প্রতিরোধী: কামদুনি ঘটনার পর কলকাতার রাস্তায় মিছিল, ২০১৩।
পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক ‘পরিবর্তন’-এর পর দিন থেকেই শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের যাবতীয় অন্যায় এবং ব্যর্থতার দায় অনেকাংশে এ রাজ্যের এক দল শিল্পী, লেখক, কবি, অধ্যাপক, চলচ্চিত্রকার, অভিনেতা, সঙ্গীতশিল্পী এবং নাট্যশিল্পীর উপরে, আরও স্পষ্ট ভাবে বললে আমরা যারা ‘পরিবর্তন’ চেয়েছিলাম তাদের উপরে, বর্তাতে শুরু করে। সিপিআইএম ও বামফ্রন্টকে আমরা যারা আর ক্ষমতায় দেখতে চাইনি, সেই গোষ্ঠীর মধ্যে কোনও দিনই কোনও সমন্বয় ছিল না। ছিল না ভাবনাচিন্তার কোনও মিল। প্রত্যেকেরই ছিল স্বাধীন ভাবে, ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ ও রাজনীতিকে দেখার ও বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা। এবং অনিবার্য ভাবে ছিল কিছু ব্যক্তিগত হিসাবনিকাশ ও স্বার্থ। এর ফলে একটি অংশ সরাসরি চলে গেলেন তৃণমূল কংগ্রেসের শিবিরে। অন্য দলটি, আমরা যারা সংখ্যায় আরও কমে গেলাম, ২০১১ সালের পর থেকেই সদ্য ক্ষমতায় আসা রাজনৈতিক দলটির বিরুদ্ধে যখনই সুযোগ ও প্রয়োজন বুঝেছি তখনই প্রতিবাদ করেছি। অসংগঠিত ভাবে মিটিং, মিছিল, লেখালিখি, বিভিন্ন বৈদ্যুতিন মাধ্যমে বক্তব্য ও বিতর্ক বা শিল্পকলার মাধ্যমে যা-যা অন্যায় বলে মনে হয়েছে, সে বিষয়ে আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ করেছি।
ক্রমশ এই নাগরিক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আরও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটতে শুরু করল। পরিবর্তনপন্থী এই নাগরিক সমাজকে বুদ্ধিজীবী তকমা দিয়ে চিহ্নিত করা শুরু হল। প্রথমে কিছুটা শ্রদ্ধা সহকারে, পরে যখন তৃণমূল কংগ্রেসের একের পর এক ব্যর্থতা উন্মোচিত হতে শুরু করল তখন ব্যঙ্গ, অসম্মান ও কুৎসা শুরু হল। আমরা, যারা নগরসভ্যতার আচ্ছাদনে লালিত, শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত, নানান ভাবে সচেতন বা অসচেতন ভাবে বর্তমান শাসক দলের নানা ভ্রান্তি ও অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েছি, তাদের সমালোচিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কিন্তু খুব সচেতন ভাবে, হিসাব কষে যখন সরব ও নীরব দুই নাগরিক সমাজকে একই গোত্রে ফেলে আক্রমণ শাণানো হয়, তখনই বোঝা যায় এই আক্রমণ নিছক আবেগতাড়িত নয়, এর পিছনে অন্য একটি পরিকল্পনা আছে।
২০২১ সালে ‘বিজেপি-কে একটি ভোট নয়’ স্লোগান এবং সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্কীর্ণ মতবাদের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের একটা বড় অংশ সক্রিয় হয়েছিল বিধানসভা নির্বাচনের আগে। নাগরিক সমাজের একটা অংশের মনে হয়েছিল তৃণমূল ও ভারতীয় জনতা পার্টি উভয়ই সমান বিপজ্জনক; আমাদের একটা অংশের মনে হয়েছিল, তৃণমূল দুর্নীতিগ্রস্ত এবং নানান দোষে পরিপূর্ণ হলেও বিজেপির মতো সর্বগ্রাসী ফ্যাসিস্ট শক্তি নয়। হওয়াটা সম্ভবও নয়। আরএসএস ও বিজেপির যে প্রস্তুতি, তা আজকের নয়। তৃণমূল কংগ্রেস কেন, বামপন্থীরা ছাড়া সাংগঠনিক এবং মতাদর্শগত ভাবে এত মজবুত ভারতের কোনও রাজনৈতিক দলই নয়। আমাদের দেশ সমস্ত দিক দিয়েই আজ সে বিপদের সামনে, অতীতে কোনও রাজনৈতিক দল বা মতবাদ দেশের গরিব মানুষদের এতটা বিপদের মধ্যে ফেলেনি। এই সত্যটা ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে খানিকটা স্পষ্ট হয়েছিল। তাই তৃণমূল কংগ্রেসের অপদার্থতাকে মেনে নিয়েও মানুষ নতুন কোনও বিপদকে ডেকে আনতে চাননি। অবশ্যই অস্বীকার করার কোনও মানেই হয় না যে, নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর সরকারের তৈরি বেশ কিছু প্রকল্প সরাসরি গ্রামবাংলার গরিব মানুষের উপকার করেছিল, তাই মাঝারি মাপের নেতা-কর্মীদের লুটপাট, দুর্নীতি ও অত্যাচার মেনে নিয়েও মানুষ বিজেপিকে বর্জন করেছিলেন।
কংগ্রেস-বামদলগুলি ও আইএসএফ জোট মানুষের মনে সামান্যতম দাগ কাটতে ব্যর্থ হয়। কেন হয় তার বিচার বিশ্লেষণ তাঁরা নিশ্চয়ই করেছেন বা করবেন, কিন্তু চৌত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতার কারণে এ রাজ্যে শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, ভদ্রলোক শ্রেণির বাঙালির ভিতরে একটা প্রবণতা প্রবল ভাবে প্রবেশ করে গেছে; সেটা হল: তৃণমূল কংগ্রেসকে সরানোটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ, বাম-কংগ্রেস না পারলে বিজেপি-আরএসএস’ই সই। তাই তো কলকাতা শহরে ২২ জানুয়ারির সেই মাহেন্দ্রক্ষণে দেশের প্রধানমন্ত্রী পূজারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে যখন দেশের সংবিধানকে অসম্মানিত করলেন সমস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সন্ত্রস্ত এবং দেশ ও রাজ্যের সমস্ত ছোটবড় সংবাদমাধ্যম খবর পরিবেশনের নামে আদতে ভারতীয় জনতা পার্টির নির্বাচনী প্রচারের অংশ হয়ে উঠল— তখন কখনও সরবে, প্রকাশ্যে বা ঘরের ভিতর নীরবে, নিভৃতে শাঁখ ও ঘণ্টাধ্বনির শব্দ পাওয়া গেল। রামলালার ঘরে ফেরা সম্পূর্ণ হল। বহু খুন, অগণিত দাঙ্গা, অসংখ্য মানুষের সর্বস্বান্ত হওয়ার পর অবশেষে আরএসএস-বিজেপির বড় জয়... কিসের বিনিময়ে, সে প্রশ্ন উঠলই না প্রায়। দারিদ্র বেকারত্ব মিথ্যাচারকে আড়াল করে প্রায় সমস্ত সংবাদমাধ্যম রামমন্দির প্রতিষ্ঠার সাত দিন আগে থেকে তা নিয়ে যে দৃশ্যকল্প তৈরি করল, তাতে তারা যে নিরপেক্ষ এমন ভাবাটা দুষ্কর। অথচ সেই সংবাদমাধ্যমের স্টুডিয়োতে বসেই বুদ্ধিজীবীরা কেন রাস্তায় নামছেন না বা তাঁরা আসলে সবাই বিক্রি হয়ে গেছেন এমন ধারণা ও নিদান এক শ্রেণির রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষকরা করে চলেন। অবশ্যই সেই অধিকার তাঁদের আছে। এই আক্রমণ ও নিদান সবটাই উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কিন্তু এক বার ভেবে দেখুন, কেন পশ্চিমবঙ্গে কোনও রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হলেই সংবাদমাধ্যমের ফোন অথবা ক্যামেরা কিছু নাগরিককে ধাওয়া করে। ঘুরে ফিরে সেই কিছু নাম, কিছু মুখ— তাঁদের মতামত নেওয়া চাই-ই, আবার তাঁদের মতামতকে কেন্দ্র করে, অথবা তাঁদের নীরবতাকে কেন্দ্র করে আলোচনা, বিতর্ক, খারাপ কথার আসর জমানোও চাই। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা, সংস্কৃতির জগতের গুণী ও নামী মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়, এঁদের বেশির ভাগই কিন্তু চুপ করেই ছিলেন অথবা আছেন। নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর, লালগড় কিংবা নেতাই— বামফ্রন্টের দীর্ঘ রাজত্বকালে আমরা প্রচুর রাজনৈতিক আন্দোলন দেখেছি। দেখেছি মুড়ি-মুড়কির মতো বাংলা ও ভারত বনধ, কিন্তু তৎকালীন বাম সরকারের বিরুদ্ধে ক’টা নাগরিক কিংবা বুদ্ধিজীবীদের সমাবেশ বা মিছিল দেখেছি? বানতলা, ভিখারি পাসোয়ান, আনন্দমার্গী হত্যা, মরিচঝাঁপিকে তো এঁরা অস্বীকার করেন— কিংবা দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ, সুচপুর, ছোট আঙারিয়াকে। চোখের সামনে ঘটেছে বৌবাজারে বিস্ফোরণ, তৎকালীন মন্ত্রীর ছত্রছায়ায় দাগি আসামিরা লুকিয়ে থাকার সাহস পেয়েছে। অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়। তখন ছিল না ফেসবুক, ছিল না রংবেরঙের টেলিভিশন চ্যানেল, কিন্তু খবরের কাগজের মাধ্যমে সব কিছুই জানা যেত। তবু কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গ খোঁজ করেনি, বুদ্ধিজীবীরা কোথায়? তাই আজ যখন খুব হিসাব কষে সরব ও নীরব নাগরিক সমাজকে এক গোত্রে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না এটা সব রাজনৈতিক দলেরই মনোগত বাসনা।
এই মুহূর্তে শেখ শাহজাহান, শিবু হাজরারা পুলিশের কব্জায়, কিন্তু সন্দেশখালির অথবা পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্তের মানুষদের তৃণমূল সরকারের প্রতি আস্থা তলানিতে, কেননা বোঝা সহজ যে সর্বোচ্চ নেতৃত্বের প্রশ্রয় ছাড়া শাহজাহানের দলবল এত বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে না। দুর্নীতি, গোষ্ঠী-কোন্দলে আকীর্ণ, গরিব মানুষদের ক্রমাগত কোণঠাসা করে চলা তৃণমূল তৈরি করে নিয়েছে এক সাংস্কৃতিক বলয়। তথাকথিত বিপ্লবী বাংলা থিয়েটার অনায়াসে মেনে নিয়েছে বিজেপি সরকারের পাঠানো প্রচার-নাটকের খসড়া। যাঁরা মেনে নিলেন, তাঁদের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে অষ্টপ্রহর জয়ধ্বনি করা নাট্যদলও আছে, ‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিপাত যাক’ স্লোগান দেওয়া দলও আছে। অবশ্য মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে যদি তাঁর রাজনৈতিক লড়াইয়ের স্বীকৃতি না দিয়ে বাংলা আকাদেমির সম্মান দেওয়া হয়, তবে আমরা যারা শিল্পচর্চা করি, দোষ আমাদের উপরেও বর্তায়।
অতীতে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম, শাহিন বাগ, কৃষক আন্দোলন, বর্তমানে সন্দেশখালি— এ সব শুধু ভোট-রাজনীতির বিষয় নয়। এই লড়াইগুলোর পরিণতি একটা বিধানসভা ভোট বা লোকসভা ভোটের মাধ্যমে হবে না। সম্প্রতি প্রভাত পট্টনায়ক ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন কী ভাবে নব্য উদারবাদী অর্থনীতির সঙ্গে নব্য ফ্যাসিবাদের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে গোটা বিশ্বে; ভারতও অন্যতম উদাহরণ। একই কথা ধ্বনিত হচ্ছে নাগরিক পরিসরে আলোচনাতেও। শুধু বিজেপি নয়, ক্ষমতানুযায়ী সমস্ত দলই পুঁজির পূজা এবং ধনীদের আরও ধনবান করার মহৎ কর্মে লিপ্ত। এর বিরুদ্ধে মতাদর্শগত ভাবে বামপন্থীরাই পারেন প্রতিরোধ গড়তে। এ দেশে এখনও বাম দলগুলি এত দ্বিধাদুর্বলতায় ভুগছে যে, আশার বদলে আশঙ্কা বেশি হয়।