দ্যূতসভা: মহাভারত-এর দৃশ্যের রঙিন লিথোগ্রাফ, ১৮৯৫। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস।
ইতিহাস’ শব্দটি যে ‘হিস্ট্রি’-র আক্ষরিক অনুবাদ নয়, পরবর্তী-বৈদিক যুগ (খ্রিস্টপূর্ব ১০০০-৬০০ অব্দ) থেকে প্রচলিত চারণকবিদের একটি বিশেষ মৌখিক পরম্পরাকে নির্দেশ করে, তা এখন প্রতিষ্ঠিত। যদিও ব্যুৎপত্তিগত ভাবে ইতিহাস মানে ‘যেমনটা অতীতে হয়েছিল’, অতীতের বিবরণ থেকে শিক্ষাপ্রদান বা দৃষ্টান্ত স্থাপনই তার লক্ষ্য। ঘটনার তথ্যানুগ ও কালানুক্রমিক পরিবেশনের চেয়ে সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি-ধর্ম মিলিয়ে একটা সময়ের সামগ্রিক ছবি তুলে ধরা— যা থেকে তাৎপর্যপূর্ণ উপদেশ গ্রহণ সম্ভব— ইতিহাসের বিষয়। প্রাচীন ভারতের যে গ্রন্থটি ইতিহাস হিসাবে নিজের পরিচয় দেয়, সেই মহাভারত নিজের সাফল্যকে ব্যাখ্যা করেছে ইতিহাসের এই সংজ্ঞা অনুসারেই: “ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ বিষয়ে যা এখানে রয়েছে, তা অন্যত্র থাকতে পারে, যা এখানে নেই তা কোথাও নেই।”
কিন্তু, মহাভারত-কে ইতিহাস হিসাবে পাঠের সমস্যা হল, প্রায় লক্ষ শ্লোকের এই মহাগ্রন্থ চারণকবিদের মৌখিক ইতিহাস থেকে বর্তমান লিখিত রূপ পেয়েছে বহু স্তর পেরিয়ে। ক্রিশ্চিয়ান ল্যাসেন, অ্যাডল্ফ হোলৎজ়মান প্রমুখ গবেষক ‘বিশ্লেষণাত্মক’ পদ্ধতিতে ‘আদি-মহাভারত’ পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করলেও বিশেষ সফল হননি। মহাভারতের স্তরবিন্যাসের চেষ্টায় ই ওয়াশবার্ন হপকিন্স মহাভারত রচনার সময়সীমা নির্ধারণ করেন খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতক। অন্য দিকে, ‘সমন্বয়ধর্মী’ পদ্ধতিতে বিশ্বাসী গবেষকেরা আনন্দবর্ধন ও অভিনবগুপ্তের মতো সাহিত্যতাত্ত্বিকদের অনুসরণ করে মহাভারত-কে একটি অখণ্ড সাহিত্যগ্রন্থ হিসাবেই দেখতে চান। ভি এস সুকথঙ্কর বলেন, মূল মহাভারত-এর ঐতিহাসিক বিষয়বস্তু যা-ই থাকুক, এর ব্রাহ্মণায়ন ঘটানো ভার্গবরা তা গ্রাস করে নিয়েছেন। বর্তমান মহাভারত একটি অখণ্ড কাব্যগ্রন্থ। সুকথঙ্করের সম্পাদনায় পুণের ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এ বিভিন্ন পাণ্ডুলিপির প্রতিতুলনার মাধ্যমে প্রক্ষিপ্ত অংশগুলি বাদ দিয়ে নির্মিত হয় মহাভারত-এর প্রামাণ্য গ্রন্থরূপ, ‘ক্রিটিক্যাল এডিশন’। এটি আদি মহাভারত নয়, বড়জোর খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দী বা তার পরের ব্রাহ্মণ্য নিয়ন্ত্রণে লিখিত রূপ। এর মূলের ইতিহাস-পরম্পরা উদ্ধার করা অসম্ভব বলেই সুকথঙ্করের মত।
সদ্যপ্রয়াত আল্ফ হিল্টেবাইটেলের মতে, মহাভারত কখনওই চারণকবিদের মৌখিক পরম্পরায় সৃষ্টি হয়নি— খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় বা প্রথম শতকে একটি ব্রাহ্মণগোষ্ঠী সম্মিলিত ভাবে মহাভারত রচনা করেছিলেন মৌর্য-পরবর্তী যুগে ব্রাহ্মণ্য রাজধর্মের প্রচারের উদ্দেশ্যে। মহাভারত পরম্পরাগত ইতিহাস নয়, এর স্তরবিন্যাসের চেষ্টা নিরর্থক। এই মত অবশ্য মানা কঠিন। মহাভারত নিজেই মৌখিক কথন ও পুনর্কথনের মাধ্যমে কয়েকটি স্তরে তার বিকাশ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। যেমন, কুরু রাজসভার সূত (চারণকবি) সঞ্জয়ের ধৃতরাষ্ট্রকে যুদ্ধবিবরণী শোনানো; এই কাহিনিকে কেন্দ্র করে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের ইতিহাস রচনা; জনমেজয়ের যজ্ঞে বৈশম্পায়নের সেই ইতিহাস পুনর্কথন; এবং সূত রোমহর্ষণের পুত্র উগ্রশ্রবার নৈমিষারণ্যে শৌনকগোষ্ঠীর ভার্গব ব্রাহ্মণদের যজ্ঞে এই কাহিনি পরিবেশন। কুরুরাজসভার পৃষ্ঠপোষকতায় সূতদের মৌখিক পরম্পরায় মহাভারতের সৃষ্টি এবং ভার্গবগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে মহাভারত-এর ব্রাহ্মণায়ন এর অভ্যন্তরেই সমর্থিত।
পরবর্তী-বৈদিক সাহিত্যে কুরু-পাঞ্চাল অঞ্চল অতি গুরুত্বপূর্ণ। ঋগ্বেদ-এর নবীনতম অংশে উল্লিখিত শান্তনু ও অথর্ববেদে সমসাময়িক কুরুরাজ হিসাবে প্রশংসিত পরীক্ষিতের অন্তর্বর্তী কুরুদের কাহিনিই মহাভারত-এর মূল আখ্যান। পরীক্ষিৎ-পুত্র জনমেজয় পরবর্তী-বৈদিকসাহিত্যে সুপরিচিত। বৈশম্পায়নও আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রে ‘মহাভারতাচার্য’ বলে অভিহিত। যজুর্বেদের কঠক সংহিতায় বিচিত্রবীর্যপুত্র ধৃতরাষ্ট্রের উল্লেখ আছে। ছান্দোগ্য উপনিষদে পাওয়া যায় কৃষ্ণ দেবকীপুত্রের নাম। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে ‘মহাভারত’ ও ‘যুধিষ্ঠির’ নামগুলির পাশাপাশি বাসুদেব (কৃষ্ণ) ও অর্জুনের উপাসক সম্প্রদায়ের উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈন পরম্পরাতেও রয়েছে মহাভারত ও কৃষ্ণকাহিনির উল্লেখ। খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দের প্রথমার্ধেই মহাভারত-পরম্পরা অপরিচিত ছিল না।
রোমিলা থাপর, রামশরণ শর্মা, কেভিন ম্যাকগ্রাদের গবেষণা দেখিয়েছে যে, মহাভারতের মূল আখ্যান আর উপদেশমূলক অংশগুলির পরিপ্রেক্ষিতগত পার্থক্য তুলে ধরে ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ সম্ভব। মূল আখ্যানভাগের প্রেক্ষাপট পরবর্তী-বৈদিক যুগের কৌমসমাজের, সুসংগঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থার নয়। খাণ্ডববন ধ্বংস করে কৃষিসভ্যতার বিকাশ, বংশরক্ষার জন্য নিয়োগপ্রথার প্রচলন, নারীর বহুবিবাহের সম্ভাবনা, রাজসূয় যজ্ঞ ও পাশাখেলার মাধ্যমে উত্তরাধিকারের দ্বন্দ্ব নিরসন, লিপি ও মুদ্রার অনুপস্থিতি, সেই কৌমসমাজের পরিচয়বাহী। রাজা মূলত গোষ্ঠীপতি। বেতনভুক কর্মচারী, সুসংগঠিত করব্যবস্থা, স্থায়ী সেনাবাহিনীর মাধ্যমে নয়— ধৃতরাষ্ট্র-যুধিষ্ঠির-দুর্যোধনদের শাসন চালিত হয় ভাই, আত্মীয়, বন্ধু, গুরুদের সহায়তায়। রাজসূয় যজ্ঞের উপহার বা পাশাখেলায় বাজি রাখা জিনিসের তালিকা থেকে বোঝা যায় জমি বা মুদ্রা নয়, পশুসম্পদ, দাসদাসী এবং মূল্যবান ধাতু ও পাথরই ছিল প্রধান সম্পদ। মুদ্রা-পূর্ববর্তী অর্থনীতিতে গো-সম্পদের গুরুত্ব বোঝায় বিরাটরাজের গোধন-হরণের জন্য কুরুযোদ্ধাদের অভিযান।
