Gaza City

একটি রাজনৈতিক লাভের গল্প

গত দু’বছরে চারখানা নির্বাচন সত্ত্বেও নির্বাচিত সরকার জোটেনি, ২০১৮’র পরে বার্ষিক বাজেট হয়নি, নীতি নির্ধারণে তৈরি হয়েছে জটিলতা

Advertisement

অতনু বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০২১ ০৫:১৪
Share:

পশ্চিম এশিয়ার আকাশে আবার ঝড়। আরব-ইহুদি ক্লান্তিহীন চাপানউতোর, প্রতিরোধ, সংঘর্ষ; আর আছড়ে পড়া রকেট নিয়ে নিরন্তর সহবাস গাজ়া, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, ইজ়রায়েলেরও। শুধু জেরুসালেম নয়, গোটা অঞ্চলই যেন ‘টাইম বম্ব’। ধ্বংস ও মৃত্যুর প্রলয়-নৃত্যে কারও সুবিধা হয়। সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক লাভ ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী তথা দক্ষিণপন্থী লিকুদ পার্টির নেতা বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু-র।

Advertisement

এমনিতে ইজ়রায়েল দেশটা রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যে রয়েছে। গত দু’বছরে চারখানা নির্বাচন সত্ত্বেও নির্বাচিত সরকার জোটেনি, ২০১৮’র পরে বার্ষিক বাজেট হয়নি, নীতি নির্ধারণে তৈরি হয়েছে জটিলতা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থা কমেছে। ইজ়রায়েলের রাজনীতি অত্যন্ত জটিল, একগাদা রাজনৈতিক দল, তীব্র দক্ষিণ থেকে বাম সব ভাবধারার, ক্ষেত্রবিশেষে ধর্মের মিশেল ঘটিয়ে। এদের এক সঙ্গে নিয়ে ট্রাপিজ়ের খেলাই যেন দেশটার রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থায় চলে ইজ়রায়েল। সংসদ বা ‘কেনেসেট’-এ কোনও দলের আসন সংখ্যা নির্ধারিত হয় প্রাপ্ত ভোট শতাংশের অনুপাতে। বহুদলীয় গণতন্ত্রে এ ধরনের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে কোনও দলের পক্ষেই একক গরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন। ইজ়রায়েলের মতো মিশ্র সমাজে তো বটেই— জনসংখ্যার তিন-চতুর্থাংশ ইহুদি এবং এক-পঞ্চমাংশ আরব। গত চার বার নির্বাচন-পরবর্তী বিস্তর দরাদরি বিফলে গিয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ জোট গড়ে ওঠেনি। তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নিজেই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত— বিচারাধীন। প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি চলে গেলে বিচারে তাঁর জেলও হতে পারে। তাই নেতানিয়াহুর লড়াইটা শুধু রাজনৈতিক জীবনের বাজি নয়। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের গতিপ্রকৃতিও নির্ধারিত হতে পারে ভোটের ফলে।

ইজ়রায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী থাকা নেতানিয়াহুকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রায়-অসম্ভব ঘটনাটা বাস্তবায়িত হতেই যাচ্ছিল। এবং তৈরি হচ্ছিল এক অনন্য ইতিহাস, যার গুরুত্ব ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হয়তো আরব-ইহুদি সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করতে পারত— প্রথম বার একটি আরব পার্টি যোগ দিতে যাচ্ছিল ইজ়রায়েলের সরকারে। নাম, ‘ইউনাইটেড আরব লিস্ট’ (র‌্যাম)। ‘ইয়ামিনা’ ও ‘ইয়েশ আতিদ’ পার্টির নেতারা নেতানিয়াহু-বিরোধী ছয়দলীয় জোটের আলোচনা প্রায় গুটিয়ে এনেছিলেন। জোট যখন প্রায় দানা বেঁধে উঠেছে, তখনই ইজ়রায়েলের আকাশে উড়ন্ত রকেট, গাজ়া ভূখণ্ডে ইজ়রায়েলি বিমানের সক্রিয়তা এবং মিশ্র ইহুদি-আরব শহরগুলিতে সংঘর্ষ থমকে দিল সব কিছু। গাজ়া ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রক ‘হামাস’-এর সঙ্গে আদর্শগত ভাবে সম্পৃক্ত র‌্যাম। র‌্যাম নেতা মনসুর আব্বাসকে তাই সরকার গঠনের আলোচনায় বিরতি দিতেই হয়েছে। তৈরি হতে চলা ইতিহাসও থমকে গিয়েছে।

Advertisement

এই অশান্তির ফলে যদি শেষ পর্যন্ত নেতানিয়াহু-বিরোধী জোট সরকার তৈরি না হয়, তা হলে শিগগির ফের ভোট দেখতে চলেছে সে দেশ; আড়াই বছরের মধ্যে পঞ্চম নির্বাচন। এবং নেতানিয়াহুকে অন্তর্বর্তিকালীন প্রধানমন্ত্রী রেখেই। তাই ইজ়রায়েল-গাজ়ার এই সংঘর্ষ হয়তো আপাতত কিছুটা আয়ু দিল নেতানিয়াহুকে। কিন্তু এমন সময়ে হামাস এই সংঘর্ষের শরিক হতে গেল কেন? নেতানিয়াহু আর হামাসের সম্পর্কটিকে অনেকেই বলেছেন: উদ্দেশ্যমূলক সহযোগী। অর্থাৎ, যারা পারস্পরিক বিরোধিতার মাধ্যমেও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে। নেতানিয়াহু ও হামাসের কেউই যে ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন বিষয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জ ঘোষিত ‘দ্বৈত রাষ্ট্র’ সমাধানসূত্রে খুব একটা আগ্রহী নয়, তা পরিষ্কার। ২০০৯-এ ক্ষমতায় ফেরার সময় নেতানিয়াহু হামাসকে খতম করার অঙ্গীকার করলেও তার পরের বছরগুলিতে তেমন প্রয়াসও বড় একটা দেখা যায়নি।

ইজ়রায়েলের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার শুরু ২০১৮-র নভেম্বরে, যখন গাজ়ায় হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির প্রতিবাদে আভিগদোর লিবারমান-এর দল ‘ইজ়রায়েল বেইতেইনু’ বেরিয়ে যায় নেতানিয়াহুর জোট সরকার থেকে। চলমান ইজ়রায়েল-গাজ়া সংঘর্ষ তাই নেতানিয়াহুর পক্ষে রাজনৈতিক ভাবে অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। এমনিতে নিরন্তর হানাহানির আবর্তে বাস করা ইজ়রায়েলিদের একাংশের কাছে নেতানিয়াহুর ভাবমূর্তি ‘মিস্টার সিকিয়োরিটি’। বর্তমান সংঘর্ষে হামাসের তরফ থেকে ধেয়ে এসেছে কয়েক হাজার রকেট। এর পরে নির্বাচন হলে নেতানিয়াহুর ভাবমূর্তি কিছুটা পোক্ত হওয়ারই কথা। তবে তা সরকার গঠনের পক্ষে যথেষ্ট কি না জানা নেই। ২০১৪-র গাজ়া যুদ্ধ ৫১ দিন ধরে চললেও ১৯৮৭ ও ২০০০’এ শুরু হওয়া দুটো ‘ইন্তিফাদা’ বা প্যালেস্টাইনি অভ্যুত্থান যথাক্রমে ছয় ও চার বছর ধরে ঘোলাটে করে তুলেছিল পশ্চিম এশিয়ার দৈনন্দিন জীবন।

এ বার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেন শান্তি চেয়ে দ্রুত বার্তা দিয়েছেন। শান্তি চেয়েছে ফ্রান্স-সহ অনেক দেশ। হামাসও হয়তো এই সময়ে ততখানি ‘ধাক্কা’য় যেতে আগ্রহী হচ্ছে না। ঘোষিত হয়েছে যুদ্ধবিরতি। কার হার, কার জিত— তরজা অব্যাহত! এটা ঠিক যে এই মুহূর্তে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ নেতানিয়াহুর পক্ষে যতখানি ‘জীবনদায়ী’, হামাসের জন্য ততখানি নয়। তবু শান্তি বিঘ্নিত করে ইজ়রায়েলের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়াই তাদের জিয়নকাঠি। মাঝে মাঝে এই নড়াচড়া তাদের পক্ষে খুব দরকারি!

১৯৬৭-র আরব-ইজ়রায়েল ছ’দিনের যুদ্ধের অর্ধশতাব্দীরও বেশি কেটে গিয়েছে। যে অনিশ্চয়তার মধ্যে গাজ়া বা ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের দিনযাপন, তাতে বড়সড় বদল ঘটার ইঙ্গিত এখনও দেখা যায় না। বহু মানুষ বিচ্ছিন্ন হন পরিমণ্ডল থেকে, তবু জেরুসালেম নামের সাঙ্ঘাতিক ‘টাইম বম্ব’টা টিকটিক করতেই থাকে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অস্থিরতা তাড়িয়ে ফেরে গাজ়া বা ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের জীবনকে। আর মাঝে মাঝে এই যুদ্ধও চলতেই থাকে। আরও কত যুগ কেউ জানে না!

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement