক যৌনতা’ হিসেবে দেখেছিল। সেই হ্যাংওভার চলছিল। শেষে ২০১৮ সালে বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বে থাকা ডিভিশন বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেন, ৩৭৭ নম্বর ধারায় সমকামিতা সম্পর্কে ‘অপরাধ’ শব্দটি ‘অসাংবিধানিক’। সমকামিতা কোনও অপরাধ নয়। বিচারপতির কথায়, “আজকের উন্নত আইনব্যবস্থা কখনওই তাঁদের অধিকার অর্জনের জন্য লড়াইকে মূক দর্শকের প্রতিক্রিয়া দিতে পারে না।”
ভারতে সমকামীদের অধিকার নিয়ে আলোচনা বা আইন তাঁদের স্বাভাবিক সামাজিক জীবনের নিশ্চয়তা দেয় না। এলজিবিটি গোষ্ঠীর মানুষ সম্পত্তির উত্তরাধিকার, সন্তান দত্তক নেওয়া, ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেওয়া, অফিস বা স্কুল-কলেজে নির্দ্বিধায় বিচরণ, এমন অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত। ভারতের সংবিধান বৈষম্যের বিরোধী। এই দেশে নাগরিকের ব্যক্তিগত বিষয়ের অধিকার, নাগরিকের জীবন এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার স্বীকৃত। অথচ, তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিসত্তা বিপন্ন। সমকামীর অধিকার কারও দয়ার দান নয়, আমাদের সহনাগরিকের জন্মগত হক। জনগণ এই কথা বুঝলে সরকারের ক্ষমতা নেই মুখ ফিরিয়ে থাকার।