মধ্যপ্রদেশের একটি জনসভায় হিন্দিতে অনূদিত এমবিবিএস পাঠ্যবইয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন কেন্ত্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ফাইল চিত্র।
১৬ অক্টোবর মধ্যপ্রদেশে একটি জনসভায় হিন্দিতে অনূদিত এমবিবিএস পাঠ্যবইয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা করেছেন, উচ্চশিক্ষার সব ক্ষেত্রেই এ বার পড়ানো, প্রশিক্ষণ, পরীক্ষা প্রভৃতি আঞ্চলিক ভাষায় হবে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, এর ফলে ‘ব্রেন ড্রেন’ বন্ধ হয়ে ‘ব্রেন গেন’ হবে। অর্থাৎ, মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা দেশেই থাকবে, বিদেশে চলে যাবে না। ইংরেজি না জানার ফলে ভারতের তরুণ-তরুণীদের বিদেশ যেতে না পারাকে জাতির ‘লাভ’ বলা চলে কি না, সেটা অন্য প্রশ্ন। আরও বড় আশঙ্কা, যে ভাবে হিন্দিকে জাতীয় ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ শুরু হয়েছে, তাতে আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষা কার্যত হিন্দিতে শিক্ষায় পর্যবসিত হবে না তো?
ভারতীয় ভাষায় মেডিসিনের চর্চার (‘ভার্নাকুলারাইজ়েশন’) উদ্যোগ শুরু হয় ২০০ বছরেরও বেশি আগে। বাংলার পাশাপাশি এগিয়ে আসে তামিলনাড়ু, কেরল, নানা হিন্দিভাষী অঞ্চলও। ১৮১৯ সালে বাংলায় শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত হল উইলিয়াম কেরির বড় ছেলে ফেলিক্স কেরির লেখা বিদ্যাহারাবলী, যা বাংলায় প্রথম অ্যানাটমি চর্চার বই। ঔপনিবেশিক কর্তাদের ইচ্ছেয়, প্রধানত সামরিক বাহিনীতে প্রশিক্ষিত আধা-চিকিৎসকের ঘাটতি মেটানোর জন্য, বাংলা, উর্দু, নাগরি এবং ফার্সিতেও মেডিক্যাল শিক্ষা দেওয়া হত। ভারতে আধুনিক মেডিক্যাল শিক্ষার জন্য প্রথম যে স্কুল তৈরি হয়, সেই নেটিভ মেডিক্যাল ইনস্টিটিউশন-এ এই চারটি ভাষায় পড়ানো হত। এমনকি মেডিক্যাল কলেজেও ইংরেজিতে ক্লাসের সঙ্গে কিছু দিনের জন্য ‘হিন্দুস্থানি ক্লাস’ খোলা হয়।
নজর করলে বোঝা যায়, দু’ধরনের উদ্দেশ্য থেকে ভারতীয় ভাষায় পাঠ্যবই লেখা চালু হল। এক দিকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রাবল্যের সময়ে ভারতীয়রা নিজেদের আগ্রহে ইংরেজি বইগুলোর (মেডিক্যাল টেক্সটের কথাই শুধু আলোচনায় রাখছি) আঞ্চলিক ভাষায় অনুবাদ শুরু করলেন। ইংরেজি মেডিক্যাল বইয়ে ব্যবহৃত ছবি বা ‘ডায়াগ্রাম’-এর সঙ্গে ব্যবহৃত শব্দগুলি প্রতিস্থাপিত হল সংস্কৃত, তামিল, বাংলা, হিন্দি, মালয়ালি প্রতিশব্দ দিয়ে। উদ্দেশ্য— আয়ুর্বেদে প্রাচীন কাল থেকেই অ্যানাটমি, ফিজ়িয়োলজি এমনকি ব্যাক্টেরিয়োলজির উন্নত জ্ঞানও মজুত ছিল, তা প্রমাণ করা। অন্য দিকে, ইংরেজদের তরফে আঞ্চলিক ভাষায় মেডিক্যাল পাঠ্যের অনুবাদ করার কার্যক্রম। লক্ষ্য, পাশ্চাত্যের জ্ঞানকে আরও বেশি ভারতীয়ের কাছে সহজ করে তোলা, যাতে বিদেশি শাসনের বনিয়াদ মজবুত হয়। তবে দু’ক্ষেত্রেই লক্ষণীয়, বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণার প্রতি আগ্রহের অভাব। ব্রিটিশের তরফে তাগিদ ছিল সেনাবাহিনীর চিকিৎসকের প্রয়োজন মেটানো এবং শিক্ষার খরচ বাঁচানো। ভারতীয়দের প্রধান তাগিদ ছিল অতীত গৌরবের প্রতিষ্ঠা। যদিও, সে সময়ের ‘হিন্দুত্ব’-এর চরিত্র ছিল বহুভাষিক— বাংলা, হিন্দি, তামিল, মালয়ালি, সব ভাষাই ছিল।
ভিন্ন এক যাত্রা দেখি জাপানে। প্রধানত মেইজি রাজত্বকালে, অর্থাৎ ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে জাপানে জাপানি ভাষায় মেডিক্যাল শিক্ষা শুরু হয়। প্রভেদ হল, ও দেশে কেবল মাতৃভাষায় পাশ্চাত্য মেডিসিনের পঠনপাঠনই উদ্দেশ্য ছিল না, এই উদ্যোগের মূল চালিকাশক্তি ছিল নতুন গবেষণার অভিমুখে যাত্রা। ইউরোপীয় জ্ঞান আত্তীকরণের কয়েক দশকের মধ্যে, ১৮৯৪ সালে প্লেগের জীবাণু আবিষ্কারের অন্যতম দাবিদার হলেন জাপানি গবেষক কিতাসাতো। জাপানে মূলত তিনটি বিষয়কে বিবেচনায় রাখা হয়েছিল— ১) বিশেষ অভীষ্ট লাভের জন্য ভাষা শিক্ষা, ২) ভাষা শিক্ষার লক্ষ্যে ভাষা শিক্ষা, এবং ৩) জ্ঞানের আদানপ্রদানের জন্য ভাষা শিক্ষা। ভাষা শিক্ষার সঙ্গে মৌলিক ভাবনা এবং গবেষণার প্রতি রাষ্ট্রের উৎসাহের ফলেই ১৮৯৭ সালে ‘ডিসেনট্রি’-র জীবাণুর আবিষ্কার করেন শিগা কিয়োশি, যাঁর নামে ‘শিগেলোসিস’ রোগের নামকরণ হয়। ১৯৪৯ সাল থেকে ধরলে এশিয়ার সবচেয়ে বেশি নোবেলজয়ী রয়েছেন জাপানে।
অতএব দেশের ভাষায় ডাক্তারি পড়ার প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েও প্রশ্ন করতে হবে, সেই পঠনপাঠন কি কেবল পরীক্ষা পাশ এবং অর্থোপার্জনের পথ হবে? যে অল্পসংখ্যক জিজ্ঞাসু, মেধাবী পড়ুয়া চিকিৎসা বিজ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করে মানবদেহের নতুন নতুন রহস্য উন্মোচন করতে চান, তাঁদের উপযোগী বই, সাম্প্রতিকতম গবেষণাপত্র ভারতীয় ভাষায় মিলবে তো? রাষ্ট্র তার জোগানে উৎসাহী না হলে জ্ঞানের আন্তর্জাতিক জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা হবে কী ভাবে? ভাষা যদি জ্ঞানের সীমান্ত সঙ্কুচিত করে, তা হলে মৌলিক গবেষণা হওয়া কঠিন। কার্যত এক দল মেডিক্যাল কেরানি বা ‘এডুকেশন ম্যানেজার’ তৈরি হবে, যাঁদের চোখে বিজ্ঞান-সাধনার স্বপ্ন নেই, চিন্তায় ‘কেন’ প্রশ্ন নেই। যে ভাবে গবেষণার বরাদ্দ ক্রমাগত ছাঁটছে সরকার, তাতে গবেষণার উপযোগী বিপুল পাঠ-উপকরণের অনুবাদে বিনিয়োগ হবে কি না, সে সংশয় থেকেই যায়। এ পথে ‘ব্রেন গেন’ সত্যিই হবে তো?