—ফাইল চিত্র।
নজরুল ইসলামের গান নিয়ে রীতিমতো ঝড় বয়ে গেল কয়েক দিন। তাঁর লেখা গানের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। স্বভাবতই সব গান সমান পরিচিত নয়। পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিকে যদি প্রশ্ন করা হয় যে, নজরুলগীতি বলতে প্রথমেই কোন গানের কথা মনে আসে, তবে দেশাত্মবোধক গান, প্রেম-বিরহের গান ইত্যাদির পাশাপাশিই সম্ভবত ঠাঁই করে নেবে তাঁর লেখা ভক্তিগীতিও। কিন্তু, প্রশ্ন হল, ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’ বা ‘হে গোবিন্দ রাখো চরণে’-র মতো গান যত তাড়াতাড়ি মনে পড়ে, তাঁর ইসলামি সঙ্গীতের কথা কি মনে পড়ে তেমনই স্বচ্ছন্দে?
ইসলামি সঙ্গীতে প্রধান দু’টি প্রকার হল হামদ এবং নাত। ‘হামদ’ বলতে বোঝায় সৃষ্টিকর্তা আল্লার প্রশস্তিসূচক গান, আর ‘নাত’ হল গানের মাধ্যমে নবি মহম্মদের গুণকীর্তন। সঙ্গীতের মাধ্যমে নজরুল তুলে ধরেছেন ইসলাম ধর্মের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং কোরান-হাদিশের প্রসঙ্গ। এ ছাড়া ধার্মিক জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা দিকও উঠে এসেছে তাঁর গানে। কবি লিখেছেন, ‘যেদিন রোজ হাশরে করতে বিচার, তুমি হবে কাজী / সেদিন তোমার দিদার আমি, পাব কি আল্লাহ জি?’ আজানের সুরে মোহিত হয়ে লিখেছেন, ‘মসজিদেরই পাশে আমায়, কবর দিও ভাই / যেন গোরে থেকে মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।’
বাংলায় ইসলামি সঙ্গীতের সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়ে উঠেছিলেন নজরুল। ১৯৩১ সালে তাঁর লেখা, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে, এল খুশির ঈদ’ বাঙালি মুসলমানের প্রধান পরবের গান হয়ে উঠল। তুরস্কের বিখ্যাত গান ‘কাটিবিম ইশকাদার’-এর সুরে প্রভাবিত হয়ে কবি লিখেছেন, ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ, এলো রে দুনিয়ায়।’ গানটা হয়তো অচেনা ঠেকবে, তাই মনে করিয়ে দিই, এই একই সুরে তিনি লিখেছিলেন ‘শুকনো পাতার নুপূর পায়ে’। পয়গম্বর হজরত মহম্মদের মর্তে আগমন নিয়ে নজরুল লিখেছেন একাধিক গান— ‘হেরা হতে হেলে দুলে, নুরানী তনু’, কিংবা ‘আমিনা দুলাল নাচে, হালিমার কোলে’। এর মধ্যে ‘তোরা দেখে যা, আমিনা মায়ের কোলে’ গানটি প্রবল জনপ্রিয়, যা মহম্মদ রফির কণ্ঠেও শোনা গিয়েছে।
‘শোনো শোনো, ইয়া ইলাহী, আমার মোনাজাত’-এর যে আকুতি এবং তার মধ্যেকার অপার শান্তি আসলে অনুভবের। বাংলা ভাষায় ইসলামি সঙ্গীত রচনায় ভাব এবং সুরের দরদি মিশ্রণ ঘটানো ছিল নজরুলের মুনশিয়ানা, যা অনেকাংশে উর্দু গজলের আঙ্গিকে পরিস্ফুট হয়েছে। দাদরা, কাহারবা, ঠুমরির পাশাপাশি লোকসঙ্গীতের ব্যবহার ইসলামি গানকে সমৃদ্ধ করেছে। বিদেশি সুর থেকেও প্রেরণা নিয়েছেন তিনি। ‘আল্লাকে যে পাইতে চায় হজরতকে ভালবেসে/ আরশ্ কুরসি লওহ কালাম, না চাহিতেই পেয়েছে সে’— এমন ইসলামি গানে আরবি-ফারসি-উর্দু-হিন্দি শব্দের নিখুঁত ব্যবহার ভিন্ন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। শাক্ত সঙ্গীত রচনায় জনপ্রিয় নজরুল ইসলামি সঙ্গীতে মনোনিবেশ করলেন। ফল হিসাবে ‘হে নামাজী, আমার ঘরে নামাজ পড় আজ/ দিলাম তোমার চরণতলে হৃদয় জায়নামাজ’-এর মতো গান জন্মলাভ করল। লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ল এই গানগুলির নির্মাণের নানা কিসিমের গল্প।
অভাব-অনটন নবির দেশ দেখায় অন্তরায় ছিল। নজরুলের গানে সেই দিকটি বার বার ফুটে উঠেছে— ‘দূর আরবের স্বপন দেখি, বাংলাদেশের কুটির হতে’ কিংবা ‘মনে বড় আশা ছিল যাব মদিনায়’, কিংবা ‘ওরে ও দরিয়ার মাঝি, মোরে নিয়ে যা রে মদিনায়’। ‘আমি যদি আরব হতাম, মদিনারই পথ’ গানের ছত্রে ছত্রে উঠে এসেছে আক্ষেপ। আবার গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছেন তিনি, ‘এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি/ খোদা তোমার মেহেরবানী।’
এই গানগুলির সাঙ্গীতিক ঐশ্বর্য অতুলনীয়। কিন্তু, ‘মাগো চিন্ময়ী রূপ ধরে আয়’-এর মতো গান যতখানি গ্রহণযোগ্য হয়েছে সংস্কৃতিপ্রিয় বাঙালি সমাজে, ইসলামি গানে নিহিত আবেগ সে ভাবে জনপ্রিয় হয়নি। অথচ দুটোই সঙ্গীতের মাধ্যমে নজরুলের ভক্তির প্রকাশ। তবে কি সঙ্গীতের মূল্যায়নে ধর্মই প্রাধান্য পেয়েছে? যার কারণে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে কালী বা কৃষ্ণের বন্দনাটুকুই বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠল, কিন্তু একই ব্যক্তির লেখা অসামান্য হামদ এবং নাতগুলি ‘মুসলমানের গান’ হয়ে থেকে গেল? হয়তো এখানেই নজরুলের সর্বধর্মসমন্বয়ের চর্চা ‘সবার’ হয়ে ওঠেনি— হিন্দুরা তাঁর লেখা শ্যামাসঙ্গীত গ্রহণ করল, আর মুসলমান নিল নবি-রসুলের গুণগান। তবে কি এই অংশে ভাগ হয়ে গেলেন নজরুল?
এ পার বাংলার কয়েক জন শিল্পী বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা করেছেন ইসলামি গানকে বাঙালির কাছে পৌঁছে দিতে। সেই বিক্ষিপ্ত প্রচেষ্টাও সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালির কাছে তেমন ভাবে পৌঁছতে পারেনি। এখানেও হয়তো অদৃশ্য আমরা-ওরা।
সম্ভবত এ জন্যই প্রায় তিনশোটি ইসলামি সঙ্গীতের বিশাল রত্নভান্ডার অজানাই থেকে গেল বৃহৎ অংশের কাছে।
নজরুল তাঁর সৃষ্টিতে অভাবে মৃত শিশু-পাঁজরের হাড়ে ইদের চাঁদ দেখেছেন। ফরিয়াদ করেছেন। শ্রেণিচেতনা, ইসলাম, সৃষ্টিকর্তার প্রতি অনুযোগ, নিঃশর্ত সমর্পণ সব মিলেমিশে গেছে। জাকাতের মাধ্যমে গরিবকে দানের অসামান্য রীতি নিয়ে গান লিখেছেন। তবু কেন এই গানগুলো অচেনাই? কোনও অবাঙালির হাতে নজরুলের গান লাঞ্ছিত হওয়ায় বাঙালি ক্রুদ্ধ হয়, অথচ নজরুলকে ভাগ করে নিয়ে একটা অংশ বেমালুম ভুলে যায় সেই বাঙালিই?