বিরোধীদের আর্থিক পরিকল্পনা কী, সে কথাটুকুও তো স্পষ্ট নয়
Lok Sabha Election 2024

ভোটে জিতলে যা কর্তব্য

এই দফায় সরকার কোন দিকে নজর দেবে বলে অনুমান করা যায়? প্রথমেই অর্থনীতির কথা বলি। এটি নিশ্চিত যে, আগামী পাঁচ বছর ‘ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডিচার’ বা মূলধনি খাতে ব্যয়ের বৃদ্ধি জারি থাকবে।

Advertisement

স্বপ্নেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:১৫
Share:

—প্রতীকী ছবি।

নির্বাচনের মহামধ্যাহ্ন উপস্থিত-প্রায়, অথচ এই তুঙ্গ প্রচারের ঋতুতেও অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কোনও কথা নেই। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি শুধু প্রমাণ করতে ব্যস্ত যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কতখানি খারাপ। এবং তাদের প্রধান, এবং সম্ভবত একমাত্র লক্ষ্য হল, প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করা। এটি যদি কোনও দলের বা গোষ্ঠীর একমাত্র ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হয়ে থাকে, তা হলে তাদের ভোট না পাওয়াই উচিত। তারা ক্ষমতায় এলে এমন কী করতে চায় যা আগের ক্ষমতাসীন দল করতে পারেনি, তার কোনও রূপরেখা এখনও স্পষ্ট নয়। আদৌ এদের কোনও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আছে কি? ক্ষমতা দখলই একমাত্র উদ্দেশ্য নয় তো?

Advertisement

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কথা সত্যি মানলে বলতে হয় যে, কোনও বড়সড় অঘটন না-ঘটলে বিজেপিই ক্ষমতায় ফিরছে। ক্ষমতায় এলে তারা যে বড় মাপের আর্থিক উদারীকরণ নীতির পথে হাঁটবে, তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তারা কী কী করতে পারে, এই লেখায় সে কথা বলব। এই মুহূর্তে তাদের বৃহত্তম প্রতিশ্রুতি হল ভারতকে ২০৪৭-এ উন্নত অর্থনীতিতে পরিণত করা। ভারতীয় অর্থব্যবস্থার বর্তমান হাল খুব খারাপ নয়। সর্বশেষ বৃদ্ধির হার ৮.৪%। সরকারি হিসাব নিয়ে যাঁরা সন্দিহান, তাঁদের মনে করিয়ে দিই, বিশ্ব ব্যাঙ্ক ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ভারতের বৃদ্ধির আনুমানিক হার বাড়িয়ে ৭.৫% করেছে। যদিও বৃদ্ধির হার আর একটু বাড়লে ভাল হয়, তা হলে আমরা ২০২৯-এর লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে পারব।

এই দফায় সরকার কোন দিকে নজর দেবে বলে অনুমান করা যায়? প্রথমেই অর্থনীতির কথা বলি। এটি নিশ্চিত যে, আগামী পাঁচ বছর ‘ক্যাপিটাল এক্সপেন্ডিচার’ বা মূলধনি খাতে ব্যয়ের বৃদ্ধি জারি থাকবে। মূলধনি খাতে ব্যয়ের বহুমুখী সুবিধা বা গুণাগুণের একেবারে প্রথম সারিতে রয়েছে পরিকাঠামোর উন্নয়ন— এই খাতে ব্যয় বাড়লে দেশের পরিকাঠামোর উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে। তাতে প্রচুর কর্মসংস্থান হবে, যা মানুষের আয় বাড়াতে সাহায্য করবে। এই আয় থেকে বাজারে চাহিদা বাড়বে, যা বাজারকে চাঙ্গা করবে। এই বর্ধিত চাহিদার ফলে জোগানও বাড়বে, ফলে আরও কর্মসংস্থান ও আরও আয়বৃদ্ধি ঘটবে। এটি চক্রের মতো চলতে থাকে, যার সুদূরপ্রসারী লাভ একটি অর্থব্যবস্থা পেতে পারে। সর্বোপরি, পরিকাঠামোর যে উন্নয়ন ঘটবে, তা দেশের দীর্ঘমেয়াদি সম্পদে পরিণত হবে। এই পরিকাঠামো উন্নয়নের ফলে দেশে পণ্য পরিবহণ ত্বরান্বিত হবে, দেশে বিদ্যুৎ বা শক্তির ঘাটতি পূরণ হবে। এর ফলে ভারতের শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ কমবে ও ভারতীয় সামগ্রী বিদেশের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে সুবিধাজনক জায়গায় চলে আসবে। অর্থাৎ, এই একটি ওষুধে অনেক রোগ এক সঙ্গে সারার সম্ভাবনা থাকে। মূলধনি খাতে ব্যয় বৃদ্ধি একশো দিনের কাজ জাতীয় প্রকল্পের পিছনে টাকা খরচ করার চেয়ে অনেক ভাল, কারণ তেমন প্রকল্পে দেশের দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ তৈরির সম্ভাবনা কম। এতে একটি শ্রেণির হাতে কিছু স্বল্প অর্থ আসে বটে, কিন্তু তার থেকে খুব বেশি লাভ কিছু হয় না যা মূলধনি খাতে ব্যয় থেকে হয়। তাই হয়তো ভবিষ্যতে সরকার মূলধনি খাতে ব্যয়কেই বেশি প্রাধান্য দেবে।

Advertisement

দ্বিতীয় লক্ষ্য হবে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো। আমার ধারণা, কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ একশো শতাংশ পর্যন্ত করার সম্মতি দেওয়া হতে পারে। তৃতীয়ত, দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ আশা করছি। এখনও ভারতীয় বেসরকারি সংস্থাগুলির বিনিয়োগের পরিমাণ যথেষ্ট নয়। এর জন্য দেশে কর্মসংস্থান যত হওয়া উচিত, তা এখনও হচ্ছে না। তাই সরকারের উচিত বেসরকারি সংস্থাগুলি বিনিয়োগ করলে তার উপরে কিছু কর ছাড় দেওয়া। এতে সরকারের কর আদায় একটু কমলেও বেসরকারি বিনিয়োগ থেকে এবং তার ফলে বর্ধিত কর্মসংস্থান থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আদায় বাড়তে পারে, ও সর্বোপরি দেশের অর্থনীতি গতি পাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। অর্থাৎ, আগামী কেন্দ্রীয় সরকার ব্যাপক শিল্পায়নের পথে হাঁটতে পারে। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ বর্তমান সরকারের অনেক দিনের স্লোগান। পরিষেবা ক্ষেত্রে ভারত স্বীকৃত বিশ্বশক্তি, কিন্তু শিল্প-উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভারত এখনও সে রকম দাঁত ফোটাতে পারেনি, এবং চিনের থেকে এখনও বেশ কিছুটা পিছিয়ে। তাই ২০২৯ সালে সাত ট্রিলিয়ন ডলার মাপের অর্থব্যবস্থা হতে গেলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন শিল্পে জোর দিতেই হবে। এক বার অর্থনীতি গতি পেলে সব শ্রেণির মানুষের মঙ্গল। শিল্পায়নের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের নিয়োগের হার বৃদ্ধি করার জন্যও সরকার পদক্ষেপ করতে পারে।

২০২৯-এ সাত লক্ষ-কোটি ডলারে পৌঁছতে গেলে আর একটি কর্তব্য হল রফতানি বৃদ্ধি। চিনের অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নতির একটি বড় কারণ হল উৎপাদন শিল্পের বৃদ্ধির সঙ্গে রফতানি বৃদ্ধি, যা তাদের উৎপাদন শিল্পের চাহিদা বহুলাংশে বাড়াতে সাহায্য করেছিল। তাই ভারতীয় শিল্পসামগ্রীর গুণগত মানের উন্নয়ন আবশ্যিক এবং ভারতের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক দিগ্‌দর্শনে রফতানি বৃদ্ধি সংক্রান্ত পদক্ষেপ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এমন আশা করা যায়। কৃষিক্ষেত্রের আধুনিকীকরণের জন্য সরকারের আবার উদ্যোগী হওয়া উচিত। ধনী কৃষক সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ ‘যেমন চলছে চলুক, আর আধুনিকীকরণ করে কী হবে’ এই রোগে ভুগছে। কিন্তু কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন না বাড়লে বর্ধিত মূল্যস্ফীতির সম্ভাবনা, যাকে এড়ানো অতিপ্রয়োজনীয়।

সামাজিক ক্ষেত্রে সব সরকারই কিছু না কিছু করে থাকে, কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট সেখানেই। তবুও পুষ্টির দিকে আলাদা করে নজর দেওয়া উচিত। দুধ, সয়াবিন, ডিম যাতে সস্তায় গ্রাম ও অনুন্নত অঞ্চলে পাওয়া যায়, সরকারের উচিত তার ব্যবস্থা করা। এগুলি অপেক্ষাকৃত সস্তা, কিন্তু এগুলির পুষ্টিগুণ প্রচুর। তাই অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চলে এগুলি যদি আরও কিছুটা সস্তায় দেওয়া যায় তা হলে তার সুদূরপ্রসারী সুফল পাওয়া যেতে পারে। এর জন্য ‘ভারত-মার্ট’ বা ‘সফল’ জাতীয় নেটওয়ার্ক দেশের অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। আমাদের দেশের একটি বড় অংশের শিশু এখনও অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগে। আজকের শিশুরাই ভবিষ্যতে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তারা যদি অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগে, তা হলে অর্থনীতির রথের চাকা মাটিতে বসে যাওয়ার সম্ভাবনা। জনস্বাস্থ্য নিয়ে সরকার উদ্যোগী হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অংশে ‘এমস’ তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে। তবে এই বিষয়ে রাজ্য সরকারগুলিরও ভূমিকা অনেক। আশা করি সবাই দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে কাজ করবে।

সর্বোপরি শিক্ষা। করোনা অতিমারির পর প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা বেহাল। উচ্চশিক্ষার অবস্থাও কহতব্য নয়। প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারের কিছু পদক্ষেপ আশা করছি। দরকার হলে বেসরকারি সংস্থা যদি প্রাথমিক শিক্ষায় বিনিয়োগ করে, সে ক্ষেত্রে ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি’-র জন্য কিছু কর ছাড়ের কথা ভাবা উচিত। এতে স্বল্পকালীন কিছু কর আদায় কমলেও মানবসম্পদ উন্নয়নের সুদূরপ্রসারী লাভ আছে। বাকি রইল উচ্চশিক্ষা। নতুন শিক্ষানীতি আসার পর দেশের সরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পরিকাঠামো উন্নয়ন খুব জরুরি। আরও জরুরি হল গবেষণা ও উদ্ভাবনে উৎসাহ দেওয়া। এর জন্য উচ্চশিক্ষা বাবদ বরাদ্দ বাড়ানো এবং সরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে স্বাধীনতা দেওয়া জরুরি। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়োগ সংক্রান্ত স্বাধীনতার কথাও ভাবা যেতে পারে, যাতে তারা নিয়মের জাঁতাকলের বাইরে গিয়ে ভাল উপযুক্ত শিক্ষক ও গবেষককে তাদের প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসতে পারে বা নিয়োগ করতে পারে। অর্থনীতির উদারনীতির পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে, বিশেষত শিক্ষায় উদারনীতি দেশকে অনেক দূর এগিয়ে দিতে পারে। দেশ এগোলে নিশ্চয়ই ‘পদ্ধতি’ নিয়ে কারও কোনও আপত্তি থাকবে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement