ধ্বংসাবশেষ: সিকিমের সিংতাম-এ তিস্তা নদীর উপরে ভেঙে যাওয়া সেতু। অক্টোবর, ২০২৩। রয়টার্স।
হু -জ-উ-র, হা-কি-ম!” সপ্তাহ দুয়েক আগের সেই ভাঙাচোরা ডাকটা এখনও মাঝে মাঝে কানে ভেসে আসছে, থেকে থেকে চমকে উঠছি। গিয়েছিলাম গরুবাথান পাহাড়ের উপরে ঝান্ডি পাহাড়ে। ঝান্ডি মানে, উঁচু পাহাড়। উত্তরবঙ্গ, সিকিমের আশপাশে যে এ রকম কত ঝান্ডি আছে! বাঙালি মায়েরা যেমন সব ছেলেকে আদর করে ‘বাবু’ বা ‘খোকা’ নামে ডাকেন, পাহাড়েও সে রকম অনেক ঝান্ডি!
জায়গাটা লাভার কাছেই, ৮ কিলোমিটার দূরে। কিন্তু সেপ্টেম্বরের শেষেই সেবক, কালিঝরা হয়ে চেনা রাস্তায় যাওয়া কঠিন। তিস্তা ফুঁসছে, কয়েক জায়গায় রাস্তা ভেঙে গিয়েছে। মাল এখন ডুয়ার্স ভ্রমণে টুরিস্টদের প্রিয় সদর স্টেশন। এখান থেকে কয়েক কিমি গেলেই আপলচাঁদ ফরেস্ট। ২০১১ সালের শেষ সেন্সাস অনুযায়ী জঙ্গলের গ্রামগুলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ১৯২৮ জন মানুষের বাস। সকলে রাজডাঙা গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে।
এই আপলচাঁদ ফরেস্টেই প্রথম শুনেছিলাম অন্ধকার ঝোপঝাড়ের ডাঙায় হাত নাড়ছে নেংটি পরা সেই গোঙানির মানুষ, ‘হুজুর, মুই আসি গেছু, মুই ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারু বর্মন।’ গায়ে বাঘের থাবার দাগ। সে অবশ্য ১৯৮৮ সালের কথা। ৩৫ বছর পর আজ এ সব জায়গা পুরো বদলে গিয়েছে। তখন ডুয়ার্সের এই সব রাস্তায় শুধু সাইকেল রিকশা চলত, এখন টোটো থেকে অটো, চার চাকা কোনও কিছুর বিরাম নেই। আগে এ সব জায়গায় ক্রান্তির হাট, চালসার হাট খুব বিখ্যাত ছিল, সন্ধ্যার পর চোরাই সারের বস্তা বিক্রি হত, মাঝে মাঝে সেটলমেন্ট অফিসের লোকজন মাথায় ‘কৃত্রিম গো-প্রজনন কেন্দ্র’ আর ‘হলকা ক্যাম্প’ লেখা সাইনবোর্ড বয়ে আনত, এক জন মাইকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য লটারির টিকিট বিক্রি করত। মাঝে মাঝে সে তার ঘোষণায় লটারির সঙ্গে হলকা ক্যাম্প বসার কথাও মিশিয়ে দিত, ‘মাত্র এক টাকা দিয়ে লটারির টিকিট কিনুন। প্রতি সপ্তাহে এক বার খেলা। কালকের হলকা ক্যাম্প নতুন। তেমনই আপনার ফার্স্ট প্রাইজ় নতুন।’
আপলচাঁদ ফরেস্টের ধারে এখন আর এই সব হলকা ক্যাম্প, রাজ্য লটারির ঘোষণা নেই। এখন সর্বত্র পতপত করে দিনে তিন বার খেলা হওয়ার ডিয়ার লটারির ঘোষণাপত্র। নাগাল্যান্ড, সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ-সহ ১৩টি রাজ্যে এই লটারি বিধিবদ্ধ, আইনি। আগে সন্ধ্যার পর হাটের পিছনে চোলাই মদের ঠেক বসত, এখন জীবন অনেক বেশি সতেজ ও স্বাস্থ্যে ভরা। সর্বত্র রাম, হুইস্কি পাওয়া যায়।
এত কিছু বদলাল, শুধু নেংটি পরা বাঘারুটাই বদলাল না। যেমন বদলায় না তিস্তার বন্যা। এই বন্যাতেই তো তার দেউনিয়া বা মালিক গয়ানাথ জোতদার তাকে গাছের ডাল আর দড়ি নিয়ে ভেসে যাওয়ার হুকুম করেছিল। বাঘারু ভেবে ফেলার চেষ্টা করেছিল, জলের একটা সুবিধা আছে। নানা রকম জিনিসে চোখ আটকে যায় না। কিন্তু তার পর ডাঙা জেগে ওঠে। ডাঙা মানেই জমি, জমি মানেই আল, আল মানেই মালিক, মালিক মানেই বাড়ি, বাড়ি মানেই টাড়ি, টাড়ি মানেই গাঁও-গঞ্জ-শহর।... বাঘারুর তো কোনও বাড়ি নেই, টাড়ি নেই, বাঘারুর কোনও গাছ নেই, আল নেই। বাঘারু যেন ভেবে ফেলতে চায়, এই জলটাই থাকুক, সব আল, বাড়িটাড়ি ফরেস্ট গরুবাছুর ডোবানো এই জলটাই থাকুক, যে জলটা দিয়ে বাঘারু ভেসে এল, আরও ভেসে যাক, এতটাই ভাসুক যে, গয়ানাথ আর তাকে খুঁজে পাওয়ার সুযোগ পাবে না।
ভেসে যাক! এই আপলচাঁদ ফরেস্ট, ঝান্ডি থেকে লাভা, লোলেগাঁও, সিকিমের রংপো, লাচেন, লোনক হ্রদ সব ভেসে যাক! শুধু প্রকৃতির রুদ্ররোষ নয়, কিছু তো মানুষী কৃতকর্ম। ঝান্ডি যাওয়ার আগে ২০১৩ সালে মেঘভাঙা বৃষ্টি আর বাসুকি লেক ফেটে কেদারনাথের বন্যা দেখেছি, সে বার মন্দাকিনীর ধারে রুদ্রপ্রয়াগ থেকে কেদারের রাস্তা এ ভাবেই ভেঙে চৌচির হয়ে গিয়েছিল, তারও পরে ২০২১ সালে জোশীমঠ এ ভাবেই ডুবে গিয়েছিল, নীতি নদীর উপত্যকা থরথরিয়ে কাঁপছিল। কিছু দিন পরিবেশ মেনে উন্নয়নের সপক্ষে আলোচনা চলল, তার পর আবার যে কে সেই। শ্রীনগরে নদীর বুকে জেগে উঠল ধারী দেবীর মন্দির, জোশীমঠের অদূরে হেলাং, কল্পেশ্বরের রাস্তায় জেগে উঠল এক্সপ্রেসওয়ে। বন্যা, ভূমিকম্প যা-ই হোক, নদী তো শুধু তোমার-আমার জন্য নয়। ওর নীচে গয়ানাথদের তিন পুরুষের জমি।
দেশে দেশে কত যে গয়ানাথ! চিন তিব্বত অবধি ট্রেন চালু করেছে, আমরাও হিমালয়ের ভূপ্রকৃতি না মেনে সিকিম, গাড়োয়াল সর্বত্র ট্রেন চালাব। কী দরকার? চিন লাসা অবধি রেললাইন পেতেছে বলে আমাকেও সেই উন্নয়ন দেখাতে বানিহাল টানেল, রংপোতে রেললাইন আর গ্যাংটকে বিমানবন্দর করতে হবে? তিব্বতের ওই অংশটা পার্বত্য মরুভূমি আর এ প্রান্তের হিমালয় বয়সে তরুণ, এখনও ভূমিকম্পের ভাঁজে ভাঁজে জেগে ওঠে... এই তফাতটা তো করতে হবে। অবশ্য মানচিত্রে কী আসে যায়? মানচিত্র ছিঁড়েখুঁড়ে উড়ে যায়, শেষ অবধি আধন্যাংটা বাঘারুকেই দাঁতে কামড়ে সেই মানচিত্র গাছের উপর থেকে পেড়ে আনতে হয়। মঙ্গন, লাচেন পেরিয়ে উত্তর সিকিম ঘেঁষা চিন সীমান্তের বিপর্যয়ের খবর ঠিকঠাক আসে না, শুধু তিস্তার বুকে ভাসতে থাকে সেনাবাহিনীর ভেজা গ্রেনেড।
আপলচাঁদ ফরেস্ট থেকে ওদলাবাড়ি সর্বত্র এখন হোমস্টে। যেমন ছিল কেদারের রাস্তায় বন্যায় বিলুপ্ত রামওয়াড়ায়। নদী তো শুধু নদী নয়, ওর নীচে আছে গয়ানাথদের জোতজমি। ঝান্ডির হোমস্টে-তে জানলা খুলে দূরে পর পর তিনটে নদী, তিস্তা, চেল আর ঘিস। মনোরম দৃশ্য, কিন্তু বাঘারুটা তবু কানের কাছে ভ্যাড়ভ্যাড় করে, ‘সগগল গয়ানাথের’।
সবই গয়ানাথ জোতদারের? তা হলে আমার ভাগে কী? শুধু উন্নয়ন আর পর্যটনের একটা মানচিত্র, যেটা মাঝে মাঝেই বিষম আঘাতে ছিঁড়েখুঁড়ে যাবে, তার পর জল নামলে আবার যে কে সেই? বাঘারুর মতো এই নদী, অরণ্য, মোষের বাথান কোনও কিছুতে আমার অধিকার নেই! কখনও সিকিম, কাশ্মীরের পাহাড়ে রেললাইন হবে, কখনও বা কয়েক হাজার গাছ কেটে পুরুলিয়ার ঠুগ্রায় জলবিদ্যুৎ। পরিবেশের সঙ্গে সংহতি রেখে উন্নয়ন? আর একটা আধা ন্যাংটো লোক এ বার বাঘারুর পাশে এসে দাঁড়ায়। দেবেশ রায়ের তিস্তাপারের বৃত্তান্ত-র বাঘারুর পাশাপাশি একেও চিনি, সময় অসময়ের বৃত্তান্ত উপন্যাসের কেলু। বিহারের পাড়ারিয়া গ্রাম থেকে এসেছিল কলকাতায়। তার পর বেহালার বিষতেল, ফুটপাতের স্টোনম্যানের পাশাপাশি সেঁটে গিয়েছিল গঙ্গাসাগর শব্দটার সঙ্গে। কেলু জানত, হাটে বাজারে ঘরে বাইরে চরাচরে আইনি প্রতর্কে নথিপত্রে সর্বত্র আকীর্ণ হয়ে আছে রাষ্ট্রশব্দ। সেটা ধ্রুব, নির্বিকল্প ঠেকলেও আসলে কল্পকথার মতোই ঠুনকো।
কী বলছে কেলু আর বাঘারু? পরিবেশ, উন্নয়ন, পর্যটন, সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা সবই আসলে পিছলে যাওয়া অর্থহীন ঠুনকো শব্দ! কোনওটাতেই আমার অধিকার নেই, সবই ক্ষমতার তৈরি, ক্ষমতার জন্য! বাঘারু হাসে।
চা-বাগানের আদিবাসী নেতার বক্তৃতাতেও ঢুকে থাকে লেবারলোক, ডিমান্ডের মতো ইংরেজি শব্দ। উত্তরখণ্ডী নেতার বক্তৃতায় থাকে সংস্কৃত শ্লোক। কৃষক সমিতির নেতার লেকচারে আসে কমরেড, শোষণ মার্কা শব্দ। তিস্তা ব্যারাজ যেখানে উদ্বোধন করা হয়েছিল, সেই গাজলডোবাতেও আজ মেঘভাঙা বৃষ্টি। শ্রীদেবী আর ফাংশনে নাচতে আসেন না, তিনি বহু আগে দুবাইয়ের হোটেলের বাথটবে মারা গিয়েছেন। ফুঁসে ওঠা নদী প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে করোনেশন ব্রিজ। এই জাতীয় সড়ক, নদী-প্রকল্প কোনওটাতেই আমার অধিকার নেই? ফুঁসে ওঠা নদী থেমে গেলে ফের যে কে সেই! সগগলই দিল্লি, কলকাতায় থাকা গয়ানাথদের? পাড়ারিয়ার পুলিশি ক্ষমতার?
বাঘারু তিস্তাপার থেকে চলে গিয়েছিল। সে জানত এই নদীবন্ধন, ব্যারাজ দেশের অর্থনীতি বদলে দেবে, উৎপাদন বাড়াবে। সেই উন্নয়নকে বাঘারু প্রত্যাখ্যান করেছিল। যে ভাবে রাষ্ট্রের উন্নয়নী বয়ান থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল কেলু। তিস্তাপার, সময় অসময়ের বৃত্তান্ত পেরিয়ে আমিও কি এই শরতে আজ ওদের মতোই? নদী, পাহাড়, প্যালেস্টাইন থেকে উন্নয়নী বয়ান কোথাও আমার শরিকানা নেই, অধিকার নেই। সগগলই গয়ানাথদের!