শাসকের অন্যায় দাপটের স্থান ভক্তিবাদে নেই
Pathaan

ভক্তি, তুমি কোথা হইতে

দিল্লির ছেলে, বলিউড-নায়ক শাহরুখ খানের ভক্ত-দুনিয়া বিশেষ করে নজরে এসেছিল ২০১৩ সালে চেন্নাই এক্সপ্রেস ছবির সময়ে।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৪:২৮
Share:

এই স্বতঃস্ফূর্ততার অন্য নাম ভক্তি! সেখানে হিট, ফ্লপ, বক্স অফিস ইত্যাদি উপচার লাগে না, হৃদয়ের টানই সব। ফাইল ছবি।

কয়েক দিন টুইটার, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ-এর সোশাল মিডিয়ায় একটি দৃশ্য প্রায় ভাইরাল। সিনেমা হলের পর্দায় শাহরুখ খান, তাঁর সঙ্গে তাল মিলিয়ে হলের দর্শকরাও ফ্লোরে পরস্পরের হাত ধরে নেচে উঠছেন, ‘ঝুমে জো পঠান মেরি জান’। সিনেমা নিয়ে নাচানাচি নতুন কিছু নয়, তবে দর্শকরা নিজে প্রবল উৎসাহে সিনেমা হলকে ডান্স ফ্লোর বানিয়েছেন, এমন দৃশ্য আগে দেখিনি। নৃত্যরত দর্শককুলের সবাই ফ্যান ক্লাবের সদস্য নন, নাচানাচির কোনও ফতোয়া তাঁদের উপর ছিল না। তাঁদের ওই নাচ স্বতঃস্ফূর্ত। এই স্বতঃস্ফূর্ততার অন্য নাম ভক্তি! সেখানে হিট, ফ্লপ, বক্স অফিস ইত্যাদি উপচার লাগে না, হৃদয়ের টানই সব। তিনি সাকার না নিরাকার, তাঁর ছেলেকে নেশা করার মিথ্যে অভিযোগে ক্ষমতাবানরা জেলে পাঠায় কি না, অন্যরা তাঁকে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেয় কি না, এই সবে কিছু যায় আসে না। আকুল হয়ে ডাকলে তিনি মেগাহিট নিয়ে পর্দায় দর্শন দেবেনই।

Advertisement

এ দেশে ভক্তিবাদের উদ্ভব দক্ষিণ ভারতে। সেখানে কেউ শিবের ভক্ত, কেউ কৃষ্ণ এবং বিষ্ণুর। ভাগবত পুরাণেও ভক্তি জানায়, তার জন্ম দ্রাবিড় দেশে, পালিত হয়েছে কর্নাটকে, অতঃপর এসেছে মহারাষ্ট্রে, তার পর দুর্বল ও ক্ষীণ হয়েছে গুজরাতে। কলিযুগে বিধর্মীরা তাকে ও তার সন্তানদের আক্রমণ করে, বৃন্দাবনে এসে সে আবার জোর ফিরে পায়। মনে রাখতে হবে, দিল্লির ছেলে, বলিউড-নায়ক শাহরুখ খানের ভক্ত-দুনিয়া বিশেষ করে নজরে এসেছিল ২০১৩ সালে চেন্নাই এক্সপ্রেস ছবির সময়ে। শাহরুখ খানের সবচেয়ে বড় ফ্যান ক্লাব ‘এসআরকে ইউনিভার্স’ ওই সময়েই শুরু হয়। এখন ৪০টার বেশি দেশে, ২০০টা শহরে তাদের প্রায় ৫০ হাজার সদস্য। দীপিকা সেই ছবিরও নায়িকা। তখন দেখেছিলাম, চেন্নাইয়ের মায়লাপুরম অঞ্চলে হলের সামনে মালা গলায় শাহরুখের বিশাল কাটআউট, মাইকে ‘লুঙ্গি ডান্স লুঙ্গি ডান্স’। খাস চেন্নাই শহরের বাসিন্দারা সকালে লুঙ্গি পরে চা, কফির দোকানে আসতেন। রাতের দিকে গ্রামাঞ্চলে নজরে আসত, লুঙ্গি পরে লোকজন হাতে হারিকেন ঝুলিয়ে পিলপিল করে মেঠো রাস্তা বেয়ে চলেছেন সিনেমা হলের দিকে। এটাই দর্শকের ধর্ম। এমজিআর, জয়ললিতার দেবপ্রতিম বিশাল কাটআউটে মালা ঝুলিয়ে নাচগান। পরবর্তী নায়করাও সেই প্রথা থেকে সরে আসেননি। রজনীকান্ত, কমল হাসনের কাটআউটও মাল্যশোভিত, চন্দনচর্চিত হয়েছে। সে দিন পঠান-এর হলের দরজা খোলার ঢের আগে রজনীকান্তের ছবি রিলিজ়ের দিন চেন্নাই-কুয়ালা লামপুর ‘এয়ার এশিয়া’র বিমান যাত্রী-ভর্তি, সবাই চলেছে প্রথম দিনেই রজনীকান্তের নতুন ছবি কাবালি দেখতে। সেখানেই এই ছবির বড় অংশের শুটিং হয়েছিল কিনা! হিন্দুত্ববাদী বয়কট গ্যাং-এর কথা জানি না, তবে শাস্ত্র জানে, অযোধ্যায় নয়, ভক্তির জন্ম দ্রাবিড় দেশে।

দক্ষিণের সেই ভক্তিস্রোত কালক্রমে সারা ভারতে। কখনও মহারাষ্ট্রের তুকারামে, বারাণসীর কবীরের দোঁহায়, তুলসীদাসের রামচরিতমানসে, রাজস্থানের মীরার ভজনে। কখনও বা এই বাংলার শ্রীচৈতন্যে। এই ভক্তিবাদে নারী-পুরুষ ভেদ নেই, জাতপাত নেই, ‘চণ্ডাল চণ্ডাল নহে, যদি কৃষ্ণ বলে।’ তাঁর জন্য স্বর্ণচূড়শোভিত মন্দিরের দরকার নেই, ভক্ত তাঁকে সামর্থ্যমাফিক ধূপধুনো মালাচন্দনে সাজালেই হল। অধুনা শপিং মলে পরিণত লাইটহাউস সিনেমায় আমাদের ছেলেবেলায় মুকদ্দর কা সিকন্দর ছবির অমিতাভ বচ্চনের কাটআউটে মালা পরানো থাকত। যা ছিল ইংরেজি ছবির অভিজাত মন্দির, ভক্তির প্রণোদনা তাকে করে দিল দেবতার লীলাক্ষেত্র। ভক্ত নিজের আরাধ্য ছাড়া অন্য দেবতাদের দেখতে আগ্রহী নয়। শুনেছি, এক সময় কলকাতায় রমেশ সিপ্পির আন্দাজ ছবিতে বিরতি হলেই টিকিট কাটা দর্শককুল স্বেচ্ছায় পিলপিল করে বেরিয়ে আসতেন। বিরতির আগেই তো রাজেশ খন্নার মৃত্যু, মধ্যান্তরের পর আসবেন শাম্মি কপূর। এত সোশাল মিডিয়া না থাকা সত্ত্বেও কেন এটা ঘটত? ভক্তিবাদ কোনও দিল্লীশ্বর বা জগদীশ্বরের নির্দেশে গড়ে ওঠে না, সে উঠে আসে জনজীবন থেকে। ভক্তিবাদের প্রাচীন কবিরা অনেকেই ছিলেন চাষি বা জেলের মতো সাধারণ গেরস্ত, রাজসভার প্রসাদধন্য কবি নন। সেখানেই তাঁদের জিত! সিনেমাও সে রকম। আমি নায়ক হিসেবে শাহরুখ, সলমন না অক্ষয়কুমারের ভক্ত হব, তা আমার নিজস্বতা। আমার দিন আনি দিন খাই সমাজের বাস্তবতা। ভক্তিবাদ জানায়, রাজা বা শাসক কখনওই হবেন না একদেশদর্শী। কর্নাটকের ধারওয়ারে এক প্রাচীন লিপিতে জানা যায়, শৈবরা এক বার সেখানকার জৈন মন্দির ভেঙে দিয়েছিল। জৈন রাজা বিজলার কাছে বিচার চাওয়া হল, তিনি নিজে কিন্তু জৈনদের বিরুদ্ধে রায় দিলেন। দীপিকার গেরুয়া বিকিনি, বেশরম রঙের অ্যাজেন্ডাতাড়িত ভক্তকুলের বিরুদ্ধে আরও বড় ভক্ত জনতার রায় এই ভাবেই এল। শাসকের অন্যায় দাপটের স্থান ভক্তিবাদে নেই।

Advertisement

ভক্তিবাদের সবচেয়ে বড় কথা আর একটা। সে নিজস্ব দেবতায় বিশ্বাসী, তার জন্য অন্য দেবতাকে দুচ্ছাই করে না। তামিলনাড়ুতে ভক্তিবাদের বিকাশ কেন? সেখানে স্থানমাহাত্ম্যের ভিত্তিতে অনেক স্থলপুরাণ রচিত হয়েছিল। শিবের সন্তান স্কন্দ উত্তর ভারতে স্টাইলিস্ট কার্তিক বনেছেন, বাঙালির ছড়ায় ‘কার্তিক ঠাকুর হ্যাংলা’, কিন্তু স্কন্দের দক্ষিণ ভারতীয় রূপান্তর মুরুগন সেখানে আজও পূজ্য। কাবেরী নদীরও আছে নিজ মাহাত্ম্য। ঘোর জঙ্গলে ঢাকা শবরীমালার মন্দিরে শিব ও নারীবেশী বিষ্ণুর মিলনে শিশু আয়াপ্পন? বিকল্প যৌনতার এই লোককথা আজও দক্ষিণী জনতার মনে যে ভক্তির সঞ্চার তৈরি করে, তাকে ভুলব কী ভাবে? ভক্তিই বুঝিয়ে দেয়, এ দেশে কেন্দ্রাতিগতার কোনও স্থান নেই। তা এক-এক জায়গায় স্থানীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে উঠে আসবে, তার পর সব কিছু একাকার হয়ে যাবে মিলিত এক স্রোতে, যার আর এক নাম ভারত। ওয়েন্ডি ডোনিগার-এর মতো গবেষকরা অনেকেই আজকাল বলছেন, দক্ষিণ ভারতীয় ভক্তিবাদে ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ বা প্রপত্তির যে ধারণা, তা ইসলাম থেকে পাওয়া। সুফি গানের মতো দক্ষিণ ভারতীয় ভক্তিতেও তাই গানের ঐতিহ্য। ইতিহাস বলে, প্রথম রাজরাজ চোল তাঞ্জাভুরের বৃহদকেশ্বর শিবমন্দিরে গান চালু করেছিলেন। অতঃপর ভিন ভাষা, ভিন অঞ্চল। কেউ কাউকে শেখায়নি, তবু বাংলায় শ্রীচৈতন্যের হাত ধরে নবজন্ম পাবে কীর্তন, রাজস্থানে মীরাবাই গেয়ে উঠবেন, ‘মেরে তো গিরিধর গোপাল, দুসরো ন কোই।’ নিষাদপুত্রের নিজের বুড়ো আঙুল কেটে হিংসাত্মক ভক্তির নিদর্শন থেকে এ সব আলাদা। ‘ঝুমে জো পঠান’-এর নাচটা যেমন কেউ কাউকে শেখায়নি, সবাই একত্র ছন্দোবদ্ধ।

যারা সব কিছুতেই ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দোষ খুঁজেপেতে বার করে মদগর্বিত ৫২ ইঞ্চির ছাতি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, ধর্মে ধর্মে বিভাজনের নাগরিকপঞ্জি তৈরির চেষ্টায় থাকে, ধর্মান্তর ঘটিয়ে সবাইকে হিন্দু বানানোর ধান্দায় থাকে, তারা ভক্তিবাদের কী বুঝবে? তবে তাদের পূর্বসূরিদের নিয়েও দক্ষিণ ভারতীয় ভক্তিবাদে একটি গল্প আছে। এক শৈব সাধক অর্থের লোভ দেখিয়ে, গায়ের জোর খাটিয়ে সকলের ধর্মান্তর ঘটাত। এক দিন স্বয়ং শিব তাকে দেখা দিতে এলেন, সে দেবতাকেও ভস্ম মাখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শিব বারংবার নিজের পরিচয় দিয়ে অব্যাহতি চাইলেন, কাকস্য পরিবেদনা। ভক্ত জোর করে ভস্ম মাখিয়ে, কপালে ত্রিপুণ্ড্রক চড়িয়ে শিবকেও শৈব বানিয়ে ছাড়ল। হিন্দুধর্মের নাম করে হিন্দুত্বের আস্ফালন কি আজকের কথা?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement