Iran

ইরানের সরকার, ইরানের সমাজ

১৯৭৯-তে শাহ পহলভির স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে যে অভ্যুত্থান ঘটে তাতে সমাজের সর্ব স্তরের পুরুষ ও নারীরা অংশ গ্রহণ করেছিল।

Advertisement

সুপ্রিয় সেন

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:৪১
Share:

এক নতুন সমাজের উত্থানের গোপন পূর্বাভাস ফাইল চিত্র।

গত সেপ্টেম্বরে, রাশিয়ার পার্ম শহরে ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আলাপ হল ইরানের প্রতিনিধি লায়লা হোসেনির সঙ্গে। লায়লা অনুরোধ জানাল, ইরানের ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকারদের জন্য ও দেশে গিয়ে মাস্টার ক্লাস নিতে। আমরা যারা চলচ্চিত্রের আজীবন ছাত্র, ইরান তাদের কাছে নালন্দা, বিক্রমশীলার মতো। আশির দশক থেকে ইরান উপহার দিয়েছে অজস্র সিনেমা যা গভীর ভাবে মানবিক, ভাষাগত ভাবে সম্পূর্ণ নতুন এবং পাশ্চাত্য প্রভাব-মুক্ত। আব্বাস খিয়েরোস্তামি, মহাসেন মখমালবাফ, ডারায়ুস মেহেরুজি, মাজিদ মাজিদি, অথবা হাল আমলের আসগর ফারহাদিরা যে দেশে আন্তর্জাতিক সিনেমার নতুন উত্তরাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেখানে চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করা? এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম।

Advertisement

কিন্তু পর দিন সকালেই দেখি হাসিখুশি লায়লার মুখে গভীর চিন্তার ছাপ। শুনলাম, আগের দিন রাত থেকে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ, বাড়িতে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। মাহশা আমিনি নামে একটি কুর্দিশ ইরানি যুবতীর হিজাব থেকে কয়েক সেন্টিমিটার চুলের রেখা বেরিয়ে থাকার জন্য ইরানের ‘নীতি পুলিশ’ তাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে হেফাজতে অকথ্য অত্যাচারে মেরে ফেলেছে। অন্যান্য বারের মতো মুখ বুজে মেনে না নিয়ে ইরানের মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে।

বুঝতে পারলাম আমন্ত্রণ থাকা সত্ত্বেও ইরান যাত্রা অনিশ্চিত হয়ে পড়ল। রাশিয়া থেকে দেশে ফিরে এলাম। কিন্তু মন পড়ে রইল ইরানে। ও দেশের খবর অনেক ছঁাকনির মধ্য দিয়ে গলে বহির্জগতে পৌঁছয়। সেই সূত্রেই জানতে পারলাম এ বারের লড়াই ‘জান, জাহান, আজ়াদি’র। অর্থাৎ নারী, জীবন আর স্বাধীনতা। শেষ কবে প্রতিবাদ আন্দোলনের স্লোগানে নারীর কথা এ ভাবে উচ্চারিত হয়েছে? মনে পড়ল না।

Advertisement

১৯৭৯-তে শাহ পহলভির স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে যে অভ্যুত্থান ঘটে তাতে সমাজের সর্ব স্তরের পুরুষ ও নারীরা অংশ গ্রহণ করেছিল। কিন্তু শাহের পতনের পর ইসলামিক কট্টরপন্থীরা ইরানের ক্ষমতা দখল করে মহিলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তাদের অধিকার খর্ব করে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানিয়ে রাখবার জন্য নতুন সব আইন আনা হয়। মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানো, শিক্ষার অধিকার সীমিত করা, বিচারব্যবস্থা ও রাজনীতিতে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি আনা হয় হিজাব আইন, ন’বছরের বেশি বয়সি কন্যার প্রকাশ্যে হিজাব পরিধান হয় বাধ্যতামূলক। প্রয়োজনে কড়া ব্যবস্থা নিতে ‘মরালিটি পুলিশ’ রাস্তায় নামে।

ইরান যখন খুবই টালমাটাল, তখনই আমায় অবাক করে ফেস্টিভ্যাল কমিটি ফ্লাইট টিকিট কেটে ভিসা পাঠিয়ে দেয়। উড়োজাহাজ দুবাই ছাড়তেই জানলা দিয়ে দেখি আরবের বিস্তীর্ণ মরু ছাড়িয়ে, ভেসে চলেছি মানবসভ্যতার সূতিকাগার পারস্যের দিকে। যে সভ্যতা পৃথিবীতে প্রথম জলসেচ আর হিমঘর চালু করেছিল, যারা প্রথম মানবাধিকার সনদ রচনা করেছিল, সেই সভ্যতা এতটা পিছনে হাঁটলে অর্ধেক নাগরিকের অধিকার কেড়ে নিতে পারত?

ভাবতে ভাবতেই তেহরান পৌঁছলাম। এয়ারপোর্টে নামতেই দেখলাম বিভিন্ন কোণ থেকে দুই আয়াতোল্লা, রাহুল্লা খোমেইনি আর আলি খামেনেই তাঁদের প্রতিকৃতি থেকে চারিদিকে তীব্র নজর রাখছেন। এবং সেই নজরদারির তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন বয়সের মহিলারা মাথার আচ্ছাদন খুলে সাহসী মুখে নিজের নিজের কাজ করে যাচ্ছেন। গত দু’মাসে এ দেশ যে কতটা বদলে গেছে, পা ফেলতেই সেটা টের পেলাম।

পর দিন ফেস্টিভ্যাল ভেনুতে গিয়ে দেখি, পুরোটাই পরিচালনা করছেন বিভিন্ন বয়সের মহিলারা, কিন্তু তাঁদের উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন সরকারপন্থী পুরুষরা। মাস্টার ক্লাসের কোঅর্ডিনেটর মারিয়া খোবানির সঙ্গে প্রথম দেখায় হাত বাড়াতেই তিনি হাতটা সরিয়ে নিলেন। জিজ্ঞেস করলাম, “কোভিডের ভয়?” চার পাশে ঘিরে-থাকা পুরুষ অফিশিয়ালের দিকে তাকিয়ে বললেন, “না... আমদের সমাজে পুরুষের সঙ্গে হ্যান্ডশেক রীতিবিরুদ্ধ।”

বাইরে থেকে আসা অতিথিদের সঙ্গে যেমন অসাধারণ আতিথেয়তা করা হচ্ছে, তেমন কোথাও একটা নজরদারিও চলছে। এই নজরদারি পেরিয়েই জ্বলন্ত ইরানে উঁকি ঝুঁকি মারতেই দেখলাম কী ভাবে রাস্তার কোণে কোণে কালো পোশাকের সিকিয়োরিটি পুলিশ ওত পেতে বসে আছে শিকারের অপেক্ষায়। জানতে পারলাম মাঝেমধ্যেই তেহরানে বায়ুদূষণের নাম করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, যাতে ছাত্রছাত্রীরা এক হতে না পারে। ইন্টারনেট যে প্রায় বন্ধ সেটা আগেই বাড়িতে যোগাযোগ করতে গিয়ে বুঝেছি। এ সব কারণেই প্রতিবাদের ধরনটাও এখানে অন্য রকম। কোথাও সংগঠিত, পূর্বপরিকল্পিত মিছিল-মিটিং নয়, বরং হঠাৎ করে জড়ো হয়ে স্লোগান, অবরোধ, অথবা সরকারি সম্পত্তিতে আক্রমণ। অন্য দিকে, সিকিয়োরিটি বাহিনীর ব্যাপারটা আদিম। খবর পেয়ে অকুস্থলে পৌঁছে সরাসরি আক্রমণ। খণ্ডযুদ্ধ, গ্রেফতার, সবই ঝড়ের বেগে। মিডিয়া যে ভাবে জ্বলন্ত ইরানকে দেখায় তার ছিটেফোঁটাও ‘গ্রাউন্ড জ়িরো’তে চোখে পড়ল না। মানুষ গুপ্তচর-পরিবৃত, তাই নিজের ছায়াকেও বিশ্বাস করে না: দীর্ঘ একনায়কতন্ত্রের ফলাফল এটা। আমরা ও দেশে থাকার সময়েই অস্কারবিজয়ী চলচ্চিত্র সেলসম্যান (ছবিতে একটি দৃশ্য)-এর নায়িকা তরানে আলিদোস্তি, সোশ্যাল মিডিয়ায় কথা বলার দোষে গ্রেফতার হলেন। অনেকে বেছে নিচ্ছেন মৃদু এবং সৃজনশীল প্রতিবাদপথ। বিখ্যাত অভিনেত্রী কাত্যায়ুন রিহাই হিজাব খুলে নিজের ছবি দিলেন। ইরানি সিনেমার ডিভা নিকি করিমি সমস্ত সৃজনশীল কাজ বন্ধ করে দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন।

মাস্টার ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি আমার দায়িত্ব ছিল ফেস্টিভ্যালের আন্তর্জাতিক বিভাগে জুরি-গিরি করার। এই বিভাগে ছিল বেশ কিছু ইরানি ছবি, যার মধ্যে কয়েকটা আবার মেয়েদের জীবন নিয়ে মেয়েদেরই বানানো সিনেমা। এর মধ্যে একটি ছবি মাম সখু’স হাউস হল মেয়েদের ড্রাগ রিহ্যাব সেন্টারে পরিচালিকা ম্যাডাম সখু ও তাঁর সঙ্গী বন্দিদের নেশা ও সামাজিক বিধিনিষেধের সঙ্গে লড়াইয়ের গল্প, যেখানে মেয়েদের স্বাভাবিক পোশাকে দেখানো হচ্ছে কোনও আড়াল ছাড়াই। ডকুমেন্টারির প্রতি দায়বদ্ধতা বজায় রাখার জন্য যে ভাবে মহিলা চরিত্রদের হিজাব-বিবর্জিত অবস্থায় ক্যামেরার সামনে নিয়ে আসা হল, তা একটা নীরব বিপ্লবের সমতুল্য। দ্বিতীয় ছবি থ্রি নাইন্থস্ থাউজ়্যান্ডথ্‌ আরও গভীর ভাবে ইসলামি কট্টরপন্থী সমাজের দ্বিচারিতাকে তুলে ধরে। ২০১৪ সালে ইসলামিক স্টেটস-এর সদস্যরা কী ভাবে ইরানের ইয়েজ়দি জনজাতির মেয়েদের অপহরণ করে যৌনদাসী বানায় সেই কাহিনি। ক্রমাগত ধর্ষণের ফলে এরা একাধিক সন্তানের জন্ম দেয়। সাত বছর বাদে কিছু মেয়ে যখন সন্তানদের নিয়ে, বহু ঝুঁকি মাথায় করে পালিয়ে এসে রিফিউজি ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়, তখন ইয়েজ়দি মোড়লরা বাচ্চা-সহ মায়েদের গ্রহণ করতে অস্বীকার করে ‘শত্রুর সন্তান’ পেটে ধরার কারণে। ছবিটাতে আমরা এমন তিন মেয়ে চরিত্রকে দেখতে পাই, যারা সন্তানদের বাঁচানোর জন্য নিজের সমাজের পুরুষদের সামনে সরাসরি রুখে দাঁড়ায়।

জেলবন্দি অবস্থায় বানানো জাফর পানাহির সিনেমা বলে দেয়, কোথায় যেন ভয়কে জয় করে ফেলেছে মানুষ। এক নতুন সমাজের উত্থানের গোপন পূর্বাভাস বললে বাড়াবাড়ি হবে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement