—ফাইল চিত্র।
কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনই ইজ়রায়েলের গাজ়া আক্রমণ নিয়ে কথা বলতে গেলে আমেরিকার কথা এসেই যায়। শুধু আমেরিকার সরকারের ইজ়রায়েলকে নিঃশর্ত অর্থ, অস্ত্র সাহায্যের কথা বলছি না। যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথম সপ্তাহেই আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক পদাধিকারী পদত্যাগ করেছেন; ১৪ অক্টোবর এক ৬ বছরের প্যালেস্টাইনি শিশুকে ইলিনয়ে হত্যা করা হয়েছে; ৫ নভেম্বর এক ইহুদি বৃদ্ধ খুন হয়েছেন, একাধিক হলিউড অভিনেতা, সাংবাদিক, আইনজীবী, এমনকি চাকরিপ্রার্থী প্যালেস্টাইনের সমর্থনে কথা বলায় কাজ খুইয়েছেন; তিনটি প্রথম সারির বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষকে হেনস্থা করা হয়েছে, যার ফলে এক জন অধ্যক্ষ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন; প্যালেস্টাইনের সমর্থক ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করা হয়েছে; ১৬টি রাজ্যের অ্যাটর্নি জেনারেল সংবাদপত্রকে হুমকি দিয়েছেন যাতে ইজ়রায়েলের সমালোচনা না করা হয়; একটি টিভি চ্যানেলের প্রতিষ্ঠিত অ্যাঙ্করকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে; আমেরিকান কংগ্রেসে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে যে, জ়ায়নবাদের বিরোধিতা মানেই ইহুদি-বিদ্বেষ, অতএব তা সহ্য করা হবে না।
বাক্স্বাধীনতার স্বর্গরাজ্য বলে যে দেশ নিজেদের দাবি করে, সেখানে এই অবস্থা কেন? এই প্রশ্নে আমেরিকায় সরকারি ভাষ্য আর মিডিয়ার ভাষ্য যে অদ্ভুত রকম ভাবে মিলে যায়, এটা আজকের কথা নয়। তার পিছনে গভীর ও ব্যাপক প্রচারপ্রকল্প আছে। এই কাহিনির শুরু ১৯৮২ সালে। আতঙ্কবাদীদের উৎখাত করার অজুহাতে ১৯৮২-র গ্রীষ্মে ইজ়রায়েল হঠাৎ লেবানন আক্রমণ করে, এবং তার প্রায় অর্ধেক অংশ দখল করে ফেলে। ১৭০০০ নিরপরাধ নাগরিক মারা যান, যার মধ্যে ছিল কুখ্যাত দু’টি গণহত্যা— সাব্রা ও শাটিলা নামক দু’টি শরণার্থী ক্যাম্পে প্রায় এক হাজার প্যালেস্টাইনি নাগরিককে রাতের অন্ধকারে হত্যা করা হয়। এই প্রথম আমেরিকার মানুষ টিভিতে ইজ়রায়েলের ধ্বংসলীলার ছবি দেখেন। লেবাননের উপর বিনা প্ররোচনায় আক্রমণকে আমেরিকার সংবাদমাধ্যমের পক্ষে ইজ়রায়েলের আত্মরক্ষার নামে সমর্থন করা সম্ভব ছিল না। সেই প্রথম আমেরিকার মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যমের অধিকাংশই ইজ়রায়েলকে সাম্রাজ্যবাদী আখ্যা দেয়। আমেরিকায় ইজ়রায়েলের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
আমেরিকায় ইজ়রায়েলের সমর্থনকারী গোষ্ঠীগুলির মধ্যে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইজ়রায়েল নিতান্তই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় এক সংগঠিত আরব শক্তির বিরুদ্ধে লড়ছে, এই ভাবমূর্তি আর টিকছে না। নতুন কৌশল দরকার। ১৯৮৪ সালে জেরুসালেমে একটা আন্তর্জাতিক কনফারেন্স আয়োজন হয়, যার নাম ছিল ‘ইজ়রায়েলের গণ ভাবমূর্তি: সমস্যা ও সমাধান’। সেই কনফারেন্স ও তার পরের কিছু আলোচনা থেকে একটা নির্দিষ্ট কৌশল তৈরি হয়, হিব্রু ভাষায় যার নাম ছিল ‘হসবরা’ (অর্থাৎ, প্রোপাগান্ডা বা প্রচারকৌশল)।
হসবরার কয়েকটি মূল মন্ত্র ছিল: ১) প্যালেস্টাইনি প্রতিবাদকে উগ্রপন্থা বলে দেখানো; ২) ইজ়রায়েলি আক্রমণকে আত্মরক্ষা বলে প্রচার করা; ৩) ইজ়রায়েলের বেআইনি দখলদারিকে উহ্য করে দেওয়া; ৪) মিডিয়ায় ইজ়রায়েলের সমর্থকদের অনেক বেশি জায়গা দেওয়া; ৫) প্যালেস্টাইনি নাগরিকদের হত্যাকে দুর্ভাগ্যজনক ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ বলে চালানো; ৬) হসবরাকে ঠিক ভাবে চালনা করার জন্য একটি মন্ত্রিপদ তৈরি করা।
হসবরা এখানেই থেমে থাকেনি। ইজ়রায়েলে একটি টিভি শো জনপ্রিয় হয়, যার কাজ ছিল প্রতিযোগীদের মধ্যে থেকে কে সবচেয়ে প্রভাবশালী হসবরার কৌশল তৈরি করতে পারবে তাকে বেছে নেওয়া। এই ভাবে ইজ়রায়েলি প্রচারকৌশলের যে ভিত আমেরিকায় তৈরি হয়েছিল, তাতে ফাটল দেখা দেয়, যখন অসলো চুক্তি-র পরেও অবৈধ ইজ়রায়েলি বসতি বাড়তে থাকে। ১৯৯৩-এ দু’লক্ষের মতো অবৈধ বসতি ছিল, পরের ১৫ বছরে তা বেড়ে সাড়ে ছয় লক্ষ হয়। এই ফাটলের মোকাবিলা করতে আমেরিকার ইজ়রায়েল লবির একাংশ আবার এক জনসংযোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়, যাঁর নাম ফ্রাঙ্ক লুঞ্জ। তিনি সমীক্ষা করে দেখান যে, অবৈধ বসতি আর দখলদারির প্রশ্নে আমেরিকার জনমত ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে চলে যায়, কিন্তু আতঙ্কবাদের কথা তুলতেই জনমত ইজ়রায়েলের সমর্থনে ঘুরে যায়। জনমত তৈরিতে মিডিয়াকে কী ভাবে ব্যবহার করতে হবে, এই প্রতিবেদনটিতে তার সুস্পষ্ট বিধান আছে। প্রতিবেদনটি পড়লে আমেরিকার গণমাধ্যমে ইজ়রায়েলের সমর্থনে যে আখ্যানটি তৈরি করা হয়, তা স্পষ্ট হয়ে যায়। অবৈধ বসতি বা দখলদারি নিয়ে কথা বলা যাবে না, প্যালেস্টাইনের দাবিকে ইহুদি-বিদ্বেষ বলে দেখাতে হবে, নিরপরাধ নাগরিকের মৃত্যুর প্রতি সমবেদনা জানাতে হবে, হামাসকে আতঙ্কবাদী বলে ঘোষণা করতে হবে ইত্যাদি।
২০১৪-র গাজ়া আক্রমণের পর থেকে আমেরিকাতেও একটা বড় পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। একাধিক সমীক্ষা দেখাচ্ছে যে, যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে ইজ়রায়েলের প্রতি সমর্থন যথেষ্টই কমে গিয়েছে। সম্প্রতি গাজ়া আক্রমণের পর এই প্রথম আমেরিকার ইহুদি সম্প্রদায়ের একটা অংশ ইজ়রায়েলি আক্রমণের নিন্দায় পথে নেমেছেন। কিন্তু আমেরিকান ‘ইজ়রায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি’র নেতৃত্বে লালিত প্রায় ত্রিশটি সংস্থার সম্মিলিত রাজনৈতিক লবি-র রাজনৈতিক প্রভাব এতটাই বেশি যে, একটা খোলা সংঘাত বেধেছে আমেরিকায়, যার প্রভাবে বাক্স্বাধীনতার খোলসটা গিয়েছে সরে। ইজ়রায়েলের গাজ়া আক্রমণ আমেরিকার গণতন্ত্রের সঙ্কটকেই প্রকট করে তুলেছে।