—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
সাধ্যের অতিরিক্ত ঋণ নেওয়া, আর তা শোধ করতে না পেরে কার্যত দাসে পরিণত হওয়া, এই ব্যবস্থার সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয় হয় গ্রামীণ অর্থনীতিতে। জমিদার বা জোতদারের ঋণ শোধ করতে না পেরে চাষিদের কী করুণ দশা হত, তার সাক্ষ্য মেলে ইতিহাসের পাঠ্যে, সাহিত্যে, নাটকে। কিন্তু সেই ব্যবস্থা যে আজও চলছে, তা অনেকেই খেয়াল করেন না। গ্রাম এবং শহরের নানা অসংগঠিত শিল্পে, যেমন ইটভাটা, পাথর খাদান, কয়লা খাদান, গৃহশ্রম, সার্কাস, যৌনকাজ এবং কৃষিতেও দাস-শ্রমিক দশায় কাজ করছেন বহু মানুষ। দাস-শ্রম তাকেই বলে, যেখানে চড়া সুদে টাকা ধার দেন মালিক বা জমিদার, এবং অতি অল্প মজুরিতে কাজ করে তা শোধ দিতে বাধ্য করেন। যদিও ১৯৭৬ সালে আইন করে দাস-শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তবু নানা রূপে এখনও তার প্রচলন রয়েছে। লক্ষ লক্ষ নারী, শিশু ও পুরুষ এমন পরিস্থিতিতে কাজ করছেন, যাকে দাসত্ব ছাড়া আর কিছু বলা কঠিন। মানুষ পাচার চক্রে ক্রমশ বাড়ছে দাস-শ্রমিক পাচারের অংশ।
মানুষ পাচার বলতে বোঝায় এমন একটা প্রক্রিয়া, যার মধ্যে বহু মানুষকে এমন ভাবে ধরে রাখা হয়, যাতে কিছু লোকের আর্থিক লাভের জন্য ওই মানুষদের শোষণ চলতেই থাকে। পাচার হতে পারে দেশের মধ্যেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়, অথবা দেশের সীমা পার করে। অনেক কারণেই পাচার হয়— জোর করে নানা কারখানায় কাজ করানো, জমিতে বা গৃহস্থালির কাজ করানো, যৌন কাজ, বা জোর করে বিয়ে। শিশুদের যৌন নির্যাতন, তাদের যৌন ব্যবসায় বাধ্য করা, নাবালিকা বিয়ে, এগুলি ভারতীয় সংবিধানের তেইশ নম্বর ধারায় নিষিদ্ধ। কিন্তু তাতেও তার প্রকোপ কমেনি।
বরং সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, ভারতের অর্থনীতি যত বেড়েছে, তত বেড়েছে সস্তায় শ্রমের চাহিদা। বিশেষ করে নির্মাণ ক্ষেত্রে শ্রমের চাহিদা বিপুল, নির্মাণের খরচ কমাতে মজুরি কম রাখার তাগিদও খুব বেশি। বিভিন্ন ধরনের উৎপাদন, এবং তাদের সহযোগী ক্ষেত্রগুলিতেও সস্তা শ্রমের চাহিদা বাড়ছে। দেখা যাচ্ছে, যে সব রাজ্যে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা সীমিত, যেমন পশ্চিমবঙ্গ, বিহার এবং ওড়িশা, সেই সব রাজ্য থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের একাংশ দাসত্বের পরিবেশে আটকে পড়ছেন। কয়েক দশক আগেও পশ্চিমবঙ্গ বিহার এবং ওড়িশাথেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের আশ্রয় দিত, কাজ দিত। আজ শিল্পের পরিসর সঙ্কীর্ণ হওয়ায়, এবং কাজের সুযোগ কমে আসায় প্রচুর শ্রমিক বেরিয়ে যাচ্ছেন রাজ্য থেকে।
ভারতে বর্তমানে অনেক পাচার-বিরোধী আইন রয়েছে, সাধারণত একটি আইন একটি বিশেষ ধরনের পাচারের বিরুদ্ধে করা হয়েছে। এই আইনগুলির মধ্যে নানা বিরোধ দেখা যায়, কারণ নানা সময়ে, নানা বিশিষ্ট চাহিদার প্রেক্ষিতে এগুলি তৈরি হয়েছে। আজ এই আইনগুলি প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়, কারণ পাচারকারীরা অনেক নতুন নতুন উপায়ে কাজ করছে। এই আইনগুলি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না, পুরনো হয়ে পড়ছে। যেমন, ১৯৭৬ সালে তৈরি আইনটির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কৃষিতে দাস-শ্রমিক খুঁজে বার করা এবং তাঁদের পুনর্বাসন। এই আইন কৃষিক্ষেত্রে কিছুটা প্রাসঙ্গিক হয়তো আছে, কিন্তু বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে, বা একই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় দাস-শ্রমিক উদ্ধার করার জন্য যথেষ্ট নয়।
শীর্ষ আদালত ২০১৫ সালে কেন্দ্রকে নির্দেশ দিয়েছিল এমন একটি আইন প্রণয়ন করতে যা পাচার-সম্পর্কিত সব দিককে বিবেচনায় রাখবে, এবং ভবিষ্যতের প্রতিও নজর দেবে। ‘ট্র্যাফিকিং ইন পার্সনস (প্রিভেনশন, কেয়ার অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন)’ প্রস্তাবিত আইনটি লোকসভায় পেশ হয় ২০১৮ সালে। সাধারণের কাছে তার খসড়া প্রকাশও করা হয়, এবং তা নিয়ে নানা বিতর্ক হয়। যেমন, এক পক্ষ মনে করেন, পাচার রোধে পুলিশকে আরও কঠোর হতে হবে— হানা দিয়ে উদ্ধারে আরও তৎপরতা চাই। অন্য পক্ষের যুক্তি ছিল, পাচারের উৎস অনুন্নয়ন, পুলিশি সক্রিয়তা দিয়ে একে রোখা যাবে না। তেমনই, অনেকে বলেন যে, আন্তঃরাজ্য পাচার রোধের সমন্বয়কারী সংস্থা হওয়া উচিত ‘ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি’, কিন্তু রাজ্যগুলি তাতে রাজি হয়নি। শেষ অবধি অবশ্য এই প্রস্তাবিত আইন রাজ্যসভায় পাশ করা যায়নি, এবং তার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে। একটি নতুন আইন (ট্র্যাফিকিং অব পার্সনস— প্রোটেকশন, কেয়ার অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন) এখন বিবেচনাধীন, সুপ্রিম কোর্টে গত বছর ডিসেম্বরে একটি হলফনামায় এমনই জানিয়েছে মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রক। তার খসড়া অবশ্য প্রকাশ করা হয়নি।
শোনা যাচ্ছে, এই নতুন আইনের অধীনে আনা হবে মানুষ পাচারের সব দিক— যেমন, যৌন নিপীড়ন, বন্দিদশায় শ্রম, দাস-শ্রম, যৌন দাসত্ব এবং দেহাংশের পাচার। সেই সব অপরাধের জন্যকঠোর সাজার বিধান দিয়েছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডও দিয়েছে।
তবে বাস্তবিক এই প্রস্তাবিত আইনে কী রয়েছে, তা জানা যায়নি। কারণ কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা অবধি পৌঁছলেও, লোকসভায় এখনও অবধি তা পেশ হয়নি, আইনের খসড়াও প্রকাশ করা হয়নি।
২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে আইনটি পেশ হবে, এমন সম্ভাবনা কম। নরেন্দ্র মোদী সরকারের শাসনকালে পাচার ও দাস-শ্রম প্রতিরোধে কোনও আইন তৈরি করা গেল না, এটা একটা আক্ষেপের বিষয় বইকি।