ঋণ মেয়েদের সক্ষমতা বাড়াচ্ছে, না কি তৈরি করছে বিপন্নতা
Loan For The Women

ক্ষুদ্র ঋণের দুর্বহ ভার

এক-একটি মেয়ের ‘ব্যক্তিগত’ ট্র্যাজেডি বুনে চলেছে এক বৃহৎ বিপন্নতার নকশা। প্রচলিত ধারণাটি এই যে, ক্ষুদ্র ঋণের প্রকল্পগুলি সফল। ঋণের অঙ্ক বাড়ছে, শোধও হচ্ছে— অনাদায়ি ঋণ সামান্যই, আর কী চাই?

Advertisement

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:৫৫
Share:

স্বরোজগার: স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ঋণে রঙিন মাছ চাষ। উদয়নারায়ণপুর, হাওড়া। —ফাইল চিত্র।

ভারী উদ্বিগ্ন, বিষণ্ণ হয়ে ফোন করেছিলেন এক অধ্যাপিকা। মফস্‌সল শহরে তাঁর একার সংসারকে শ্রমে, যত্নে আগলে রেখেছিল যে মেয়েটি, সেই মালতী (নাম পরিবর্তিত) কাজে আসার পথে ট্রেনের ধাক্কায় মারা গিয়েছে। শোকের উপর যোগ হয়েছে শঙ্কা, যখন মালতীর বাড়ি গিয়ে তিনি শুনেছেন যে, ছেলের বাইক কিনতে সে চড়া সুদে এক বেসরকারি সংস্থার থেকে দু’লক্ষ টাকা ধার করেছিল। ছিল আগের নানা ঋণও। তবে কি ওটা দুর্ঘটনাই ছিল, না আর কিছু?

Advertisement

এক-একটি মেয়ের ‘ব্যক্তিগত’ ট্র্যাজেডি বুনে চলেছে এক বৃহৎ বিপন্নতার নকশা। প্রচলিত ধারণাটি এই যে, ক্ষুদ্র ঋণের প্রকল্পগুলি সফল। ঋণের অঙ্ক বাড়ছে, শোধও হচ্ছে— অনাদায়ি ঋণ সামান্যই, আর কী চাই? মেয়েদের আরও ঋণ দিতে ব্যাঙ্কগুলোকে তাগাদা দিচ্ছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক। জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা মিশনের (এ রাজ্যে ‘আনন্দধারা’ প্রকল্প) অধীনে পশ্চিমবঙ্গের স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে (সদস্য সংখ্যা ১০-১২ জন) ২০১৫-১৬ সালে এক হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলো, ২০২২-২৩ সালে ঋণের অঙ্ক ছাড়িয়েছে কুড়ি হাজার কোটি টাকা। সুদ সরল হারে ১২ শতাংশ। অসরকারি ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলির সুদ ২৩-২৪ শতাংশ। তবে হ্যাপা কম, বাড়ি এসে ঋণ দিয়ে যায়। ক্ষুদ্র ঋণ ক্ষেত্রে স্বনিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘এমফিন’-এর পক্ষে মনোজ নাম্বিয়ার জানালেন, ২০২২-২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে বাইশটির মতো বেসরকারি সংস্থা (ব্যাঙ্ক এবং অন্যান্য) ন’হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ দিয়েছিল, গ্রহীতা ছিলেন সাড়ে ছ’লক্ষেরও বেশি মহিলা। তবে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যরা যেখানে মাথাপিছু চব্বিশ হাজার টাকার মতো ঋণ পাচ্ছেন, সেখানে অসরকারি ঋণের অঙ্ক মাথাপিছু একচল্লিশ হাজার টাকা।

