—প্রতীকী ছবি।
গোড়ায় সামান্য একটা হোয়াটসঅ্যাপ বা ইউটিউব গ্রুপ সাবস্ক্রাইব করার আহ্বান। তার পর আসবে মাসে মাসে কয়েকশো টাকার সাবস্ক্রিপশনের বিনিময়ে শেয়ার বাজার বিষয়ে নিখুঁত সব পরামর্শ ও তথ্য পাওয়ার বিজ্ঞাপন। টাকার অঙ্কটি এতই কম যে, অধিকাংশ মানুষেরই সেটুকু খরচ করার জন্য বাড়তি ভাবনার প্রয়োজন পড়ে না। তা ছাড়া, যিনি ধারাবাহিক ভাবে শেয়ার বাজারে অনেক টাকার লেনদেনের মধ্যে জড়িয়ে থাকেন, তাঁর কাছে এটা এমন কিছু টাকাও নয়। ফলে, অনেকেই এই বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে টাকা দিয়ে সাবস্ক্রিপশন নেন, তাঁদের কাছে আসতে থাকে শেয়ার বাজার সংক্রান্ত পরামর্শ। ক্রেতারাও বেচাকেনা করতে লাগলেন এই সব টিপস-এর ভরসায়, আর হয়তো কিঞ্চিৎ লাভবানও হলেন। কালক্রমে তাঁদের মধ্যে অনেকেই এই জাতীয় একাধিক গ্রুপের সদস্য হয়ে গেলেন, সেই সব গ্রুপের পরামর্শ অনুসারে নিতে আরম্ভ করলেন লগ্নির সিদ্ধান্ত। যেমনটা বহু মানুষ করেন বিশ্ব জুড়ে।
এ ভাবেই চলছিল। হয়তো চলতও, যদি না ফিনফ্লুয়েন্সর (অর্থাৎ, ফাইনানশিয়াল ইনফ্লুয়েন্সর) বলে চিহ্নিত কিছু ব্যক্তি এবং তাঁদের সংস্থাগুলি ভারতে লগ্নির বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি-র নজরে পড়ত। অনিয়ন্ত্রিত এবং নথিভুক্ত নন, এমন আর্থিক উপদেষ্টা যে বিনিয়োগকারীর ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারেন, সেবি-কে সে কথা আলাদা ভাবে বলে দিতে হয়নি। এঁদেরই এক জন সম্প্রতি খবরের শিরোনামে। সমাজমাধ্যমে তাঁর চার লক্ষ সাবস্ক্রাইবার, এই খবরটাকে ছাপিয়ে যা আলাদা ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তা হল তাঁর সতেরো কোটি টাকার জরিমানা হয়েছে। বিনা নিয়ন্ত্রণে শেয়ার বাজার সংক্রান্ত পরামর্শ দেওয়ার ফল। খবরটা যাঁদের চোখে পড়েছে, তাঁদের হয়তো মনে পড়বে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটি নিজের পরিচয় দিতেন ‘বাপ অব চার্ট’ বলে। শেয়ার বাজারে ‘চার্ট’-এর গুরুত্ব অসীম— এই ব্যক্তির দাবি ছিল, তিনি সেই চার্ট-এর গুরুদেব।
মনে রাখা ভাল যে, নানা ধরনের মধ্যস্থতাকারী সংস্থা এবং পেশাদার পরামর্শদাতা মূলধনি বাজারে চিরকালই আছেন। ইদানীং তাঁদের সংখ্যা বেড়েছে, কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত হয়েছে। চেনার সুবিধার জন্য উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে, আমাদের বিমা করানো অথবা মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ অনেক সময় এঁদের হাত ধরেই হয়ে থাকে। এগুলি নির্দিষ্ট পরিষেবা, যা নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়ম-নীতি মেনে করা হয়ে থাকে। সমস্যা এঁদের নিয়ে নয়।
নথিভুক্তির বাইরেও এক বিরাট ধূসর জগতে অবস্থান করছে অনেক অনামী সংস্থা। আবডালে থাকা তাদের কাজকারবার বহু ক্ষেত্রে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, নিয়মকানুনের প্রয়োগ বাধা পেয়েছে। সাধারণ মানুষ বার বার এদের কাছে ছুটে গিয়েছেন, প্রতারিতও হয়েছেন— মনুষ্যধর্মে লোভ এমনই প্রখর যে, অল্প বিনিয়োগে অল্প দিনে বিপুল লাভ করার প্রতিশ্রুতিসম্বলিত বিজ্ঞাপনের টান অস্বীকার করতে পারেননি অনেকেই। চিট ফান্ড যখন আকাশচুম্বী রিটার্নের চিত্রটি তুলে ধরেছিল, তখন কি কেউ প্রশ্ন করেছিলেন যে, কোন মন্ত্রবলে এমন দুর্দান্ত লাভ হতেই থাকবে নিয়মিত? আজ সমাজমাধ্যমে কার্যত খেয়াল না করলেও চোখে পড়বে, কী প্রবল বেগে অগণিত স্টক টিপস আদান-প্রদান হয়ে চলেছে! শিক্ষামূলক পরিষেবার নামেও অনেকেই নেমে পড়ছেন এই ব্যবসায়। তার সবটা কিন্তু নিয়মের গণ্ডির মধ্যে থাকছে না।
উপদেষ্টার দায়িত্ব অনেক ধরনের হতে পারে, সেখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নির্দিষ্ট নিয়মকানুন আছে। সঠিক পরিষেবা কী, কী ভাবে তা দেওয়া উচিত, কী করলে লগ্নিকারীর স্বার্থ রক্ষা হতে পারে— এগুলি সবই আজ লগ্নির দুনিয়ায় জ্বলন্ত প্রশ্ন। তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন সম্ভাব্য ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ বা স্বার্থের সংঘাত সংক্রান্ত। পরামর্শদাতা এবং তাঁর ক্লায়েন্ট (অর্থাৎ বিনিয়োগকারী), এই দুইয়ের স্বার্থের মধ্যে যদি কোনও ধরনের সংঘাত হয়, তা হলে কী হবে? বহু কাল ধরেই এই সম্ভাবনার প্রসঙ্গটি ঘুরে ফিরে উঠছে। কোনও একমাত্রিক ফর্মুলা মেনে এর উত্তর দেওয়া কার্যত অসম্ভব। হ্যাঁ, বহুবিধ বিধিবদ্ধ ডিসক্লেমার তথা ডিসক্লোজ়ার আছে বটে, কিন্তু অক্ষরে অক্ষরে সব বিধিনিষেধ মানা কঠিন।
বিনিয়োগের বাজারে চলতি কথা, ‘প্ল্যান’ এবং ‘প্রোডাক্ট’ এই দুইয়ের যেন মিলমিশ থাকে। লগ্নিকারীর নিজের আর্থিক পরিকল্পনা, যা ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতার উপর মূলত নির্ভর করে, যেন যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। ভুল প্রোডাক্ট (এখানে শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড, বিমা সবই হতে পারে) নির্বাচন লগ্নিকারীর নিজস্ব দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নষ্ট করে দেবে। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলতে পারি, ঝুঁকির পরিমাণ না বুঝে বিমা কেনা তো জলভাত, প্রায়ই সাধারণ গার্হস্থ জীবনের আর্থিক গন্ডগোলের কেন্দ্রে এই ব্যাপারটি থাকে। আরও একটু বিশদে বললে, কোনও বিশেষ খাতে লগ্নি করছেন, কিন্তু সেই সংক্রান্ত ব্যয় নিয়ে পুরোপুরি অবগত নন, এমন মানুষের সংখ্যা অগণিত। অপ্রিয় হলেও একটা সত্য কথা এখানে বলা প্রয়োজন— কেউ যদি বারে বারেই ভুল পণ্য কেনেন, ভুল জায়গায় লগ্নি করেন, তবে সেই দায় লগ্নিকারীর উপরেই বর্তায় বইকি।
ভারতে এখন সরকারি নীতিই হল, সাধারণ মানুষের সঞ্চয়কে বিনিয়োগে পরিণত করা, অর্থাৎ আরও বেশি মানুষকে মূলধনি বাজারে নিয়ে আসা। অনেকেই ফিক্সড ডিপোজ়িটের গণ্ডি অতিক্রম করে পা বাড়িয়েছেন মিউচুয়াল ফান্ড বা শেয়ারের দিকে। মূলধনি বাজারে সাধারণ মানুষ যাতে দিশাহারা না হন, অথবা প্রতারিত না হন, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব অবশ্যই সরকারের। কিন্তু লগ্নিকারীরও দায়িত্ব আছে। হয় নিজেই লেখাপড়া করে বাজারের বিষয়ে সচেতন হয়ে উঠুন, না হলে ভরসা করুন প্রতিষ্ঠিত নথিভুক্ত আর্থিক মধ্যস্থতাকারীর উপরে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে আসা আকাশছোঁয়া লাভের পিছনে ছুটলে বারে বারেই প্রতারিত হতে হবে।