পরবর্তী-বৈদিক যুগ এক পালাবদলের সময়। একদা-যাযাবর বৈদিক জনগোষ্ঠীগুলি তখন স্থিতিশীল হচ্ছে কৃষিভিত্তিক জনপদে। বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রকে অনুমোদন দিচ্ছেন পুরোহিতেরা। সমাজকে তাঁরা ভাগ করছেন জন্মভিত্তিক চতুর্বর্ণে। বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ড ও বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে উচ্চারিত হচ্ছে প্রতিবাদ, যা কালক্রমে সংগঠিত হবে বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি বিকল্প মতে। মহাভারত-আখ্যান তাই এক ‘যুগান্ত’-এর প্রতিচ্ছবি। জন্মগত বর্ণ না গুণগত যোগ্যতা, কী নির্ধারণ করবে মানুষের সামাজিক ভূমিকা, এই প্রশ্নের জটিলতাই প্রতিফলিত বিদুর, কর্ণ, একলব্যদের জীবনে, আখ্যানের কেন্দ্রীয় উত্তরাধিকারের দ্বন্দ্বেও। জ্যেষ্ঠপুত্রের জ্যেষ্ঠপুত্র দুর্যোধনের আস্থা ক্ষত্রিয় বর্ণধর্মে, বিনা যুদ্ধে অধিকারত্যাগ তাঁর কাছে অধর্ম। যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর ফলে স্বর্গলাভের ক্ষত্রিয়োচিত পুরস্কারও জোটে তাঁর। আবার প্রজাপ্রিয় ‘ধর্মরাজ’ যুধিষ্ঠির প্রশ্ন তোলেন জন্মভিত্তিক বর্ণব্যবস্থার যৌক্তিকতা নিয়ে। তাঁর মতে ব্রাহ্মণত্বের ভিত্তি সদাচার, ক্ষত্রিয়ের যুদ্ধকেন্দ্রিক হিংসা পরিত্যাজ্য পাশবিকতা। যুধিষ্ঠিরের হিংসাবিরোধিতা সন্ন্যাসপন্থী ‘অহিংসা’ নয়। বরং মহাভারত তুলে ধরেছে ধর্মের নতুন আদর্শ ‘আনৃশংস্য’, যার ভিত্তি সর্বভূতের প্রতি সমানুভূতি (অনুক্রোশ)। এই আদর্শ ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজনীয় হিংসার বাস্তব সম্ভাবনা স্বীকার করেও মনে করায় হিংসা অবাঞ্ছিত। নৃশংসতা নয়, সহমর্মিতাই ধর্ম। স্বর্গলাভের লোভেও সঙ্গী কুকুরটিকে ত্যাগ করার নৃশংসতা করতে পারেন না যুধিষ্ঠির।
আবার, মহাভারত-এর ‘শান্তিপর্ব’, ‘অনুশাসনপর্ব’ প্রভৃতি উপদেশমূলক অংশগুলিতে রয়েছে সুগঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা, বেতনভুক প্রশাসন, স্থায়ী সেনাবাহিনী, মুদ্রাব্যবস্থা, সাক্ষরতা, ভূসম্পদের গুরুত্ব ও পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের ছাপ। জেমস ফিৎজ়জেরাল্ড দেখিয়েছেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি দেখে রাজ্যত্যাগ করতে চাওয়া যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক অশোকের কলিঙ্গ যুদ্ধ-পরবর্তী স্বরের সাদৃশ্য। মৌর্য সম্রাটদের প্রতিবাদী ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষুব্ধ, আশঙ্কিত ব্রাহ্মণদের পরিমার্জনে তাই শরশয্যাশায়ী ভীষ্মের কাছে নতুন করে রাজধর্মের পাঠ নিতে হয় যুধিষ্ঠিরকে। ‘শান্তিপর্ব’-এর রাজধর্ম বর্ণাশ্রমনির্ভর, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, মৌর্য-পরবর্তী যুগের ধর্মশাস্ত্র মনুস্মৃতি-র সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। ‘আরণ্যকপর্ব’-এর উপদেশমূলক অংশে ধর্মব্যাধ ‘আনৃশংস্য’-কেও করতে চান বর্ণব্যবস্থার অনুগামী। যাদব-বৃষ্ণি গণসঙ্ঘের দেবতায়িত নায়ক বাসুদেব কৃষ্ণ মিশে যান পৌরাণিক বিষ্ণুর সঙ্গে। ভার্গব ব্রাহ্মণদের কাহিনিপরম্পরাও যুক্ত হয়, যার নায়ক পরশুরাম ব্রাহ্মণবিরোধী রাজাদের হত্যা করতেও পিছপা নন।
মহাভারত নির্দিষ্ট ঘটনার তথ্যনিষ্ঠ ‘হিস্ট্রি’ নয়। এতে বিধৃত আছে দু’টি ভিন্ন সময়ের, ভিন্ন রচয়িতাদের অতীতচেতনার দলিল। মহাভারত-এর কবিও নিশ্চিত, “এই ইতিহাস অতীতের কবিরা বলেছেন, বর্তমানের কবিরা বলছেন। ভবিষ্যতে বলবেন অন্যেরাও।”