তার পর? তার পরের ছবিটা আলো-ছায়ার। অনেক মেয়ে ঋণ পেয়ে জীবনের হাল ধরেছে। হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরের পাঁচারুল গ্রাম পঞ্চায়েতের উল্টো দিকে মেয়েদের সমবায় সঙ্ঘের অফিস। সদস্য সুপ্রিয়া পাল টাকা ধার নিয়ে ধান ভাঙানোর মেশিন কিনেছিলেন ছ’মাস আগে, টাকাটা শোধ হয়ে এসেছে। বাসন্তী খাঁড়ার শ্বশুর ছিলেন ভাগচাষি, বাসন্তী এক-এক বার ঋণ নিয়ে জমির মালিকের থেকে একটু-একটু করে জমি কিনছেন। টোটোয় চেপে মেয়েদের মাশরুম চাষ দেখাতে যাওয়ার পথে সম্পাদিকা মিঠু চক্রবর্তী দেখাচ্ছিলেন, “ওই যে বিউটি পার্লার, ওই টেলারিং-এর দোকানগুলো, সব আমাদের টাকায়। আমাদের মেয়েরা খুলেছে।” সেই সঙ্গে মেয়েরা সম্মান পেয়েছে পরিবারে, সমাজে। ‘গ্রুপের মিটিং’ করতে, বা ট্রেনিং নিতে তারা স্বচ্ছন্দে বাড়ি থেকে বেরোয়।

Advertisement

ছায়া ঘনাল দীনবন্ধু পালের কথায়। প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধান, বর্তমানে জেলা পরিষদের কৃষি কর্মাধ্যক্ষ দীনবন্ধুবাবু পাঁচারুল পঞ্চায়েতের জানলার দিকে হাতটা বাড়িয়ে বললেন, “ওই বাড়িটা দেখছেন? ওর ছেলে বিয়ের ছ’মাস পরে বৌকে দিয়ে ঋণ তুলিয়েছিল, টোটো কিনবে বলে। ছেলে মাতাল, টাকা শোধ দেয়নি। চাপের মুখে মেয়েটা বাপের বাড়ি চলে গিয়েছে।” এমন অসহায়তার গল্প গ্রামে গ্রামে। বাগনানে এক দশকেরও বেশি ‘কালেকশন এজেন্ট’-এর কাজ করছেন ডলি চক্রবর্তী। বললেন, “স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ঋণ নিয়ে দশ জনে দু’জন মেয়ে হয়তো নিজে ব্যবসা করে, আট জনই তুলে দেয় স্বামীর হাতে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বামী এক-দু’মাস কিস্তি দিয়ে আর দেয় না, মেয়েটি শোধ করে।” এই অনুপাতের আন্দাজ নানা রকম— কেউ বলেন, সত্তর শতাংশ ঋণই পরিবার নেয়, মেয়েটিকে শোধ করতে হয়, কেউ বলেন, অর্ধেক। বারুইপুরের একটি মহিলা সংগঠনের নেত্রী মীনা দাস জানালেন, আমপানের পর বহু মেয়ে ঋণ নিয়েছিল ফলের বাগান ফের তৈরি করতে। মেয়েরাই খেতমজুরি করে ফেরত দিয়েছে, পরিবার সে টাকা দেয়নি। “বাড়ি সারানো, বাইক-স্কুটি কেনা, বিয়ে-শাদি, যে সব খরচ পুরুষরাই বহন করত, সেগুলোর জন্য এখন মেয়েদেরই ঋণ নিতে হচ্ছে, শোধও করছে,” বললেন মীনা। দু’বারের নারী-শিশু কর্মাধ্যক্ষ এক তৃণমূল নেত্রী আক্ষেপ করলেন, বহু মেয়ে শ্বশুরবাড়ির চাপে, মারধরে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হচ্ছে ঋণ নিতে। একটা ঋণ শোধ করতে আর একটা নিচ্ছে, ক্রমাগত জড়াচ্ছে ঋণের জালে।

মনে হতে পারে, পারিবারিক রোজগার বাড়াতে শ্রম তো দিতেই হবে। পুরুষই দিক আর মেয়ে, তফাত কোথায়? তফাত আছে বইকি। ভারতে শহরাঞ্চলে স্বনিযুক্ত পুরুষদের গড় রোজগার মাসে প্রায় ষোলো হাজার টাকা, আর মেয়েদের সাড়ে ছ’হাজার টাকা, অর্থাৎ পুরুষরা রোজগার করছে প্রায় আড়াই গুণ বেশি (দ্য ডিসক্রিমিনেশন রিপোর্ট, অক্সফ্যাম)। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক প্রকাশিত তথ্য (২০১০-২০) অনুসারে, পুরুষ-শ্রমিকদের দৈনিক গড় আয় ৩৪৮ টাকা, মেয়েদের ২৭৮ টাকা। তার উপর জরি, পাট, বিড়ি, টেলারিং, প্রায় সব ‘ফুরন’-এর কাজে মেয়েদের মজুরি কমছে। অর্থাৎ, একই অঙ্কের ঋণ শোধ করতে পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের শ্রম দিতে হয় অনেক বেশি। এই তারতম্যের হিসাবটা কেউ করে না, কারণ শ্রমের বিনিময়ে মেয়েদের যে কিছু পাওয়ার কথা, সেটাই কেউ স্বীকার করে না।

ক্ষুদ্র ঋণ কর্মীদের সঙ্গে যত কথা বলা যায়, তত স্পষ্ট হয় যে, ‘সক্ষমতা’ তৈরির প্রকল্প আসলে দাঁড়িয়ে মেয়েদের সংসার ছেড়ে উধাও হওয়ায় অক্ষমতার উপরে। পরিবারের চাষের খরচ মেটাতে, ব্যবসায় টাকা ঢালতে, টোটো বা ভ্যান কিনতে মেয়েরা বন্ধক রাখছে নিজের শ্রমক্ষমতা। যদিও সে সব জমি, ব্যবসা বা সম্পদের কাগজে মেয়েটির নাম লেখে না পরিবার। আর সরকারি প্রকল্পের কর্তা, ব্যাঙ্ক কর্তা কেবল দেখেন সংখ্যা— ঋণ নেওয়া আর শোধের। হিসাব মিললে ‘টিক’ চিহ্ন পড়ে যায় নারী সক্ষমতার বাক্সে। কেউ প্রশ্ন করে না, “মহারাজ, পাখিটাকে দেখিয়াছেন কি?”

‘পণ দিলে মেয়ে ভাল থাকবে’— এই ধারণার মতোই প্রশ্নযোগ্য ‘ঋণ দিলে মেয়ে ভাল থাকবে’ ধারণাটিও। পরিবার বরাবরই মেয়েদের শ্রমকে লাগাতে চেয়েছে ঘরের কাজে, পারিবারিক পেশায়। সেখান থেকে মেয়েদের মুক্তি দিতে, তাদের স্বনির্ভর করতে ক্ষুদ্র ঋণের প্রকল্প গ্রহণ করেছিল সরকার। এখন দেখা যাচ্ছে, সেই ঋণের টাকায় পরিবার দখল নিচ্ছে, মেটানোর দায় মেয়েটির, বা তার বাপের বাড়ির। যেখানে মত্ত স্বামীর প্রহার ঘরে ঘরে, সেখানে টাকার উপর মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ থাকার সম্ভাবনা কতটুকু? ক্ষুদ্র ঋণ, বিশেষত চড়া সুদে বেসরকারি সংস্থার ঋণ, মেয়েদের কতখানি শক্তি জোগাচ্ছে, আর কতটা বিপন্ন করছে, তার সমীক্ষা দরকার। সে দাবি তুলবে কে?

তোলার কথা ছিল রাজনীতির। কিন্তু দলীয় রাজনীতিও মেয়েদের দেহ ও টাকার উপর দখল চায়। শাসক দলের যে কোনও সভা-সমাবেশ ভরায় স্বনির্ভর দলের মেয়েরা। স্কুল ইউনিফর্ম তৈরি, সরকারি দফতরে ক্যান্টিন চালানো, হাসপাতালে স্যানিটারি ন্যাপকিন জোগানো— প্রতিটি বরাত পেতে কাটমানি দিতে হয়। পাশাপাশি, মেয়েদের প্রশিক্ষণ, বিপণনের পরিকল্পনাগুলি বাজারের চাহিদার সঙ্গে সম্পর্কহীন। ঋণের হিসাব যত হয়, আয়ের হিসাব তত নয়। অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞরাও মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে উন্নয়ন খোঁজেন না, দেখেন কেবল সূচকের সংখ্যা। এখন দরকার নতুন সূচক। মেয়েরা কত টাকা শোধ করল, দেখলেই হবে না। কী করে শোধ করল, কত শ্রম দিয়ে, কত ঋণ করে, দেখতে হবে তা-ও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement