আনন্দবাদ্য: নাগরিকত্ব আইনের শর্তবিধি ঘোষণার পর মতুয়া সম্প্রদায়ের হর্ষোল্লাস, রানাঘাট, ১৩ মার্চ। পিটিআই।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে জাতির ভূমিকার প্রতি ভারতীয় রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের আগ্রহ ক্রমশই বাড়ছে, বামফ্রন্ট সরকারের পতনের পর থেকে। নাগরিকত্বের প্রশ্নে মতুয়া মহাসঙ্ঘের আন্দোলন এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে মতুয়া-নমঃশূদ্রদের রাজনৈতিক প্রাধান্য বৃদ্ধিই এই প্রবল আগ্রহের প্রধান কারণ। তা ছাড়াও বর্তমানে রাজবংশী, কুর্মি এবং মাহিষ্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও জাতিভিত্তিক রাজনৈতিক সত্তার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পারছি।
কিন্তু যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি লক্ষণীয়, তা হল হিন্দুত্বের রাজনীতির সঙ্গে এই সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সম্পর্ক। এটা সাধারণত মনে করা হয় যে উচ্চবর্ণরাই বিজেপির রাজনৈতিক সমর্থনের মূল ভিত্তি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজনীতির গতিপ্রকৃতি এই প্রচলিত ধারণার পরিপন্থী চিত্র পেশ করছে। সাম্প্রতিক নির্বাচনী ফলাফল থেকে স্পষ্ট যে, উচ্চবর্ণ অধ্যুষিত কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বিজেপির রাজনৈতিক শক্তি বেশ ক্ষীণ। কিন্তু কিছু নির্দিষ্ট নিম্নবর্ণভুক্ত মানুষের বসতিপূর্ণ গ্রামীণ ও মফস্সল অঞ্চলে বিজেপি আকর্ষণীয় রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছে।
বাম সরকারের পতনের সময় নমঃশূদ্রদের একটা বিরাট অংশের সমর্থন তৃণমূল কংগ্রেস পেলেও, বিগত কয়েক বছরে এই পরিস্থিতির আমূল বদল ঘটেছে। নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনের মাধ্যমে এবং সিএএ বিধি চূড়ান্তকরণের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে বিজেপি নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ভুক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন আদায় করতে সফল হবে বলে আশাবাদী। বিজেপির রাজনৈতিক সাফল্য-আশা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপিত করে— ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধী মতুয়া-নমঃশূদ্রদের মধ্যে বিজেপির প্রতি ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সমর্থন কি কেবলমাত্র আদর্শের প্রতি আনুগত্যবিহীন কৌশলী অবস্থান?
ঘটনা হল, বিজেপির প্রতি নমঃশূদ্রদের রাজনৈতিক আনুগত্য স্থানান্তরের কারণ ছিল কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন বা সিএএ আইনের প্রতিশ্রুতি— যা এত দিনে পূর্ণ হল বলে দাবি করছে বিজেপি। কিন্তু সিএএ কেবল একটি সাধারণ আইন নয়, এটি একটি সম্পূর্ণ ‘ন্যারেটিভ’, যা বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তুদের নির্যাতনের স্মৃতির রাজনৈতিকরণের ফল। বিজেপি নমঃশূদ্রদের একটি নিম্নবর্ণের গোষ্ঠী হিসাবে নয় বরং বাংলাদেশ থেকে আগত এবং ধর্মীয় কারণে উৎপাটিত এবং উৎপীড়িত হিন্দু উদ্বাস্তু গোষ্ঠী হিসাবে রাজনৈতিক ভাবে সংগঠিত করছে। ঐতিহাসিক ভাবে নমঃশূদ্রদের মধ্যে প্রবল ব্রাহ্মণ্যবাদবিরোধী জাতিচেতনার অস্তিত্ব থাকলেও, দেশভাগ পরবর্তী ধর্মীয় নিপীড়নের প্রশ্ন বার বার উত্থাপন করে, জাতি পরিচয়ের বদলে বৃহত্তর হিন্দু পরিচয়ের সাহায্য নিয়ে বর্তমানে রাজনৈতিক ভাবে নমঃশূদ্রদের সংহত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় হিন্দুত্বের প্রতি খানিকটা হলেও আদর্শগত আনুগত্যের পরিস্থিতি তৈরি হওয়া স্বাভাবিক।
অন্য দিকে সাম্প্রতিক সময়ে উত্তরবঙ্গে বিজেপির চমকপ্রদ সাফল্যের পিছনে অন্যতম প্রধান কারণ— বিজেপির প্রতি রাজবংশী সম্প্রদায়ের বিপুল সমর্থন। যে রকম নমঃশূদ্রদের ক্ষেত্রে সিএএ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তেমনই রাজবংশীদের একটি অংশের মধ্যে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা নিয়ে একটি পৃথক রাজ্য গঠনের দাবি একটি অন্যতম বিষয়। সরাসরি ভাবে না হলেও এই দাবির প্রতি বিজেপির আপাতত প্রচ্ছন্ন সমর্থন রাজবংশীদের একটি অংশের কাছে বিজেপির গ্রহণযোগ্যতা গড়ে তুলেছে। বিজেপি সম্প্রতি অনন্ত মহারাজকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে রাজ্যসভায় নির্বাচিত করে পাঠিয়েছে। অনন্ত মহারাজ ‘গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন’-এর একটি গোষ্ঠীর প্রধান, যারা উত্তরবঙ্গের কিছু অংশ নিয়ে আলাদা কোচবিহার রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠনের দাবি করে আসছে।
এ ছাড়াও সাম্প্রতিক অতীতে বিজেপি মাহিষ্যদের মতো হিন্দু-মধ্যবর্তী জাতিদের ওবিসি মর্যাদা দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, ওবিসি জনগোষ্ঠীতে মাহিষ্যদের অন্তর্ভুক্তির পক্ষে বিজেপির যুক্তির সঙ্গে মুসলিম তুষ্টিকরণের প্রসঙ্গের যোগসূত্র রয়েছে। তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরে বেশ কিছু সংখ্যক মুসলিম গোষ্ঠীকে ওবিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। রাজ্য সরকারের দাবি যে, তারা রাজ্যের অধিকাংশ মুসলমান গোষ্ঠীকে ওবিসির মর্যাদা দিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিজেপির অভিযোগ যে সরকার ইচ্ছাকৃত ভাবে মহিষ্যদের মতো হিন্দু পশ্চাৎপদ গোষ্ঠীগুলিকে বঞ্চিত করেছে মুসলিমদের অযাচিত সুবিধে পাইয়ে দেওয়ার জন্য। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রেও জাতি রাজনীতির সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী মানসিকতার ও পন্থার এক নিবিড় যোগাযোগ লক্ষ করা যায়।
নিঃসন্দেহে নিম্নজাতির সমর্থন অর্জনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে বড় সাফল্য অর্জন করেছে। তবুও এই সম্প্রদায়গুলির মধ্যে বিজেপির সমর্থনের ভিত্তি এখনও মজবুত বা দীর্ঘমেয়াদি নয়। এই গোষ্ঠীগুলির চাহিদা অনেক ক্ষেত্রে পরস্পরবিরোধী, যা সামলাতে গিয়ে পরবর্তী কালে নানা জটিলতার উদ্ভব হওয়ার সম্ভাবনা। যেমন, নমঃশূদ্ররা সিএএ নিয়ে মহা-উৎসাহিত, কিন্তু রাজবংশীরা তা নয়। বরং তাদের মধ্যে সিএএ নিয়ে আপত্তি ও সন্দেহ আছে। সিএএ আইনি স্বীকৃতি প্রদান করবে বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তুদের বসতিকে, যাদের রাজবংশীদের মতো উত্তরবঙ্গের স্থানীয় জনগোষ্ঠীরা অনেক ক্ষেত্রে বহিরাগত বলে গণ্য করে। এই কারণে রাজবংশীদের এনআরসির প্রতি মনোভাব তুলনামূলক ভাবে অনেকটাই অনুকূল, যা আবার নমঃশূদ্ররা মানতে নারাজ।
গত সপ্তাহে সিএএ-র বিধি চূড়ান্তকরণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলতে পারে। অনেক বিলম্বের পরে সিএএ বিধি প্রণয়ন অবশ্যই নমঃশূদ্রদের খুশি করবে। তবে দীর্ঘমেয়াদে, বিজেপির প্রতি মতুয়াদের সমর্থন নির্ভর করবে নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মগুলি কী ভাবে প্রয়োগ করা হবে, তার উপরে। নাগরিকত্ব প্রদানের প্রক্রিয়া আমলাতান্ত্রিক এবং তার ফলে তা জটিল হতে পারে। সিএএ-র নিয়ম অনুযায়ী বিশেষ কিছু বৈধ নথির মাধ্যমেই আবেদনকারীকে তার আসল জাতীয় পরিচয় (পাকিস্তান/ আফগানিস্তান/ বাংলাদেশ) এবং ভারতে প্রবেশের তারিখ প্রমাণ করতে হবে। সন্দেহাতীত ভাবে এই সমস্ত নথির সত্যতা প্রমাণ করা এতটাই কঠিন এবং জটিল যে, কোনও সরকার বা সরকারি ব্যবস্থার পক্ষে দ্রুত এবং সন্তোষজনক ভাবে সমস্ত আবেদনকে নিরসন করা প্রায় অসম্ভব। তাই নাগরিকত্ব প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রক্রিয়া সংক্রান্ত নানা ব্যবহারিক সমস্যার উদ্ভব ঘটার সম্ভাবনা প্রবল। তা ছাড়াও, নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা মানে কার্যত বাংলাদেশি পরিচয় স্বীকার করে নেওয়া। এই সকল জটিলতা মোকাবিলা করা যে কোনও সরকারের পক্ষে প্রায় অসম্ভব কাজ। সম্ভবত সিএএ বিধি চূড়ান্তকরণে দেরি হওয়ার কারণও ছিল এই সব জটিলতা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সিএএ-র বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিল সমস্যাগুলো যে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে তার সম্ভাবনা প্রবল, যা রাজনৈতিক সমর্থনের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলবে।
আসলে গত কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গে অপরিপক্ব জাতি-রাজনীতির ময়দানেই হিন্দুত্বের বীজ বপন করা হয়েছে। এই বীজ মহীরুহে পরিণত হবে কি না, সময়ই তা বলবে। তবে এই প্রবণতা চার দিকে অনেককেই নতুন করে ভাবাচ্ছে। সাধারণ ভাবে রাজনীতিতে জাতি পরিচয় ও জাতিকেন্দ্রিক দাবি প্রকাশকে, হিন্দু একত্রীকরণের প্রয়াস নির্ভরশীল হিন্দুত্বের রাজনীতির প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এই প্রচলিত ধারণাকে আপাতদৃষ্টিতে খারিজ করছে। সেই সঙ্গে পরিবর্তিত পরিস্থিতি এক নতুন বিশ্লেষণাত্মক কাঠামোর প্রয়োজনীয়তার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, যা আমাদের জাতি রাজনীতি ও হিন্দুত্বের রাজনীতির ভিতরের এই জটিল সম্পর্ককে ঠিক ভাবে বুঝতে সাহায্য করে।