আবার: পঞ্চায়েত ভোটের মনোনয়ন নিয়ে প্রবল সংঘর্ষ ভাঙড়ে, ১৩ জুন। সামসুল হুদা
সূচনাটি শুভ নয়। জের কত দূর গড়াতে পারে ভাবতে গেলে শঙ্কা বাড়ে। কোথায় কার দায় এক আনা, কার পাঁচ আনা কিংবা ফুটো পয়সা, সে সব মেঠো বক্তৃতায় থাক। মোটেরউপর ষোলো আনা দায় কিন্তু শাসকেরই। কারণ রাজদণ্ড অর্থাৎ শাসন-ক্ষমতা তাঁর হাতে।
এ বার পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণা হয়েছে কিছুটা আচমকাই। ভোটের সময় যে এগিয়ে এসেছে, সেটা সকলেই জানতেন। প্রশ্ন ছিল— কবে? দৃশ্যত তার কারণ ছিল দু’টি। এক, নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ নিয়ে রাজভবনের সঙ্গে নবান্নের টানাপড়েন। দুই, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জেলা-অভিযান শেষ না হওয়া।
বেশ কিছু দিন ঝুলিয়ে রেখে এবং বাগড়া দিয়ে শেষ পর্যন্ত নবান্নের ‘প্রথম পছন্দ’-এর রাজীব সিন্হাকেই রাজভবন রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের পদে মেনে নিল এবং পদে বসার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে রাজীব কাজে নামলেন।
নির্ঘণ্ট ঘোষণার আগে সর্বদলীয় বৈঠক আইনত বাধ্যতামূলক নয়। তবে পঞ্চায়েত ভোটের মতো এত বড় একটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের নিরিখে আগে একাধিক বার নির্বাচন কমিশনার সব দলকে এক সঙ্গে নিয়ে বসার পরে দিন ঘোষণা হয়েছে, তারও নজির আছে। এ বার বৈঠক যখন ডাকা হল, মনোনয়ন তখন পুরোদমে চালু হয়ে গিয়েছে।
দিন ঘোষণার পূর্বে রাজীব কি রাজ্যের পুলিশ ও প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে কোনও পর্যালোচনা বৈঠক করেছিলেন? তেমন কোনও তথ্য কিন্তু সামনে আসেনি। যদিও এই রকম বৈঠক হলে তাতে সুষ্ঠু ভোট করানোর জন্য রাজ্যের হাতে কী কী বন্দোবস্ত আছে এবং আরও কতটা কী দরকার, সেই চিত্রটি আগেভাগে পরিষ্কার হতে পারে।
নতুন নির্বাচন কমিশনার অবশ্য অত্যন্ত দ্রুততায় জেলাশাসকদের সঙ্গে একটি ভার্চুয়াল বৈঠক করেছিলেন। সেখানে স্বাভাবিক ভাবেই সবাই তাঁকে জানিয়েছেন, তাঁরা প্রস্তুত। কার্যত এর পরেই পঞ্চায়েত ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা হয়ে যায়।
সবাই জানেন, পঞ্চায়েত, পুরসভা ইত্যাদি ভোটের সূচি স্থির হয় মূলত রাজ্যের পরামর্শে। এ বার যদি প্রশ্ন ওঠে রাজীব সিন্হা কতটা আটঘাট বেঁধে ভোট করতে যাচ্ছেন, তা হলে সেই উত্তরের দায় রাজ্যও কি এড়িয়ে যেতে পারে?
দুর্ভাগ্যের বিষয়, রাজনৈতিক প্রশ্রয়পুষ্ট গুন্ডা, মস্তানেরা এই রাজ্যের ভোটকে সন্ত্রাসের ঐতিহ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সেই ‘কৃতিত্ব’ অবশ্যই সব দলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। শুধু ক্ষমতাসীন থাকার অতিরিক্ত সুবিধা হল পুলিশের একটি বড় অংশকে ‘কব্জা’য় পাওয়া। যারা দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না!
বাম আমলের কথা মনে করি। তৃণমূলের জন্মের আগের কথা, তাপস রায় তখন কংগ্রেসে। কলকাতার একটি পুর-নির্বাচনের দিন ভরদুপুরে ক্ষমতাসীন সিপিএমের বোমাবাজি ও তাড়ায় তিনি বৌবাজার-আমহার্স্ট স্ট্রিটের মোড়ে তাঁর বাড়িতে ঢুকে থরথরিয়ে কাঁপছিলেন! বড় রাস্তায় বোমার মহোৎসব চলছে। কাছেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে এক পুলিশ অফিসার। সাংবাদিকদের প্রশ্নে তাঁর উত্তর, “বোমা পড়ছে নাকি? শুনতে পাইনি তো!”
১৯৮৯-এর লোকসভা ভোটের দিন বিকেলে একটি স্কুলবাড়ির বুথে ‘দখল’ দেখতে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে ছিলাম। মাঠে রিভলভার ও লাঠি হাতে শাসক সিপিএমের বাহিনী মমতাকে ঘিরে ধরল। সঙ্গী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় পুলিশের কাছে ‘সাহায্য’ চাইলেন। পুলিশ বলল, “এখানে উনি এলেন কেন!”
২০১৮-র পঞ্চায়েতে অরাজকতার অভিজ্ঞতার পরে বর্তমান শাসকের আশ্বাস ছিল, ২০২৩ নাকি আলাদা ছবি দেখাবে। দেখাতে পেরেছে, পারছে, সে দাবি কিন্তু করা যাবে না। বরং শুরুতেই আমরা দেখলাম, মুর্শিদাবাদের ডোমকলে মনোনয়ন-চত্বর থেকে তৃণমূলেরই এক স্থানীয় নেতা কোমরে রিভলভার নিয়ে ধরা পড়লেন। যত দূর জানি, পুলিশ তাঁকে জেরার জন্য নিজের হেফাজতেও চায়নি। ফলে সরাসরি জেল হয়েছে। ধরার আগে পুলিশ তাঁকে কার্যত ‘উপদেশ’ দিয়েছিল, “আপনার পালিয়ে যাওয়া উচিত ছিল!”
বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলি মনে করানোর উদ্দেশ্য, পুলিশের ভূমিকা। প্রভু বদলের সঙ্গে সঙ্গে উর্দিধারীদের এই বদলটাই বোধ হয় ‘আসল’ পরিবর্তন! সব আমলেই ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী চাওয়া বিরোধীদের চিরকালীন দাবি। তবে যাঁরা তা চান, তাঁরাও জানেন যে, কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের প্রক্রিয়াটিও বহুলাংশে রাজ্য-নির্ভর।
আরও একটি বিষয় লক্ষ করার। সাধারণ নির্বাচনের তুলনায় পঞ্চায়েত নির্বাচনে অশান্তি, হানাহানির মাত্রা বেশি হয়। তার একটি কারণ, মনে হয়, ছোট ছোট এলাকায় ‘দল-আশ্রিত’দের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা এবং কামিয়ে নেওয়ার তাড়না। তাই পঞ্চায়েত দখলে রাখা বনাম দখল করতে চাওয়ার সংঘাত সেখানে উভয় দিকেই দ্রুত ‘সংগঠিত’ ও মরিয়া আকার নিয়ে ফেলে। গরিষ্ঠতার ভারসাম্যও বহু ক্ষেত্রে টলমলে থাকে। এবং পতাকার রঙে বৃহত্তর রাজনীতি এ সব ঘিরে আলোড়িত হয়।
ভাবুন, ২০১৩ অর্থাৎ তৃণমূল সরকারের প্রথম পঞ্চায়েত ভোট। তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে সর্বোচ্চ আদালতের আদেশে কেন্দ্রীয় বাহিনী এনেছিলেন। সে বারও কিন্তু সব মিলিয়ে পঞ্চায়েতের বলি ৩৯। যার ২৫ জনই ভোটের দিনে।
ফিরে তাকাই ২০০৩-এর পঞ্চায়েত পর্বে। একচ্ছত্র বাম শাসন। ভোটের প্রাণহানি কমবেশি ৭০। একা মুর্শিদাবাদে নিহতের সংখ্যা ছিল কমপক্ষে ৪৫। আর সে বারে শুধু ভোটের দিনে নিহত ১৩। ২০০৮-এর বাম রাজত্বেও সামগ্রিক মৃত্যুর হিসাব অন্তত ৩০। ভোটের দিনে ১৮। ভোটের একটিদিনে একই সংখ্যক মৃত্যু দেখা গিয়েছে বর্তমান তৃণমূল আমলের ২০১৮ সালে অর্থাৎ গত পঞ্চায়েত ভোটে। নিহতের সামগ্রিক সংখ্যাটিও গত বার ছিল ৩০-এর মতো।
পরিসংখ্যান নিয়ে শাসক ও বিরোধীদের মধ্যে ঝগড়া, তর্কবিতর্ক থাকতে পারে। সরকারে যখন যে থাকে, তারা তাদের অনুকূলে নানা যুক্তি, ব্যাখ্যা, সংখ্যা হাজির করতে পারে। কিন্তু নির্বাচনী সন্ত্রাসের যে ধারাবাহিকতা এবং প্রবণতা রাজ্যে তৈরি হয়েছে, তা যেমন কোনও একটি দলের উপর বর্তায় না, তেমন কুতর্কের স্রোতে হিংসার ছবিগুলিও বদলে দেওয়া যায় না।
বাংলায় অবশ্য আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ বদল হয়ে গিয়েছে বিরোধীদের পতাকায়। ২০১৪ সালে বিজেপি দেশের শাসক হওয়ার পরে বাংলাতেও তারা প্রভাব বাড়াতে থাকে। ২০১৮-র পঞ্চায়েত থেকেই শাসক তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ হয়েছিল তারা। মারামারি, খুন-জখম যা হয়েছে তার বেশিটাই তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির। ২০১৯-এর লোকসভা ও ২০২১-এর বিধানসভার কথা এখানে ধরছি না।
তবে এই মুহূর্তে যেটি সবচেয়ে বড় চর্চার বিষয়, তা হল, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কি শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারবেন? তৃণমূলের অন্যতম শীর্ষনেতা হিসাবে নতুন প্রজন্মের অভিষেক কয়েক মাস ধরে বলছেন, পঞ্চায়েত ভোটকে তিনি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ রাখতে বদ্ধপরিকর। এটা তাঁর চ্যালেঞ্জ।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, অধুনা তিহাড়-বন্দি বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি কেষ্ট (অনুব্রত) মণ্ডল গত বার রাস্তায় ‘উন্নয়ন’ দাঁড় করিয়ে যা করেছিলেন, এ বারও অঙ্কুরেই তেমন ছবি স্পষ্ট। বাজারে রমরমিয়ে বিকোচ্ছে উইকেট! আসলে ‘কেষ্ট’রা গোকুলে বাড়ে। অপেক্ষা করে ‘সুযোগ’-এর। শাসক-পুষ্ট হলে তো পোয়াবারো!
লক্ষণীয়, তৃণমূলের নেতারাই বলছেন, বিরোধীদের মনোনয়ন দিয়ে কী লাভ! কেউ জিতলেই তো তৃণমূলে চলে আসবেন। গণতন্ত্রে এ কথার অর্থ ভয়ানক। আবার মনোনয়ন ঘিরে তৃণমূলের গোষ্ঠী-লড়াই থেকে ডোমকলে সিপিএম বা ভাঙড়ে আইএসএফ-এর রে-রে করে তেড়ে যাওয়ার দৃশ্যও এ প্রসঙ্গে ইঙ্গিতবাহী। আর পুলিশের সেই অংশ তো আছেই। ‘মাস্টারমশাই কিছুই দেখেননি’ যাদের কর্ম-নীতির মূল মন্ত্র!
তাই সদিচ্ছা যদি থাকেও অভিষেকের কাজটি সারমেয়র বাঁকানো লেজ সোজা করার চেয়ে কম দুরূহ নয়। পারলে তিনি ‘হিরো’!