মন্দির রাজনীতি আর মণ্ডল রাজনীতির সেই পুরনো জট
Ayodhya Ram Mandir

এক মন্দির, অনেক হিসাব

নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর তাঁর প্রিন্সিপাল সচিব হিসাবে কাজ করেছিলেন নৃপেন্দ্র। এখন তিনি অযোধ্যায় শ্রীরামজন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের মন্দির নির্মাণ কমিটির চেয়ারম্যান।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৫:২১
Share:

নবনির্মাণ: দ্রুতগতিতে রামজন্মভূমি মন্দির তৈরির কাজ চলছে, অযোধ্যা, ৫ সেপ্টেম্বর। ছবি: পিটিআই।

মাস ছয়েক আগে নৃপেন্দ্র মিশ্র অযোধ্যায় নির্মীয়মাণ রামমন্দির নিয়ে চমকপ্রদ কিছু তথ্য জানিয়েছিলেন। তা হল, রামমন্দিরের চত্বরে আরও সাতটি মন্দির তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সাতটি মন্দিরে মহর্ষি বাল্মীকি, শবরী, নিষাদরাজ, অহল্যা, বশিষ্ঠ, বিশ্বকর্মা ও অগস্ত্য মুনির পুজো হবে।

Advertisement

নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর তাঁর প্রিন্সিপাল সচিব হিসাবে কাজ করেছিলেন নৃপেন্দ্র। এখন তিনি অযোধ্যায় শ্রীরামজন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের মন্দির নির্মাণ কমিটির চেয়ারম্যান। নৃপেন্দ্র জানিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রামমন্দির নির্মাণের অগ্রগতির পর্যালোচনা বৈঠকে প্রথম এ বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখানে মোদী বলেন, রাম তাঁর ১৪ বছরের বনবাসের সময়ই মর্যাদা পুরুষোত্তম হয়ে উঠেছিলেন। কারণ এই সময়ই তিনি সামাজিক সংযুক্তিকরণের নীতি স্থির করেছিলেন। রামমন্দিরেও এই বার্তা থাকতে হবে। যাতে গোটা দেশের মানুষ রামমন্দিরের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন। নরেন্দ্র মোদীর এই দিশানির্দেশ পেয়েই রামমন্দিরে দক্ষিণ ভারতের মন্দিরের মতো সুউচ্চ, কারুকার্যকরা প্রবেশদ্বার বা গোপুরম তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। যেমনটা তামিলনাড়ুর মীনাক্ষী মন্দির বা কেরলের পদ্মনাভস্বামী মন্দিরে দেখা যায়। যাতে উত্তর ভারতের হিন্দি বলয়ের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতের মানুষও উত্তরপ্রদেশের রামমন্দিরের সঙ্গে একাত্ম বোধ করেন।

রামমন্দির চত্বরে সাতটি মন্দির তৈরির ভাবনার পিছনে আরও বড় লক্ষ্য কাজ করছে। তা হল, রামমন্দিরের সঙ্গে হিন্দু সমাজের সমস্ত জাত, গোষ্ঠী, শ্রেণির ভাবাবেগকে জড়িয়ে ফেলা। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, উচ্চবর্ণের সঙ্গে দলিত, জনজাতি, অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যেও রামমন্দির ঘিরে আবেগ নিশ্চিত করা। দলিতরা বাল্মীকির পুজো করেন। নিষাদরাজের পুজো করেন মাঝি, মাল্লা, কৈবর্ত সম্প্রদায়। নিম্নবর্গের মুশাহার জাতির মানুষ শবরীর পুজো করেন। বশিষ্ঠ ব্রাহ্মণ হলেও বিশ্বামিত্র আদতে ক্ষত্রিয়। বিহারের মানুষ অহল্যার মন্দিরে পুজো দিলে তামিলনাড়ু জুড়ে অগস্ত্যের মন্দির ছড়িয়ে রয়েছে। অযোধ্যায় তারই সমাহার চাইছেন নরেন্দ্র মোদী।

Advertisement

মণ্ডল রাজনীতির বিরুদ্ধে বিজেপি-আরএসএস কমণ্ডলুর রাজনীতি শুরু করেছিল। কাঁশীরাম, মুলায়ম সিংহ যাদব, লালু প্রসাদদের দলিত, ওবিসি রাজনীতির মোকাবিলায় জাতপাত নির্বিশেষে গোটা হিন্দু সমাজকে এককাট্টা করে বিজেপি-আরএসএস রামমন্দির আন্দোলন শুরু করেছিল। ১৯৮৯-এ বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্রধান অশোক সিঙ্ঘল বিহারের দলিত যুবক কামেশ্বর চৌপালকে রামমন্দিরের প্রথম শিলাস্থাপনের জন্য বেছে নিয়েছিলেন। নরেন্দ্র মোদী সেই কামেশ্বরকে রামমন্দির তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের অন্যতম সদস্য হিসাবে বেছে নিয়েছেন। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে আগামী বছর জানুয়ারি মাসে রামমন্দির উদ্বোধনের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। সেই মন্দির চত্বরে সাতটি মন্দির তৈরি করে মোদী ভোটের আগে হিন্দুত্বের ছাতার তলায় দলিত, জনজাতি, ওবিসি সবাইকেই এককাট্টা করতে চাইছেন।

মুশকিল একটাই। মোদী যখন মণ্ডল বনাম কমণ্ডলু রাজনীতির চূড়ান্ত ফয়সালা করে ফেলতে চাইছেন, তখন ফের মণ্ডল রাজনীতি মাথাচাড়া দিতে চাইছে। নীতীশ কুমার, লালু প্রসাদ-তেজস্বী যাদব, অখিলেশ যাদবরা অনেক দিন ধরেই জাতগণনার দাবি তুলছেন। তাঁদের সঙ্গে এ বার কংগ্রেসও যোগ দিচ্ছে। রাহুল গান্ধী কর্নাটকের বিধানসভা ভোটের আগেই ‘জিতনি আবাদি, উতনা হক’-এর দাবি তুলেছিলেন। এ বার আগামী সপ্তাহে সংসদের বিশেষ অধিবেশনের আগে সনিয়া গান্ধীও প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে জাতগণনার দাবি তুলেছেন।

অঙ্কটা স্পষ্ট। বিজেপি নরেন্দ্র মোদীর ওবিসি পরিচিতি-কে কাজে লাগিয়ে উচ্চবর্ণের সঙ্গে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বা ওবিসি ভোটও পাকাপাকি ভাবে নিজের ঝোলায় পুরে ফেলতে চাইছে। বিরোধীদের লক্ষ্য, ওবিসি-দের জনসংখ্যা অনুযায়ী সংরক্ষণের দাবি তুলে তাতে বাধা দেওয়া। মণ্ডল কমিশন ওবিসি-দের জন্য ২৭ শতাংশ সংরক্ষণ করেছিল। কারণ তফসিলি জাতি, জনজাতির জন্য মোট ২২.৫ শতাংশ আসন সংরক্ষিত। মোট সংরক্ষিত আসন ৫০ শতাংশের বেশি হতে পারে না। কাজেই মোট সংরক্ষিত আসন ৪৯.৫ শতাংশে বেঁধে রেখে ওবিসি-দের জন্য ২৭ শতাংশ আসন সংরক্ষিত করেছিল মণ্ডল কমিশন। তার সঙ্গে ওবিসি-দের জনসংখ্যার কোনও সম্পর্ক ছিল না। বাস্তবে ওবিসি-দের জনসংখ্যায় ভাগ ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বলে অনেকের অনুমান। জাতগণনা হলে তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। মোদী সরকার জাতগণনার দাবি তো মানেইনি। ২০২১-এ যে জনগণনা হওয়ার কথা ছিল, তা-ও স্থগিত রেখেছে। সম্ভবত জনগণনা হলে তার সঙ্গে জাতগণনার দাবি আরও জোরালো হবে আশঙ্কা করে। বিরোধীরা মনে করছেন, বিজেপি ওবিসি-দের জনসংখ্যা অনুযায়ী সংরক্ষণ দিতে না চাইলে তাদের ক্ষোভের মুখে পড়বে। ওবিসি-দের সংরক্ষণ বাড়াতে গেলে জেনারেল ক্যাটেগরি বা উচ্চবর্ণের ক্ষোভের মুখে পড়বে।

প্রশ্ন হল, নরেন্দ্র মোদী কি এই জাতগণনার দাবির মুখে ওবিসি ভোটব্যাঙ্ককে আরও মজবুত করতে রোহিণী কমিশনের রিপোর্টকে হাতিয়ার করবেন?

বিরোধী শিবিরের একটা বড় অংশের আশঙ্কা, নরেন্দ্র মোদী তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে যাবতীয় নালিশ থেকে নজর ঘোরাতে আগামী সপ্তাহে সংসদের বিশেষ অধিবেশনে রোহিণী কমিশনের রিপোর্ট পেশ করতে পারেন। কমিশনের সুপারিশ মানা হবে কি না, সেটা পরের প্রশ্ন। কিন্তু তা নিয়ে যে জলঘোলা হবে, বিরোধী শিবিরকেও নতুন করে নিজের রণকৌশল ঠিক করতে হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

ছ’বছর আগে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জি রোহিণীর নেতৃত্বে কমিশন তৈরি হয়েছিল। সম্প্রতি কমিশন রাষ্ট্রপতির কাছে রিপোর্ট জমা দিয়েছে। তবে তা প্রকাশ করা হয়নি। কমিশনের কাজ ছিল, ওবিসি-দের মধ্যে কোন সম্প্রদায় কতখানি সংরক্ষণের সুবিধা পেয়েছে, তা খতিয়ে দেখা। প্রয়োজনে ওবিসি-দের জন্য ২৭ শতাংশ সংরক্ষিত আসনের মধ্যে নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ সংরক্ষণ বেঁধে দেওয়া প্রয়োজন কি না, তা সুপারিশ করা।

অনেকেরই মত, ওবিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ২৬০০-র বেশি সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু নির্দিষ্ট প্রভাবশালী সম্প্রদায়ই সংরক্ষণের যাবতীয় সুবিধা ভোগ করছে। ওবিসি সংগঠনগুলির দীর্ঘদিনের অভিযোগ, তাদের মধ্যে ১০ থেকে ১৫টি প্রভাবশালী জাতের মানুষই সংরক্ষিত আসনের ২৫ শতাংশ সুবিধা নিয়ে চলে যাচ্ছে। বাকি ৭৫ শতাংশ ওবিসি, যাঁরা একেবারেই প্রান্তিক, ‘অত্যন্ত অনগ্রসর শ্রেণি’-র মানুষ, তাঁরা যে পিছিয়ে, সেই পিছিয়েই রয়েছেন।

নরেন্দ্র মোদী সামাজিক ন্যায়ের পথে হেঁটে এই প্রান্তিক ওবিসি-দের জন্য সংরক্ষণের বন্দোবস্ত করতে পারেন। কিন্তু তাতে উত্তরপ্রদেশ, বিহারের যাদব, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানার জাঠ, কর্নাটকের গৌড়ারা চটে যেতে পারেন, যাঁরা মূলত এসপি, আরজেডি, রাষ্ট্রীয় লোক দল, জেডি(এস)-এর ভোটব্যাঙ্ক। বিজেপি এই ২৫ শতাংশ ওবিসি ভোটব্যাঙ্কের কথা ভুলে গিয়ে ৭৫ শতাংশ অত্যন্ত অনগ্রসর শ্রেণির কথা ভাবতে পারে। তা হলে মোদীকে এই ভোটব্যাঙ্ক নিয়ে আর ভাবতে হবে না। তবে রাজনাথ সিংহ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় যাদবদের জন্য সংরক্ষণের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিতে গিয়ে হাত পুড়িয়েছিলেন। বিজেপিকে উত্তরপ্রদেশের ভোটে মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছিল। এখন প্রশ্ন হল, নরেন্দ্র মোদী সেই রাজনৈতিক ঝুঁকি নেবেন কি না?

নৃপেন্দ্র মিশ্র বলেছিলেন, নরেন্দ্র মোদী রামায়ণের রামের সামাজিক ন্যায়ের নীতিতে বিশ্বাস করেন। সেই নীতি মানবশরীরের মতো। মানবশরীর খাদ্য থেকে শক্তি গ্রহণ করে। তার পরে শরীরের যে অংশে যেমন প্রয়োজন, সেখানে তেমন ছড়িয়ে দেয়। সংরক্ষণের সুবিধা যাতে সকলে পায়, নরেন্দ্র মোদী কি লোকসভা ভোটের আগে সেই চেষ্টা করবেন?

না কি, তাঁর সামাজিক সংযুক্তিকরণ রামমন্দিরের মধ্যে সাতটি মন্দিরের প্রতীকী বার্তাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement