—ফাইল চিত্র।
এ বারের বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের দিকে একটু লক্ষ করলেই দেখা যেত, সেখানে ছোট শহর, মফস্সল বা নিতান্তই গ্রাম থেকে উঠে আসা ক্রিকেটারদের উপস্থিতি প্রবল। শুভমন গিল, কেএল রাহুল, রবীন্দ্র জাদেজা, মহম্মদ শামি, কুলদীপ যাদব সেই তালিকার কিছু নাম। ১৯৮৩-র দলের সঙ্গে যদি তুলনা করি, তবে সে দলে অধিকাংশ ক্রিকেটারই বড় শহর থেকে উঠে এসেছিলেন; ব্যতিক্রম ছিলেন শুধু কপিল দেব এবং যশপাল শর্মা। ২০১১ সালে কিন্তু অধিকাংশ খেলোয়াড়ই ছোট শহর কিংবা মফস্সল থেকে উঠে এসেছিলেন— হরভজন সিংহ, সুরেশ রায়না, শান্তাকুমারন শ্রীসন্থ, মুনাফ পটেল— তাঁদের মধ্যমণি মহেন্দ্র সিংহ ধোনি স্বয়ং রাঁচীর মতো ছোট শহরের ছেলে। ‘বড় শহরের খেলা’ হিসাবে পরিচিত ক্রিকেটে ছোট শহরের এই উত্থানের কারণ কী?
বদলে যাওয়া গ্রাম-শহরের মানচিত্র তার একটা কারণ বটে। এখনকার মহানগরে খেলার মাঠ কোথায়? সবই তো ঢাকা পড়েছে কংক্রিটে। গ্রাম, মফস্সল, এমনকি ছোট শহরেও সে আকাল নেই— এখনও খেলার জন্য মাঠ পাওয়া যায়। আর ক্রিকেটের মতো আউটডোর গেমের জন্য খেলায় মাঠ পাওয়া খুব জরুরি। অন্তত খেলা শুরু করার জন্য পাড়ার মাঠ চাই। ছোট শহর বা মফস্সলে খেলায় উৎসাহী ছেলেমেয়েরা অল্প বয়স থেকেই মাঠে গিয়ে খেলতে পারে। আর, মহানগরের ছেলেমেয়েদের অনেকেই মোবাইল ফোন কিংবা কম্পিউটারে ভিডিয়ো গেম খেলে। সুবৃহৎ শহরের নামীদামি স্কুলগুলোতে এমনিতেই পড়ার চাপ প্রবল, স্কুলের পড়ার সঙ্গে আছে কোচিং ক্লাসও। খেলার সময় কোথায় তাদের?
সমাজতাত্ত্বিক দীপঙ্কর গুপ্ত বলেছেন যে, একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ভারতের ছোট শহরগুলোই বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়েছে। কারণ ছোট শহরগুলিতে নতুন ‘হোয়াইট-কলার’ মধ্যবিত্ত শ্রেণি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বিশেষ মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে ফ্রিজ-টিভি-এয়ার কন্ডিশনারের মতো কনজ়িউমার ডিউরেবলস থেকে শেয়ার বাজারে লগ্নি, সবেরই চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। ছোট শহরে সচ্ছল জীবনের সন্ধানে থাকা এই মধ্যবিত্তরা বুঝতে পেরেছেন, বর্তমানে ক্রিকেট খেলেও সমৃদ্ধ জীবন-যাপন করা যায়— এবং, তার জন্য জাতীয় দলে সুযোগ না পেলেও চলবে। এর জন্য বিসিসিআই-কে কৃতিত্ব দিতেই হবে। আইপিএলকে কেন্দ্র করে এমন বহু খেলোয়াড় পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে এসেছেন, যাঁরা ছোট শহর, মফস্সল, এমনকি গ্রামেই বেড়ে উঠেছেন। তাঁদের অনেকেই নিতান্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান। কিন্তু এঁরা জানতেন যে, যদি আইপিএলে ভাল পারফর্ম করতে পারেন তা হলে এঁদের জীবন থেকে দারিদ্রের অন্ধকার তাড়াতাড়ি ঘুচে যাবে। এ ক্ষেত্রে খুব ভাল উদাহরণ হলেন ইতিমধ্যেই ভারতীয় দলে খেলে ফেলা যশস্বী জায়সওয়াল এবং তিলক বর্মা।
যাঁরা ছোট শহর থেকে উঠে এসে ভারতের জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কিছু করার একটা বাড়তি তাগিদ কাজ করে বোধ হয়। সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেট খেলে নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে আর্থিক নিরাপত্তা দিতে হবে, সম্মান অর্জন করতে হবে, পেরিয়ে যেতে হবে ছোট শহরের যাবতীয় স্বভাবজ প্রতিবন্ধকতা— চিন্তা-ভাবনার এই স্রোত ছোট শহরের সফল ক্রিকেটারদের মধ্যে প্রবল ভাবে বয়ে যায়। বড় মঞ্চে নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদ থাকে। যাঁরা সফল হয়েছেন, তাঁদের বেড়ে ওঠার পর্বে নজর করলে দেখা যাবে, সেখানে নিয়মানুবর্তিতা, সময়জ্ঞান, মানসিক দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাস এবং শৃঙ্খলাবোধের এক আশ্চর্য মিশেল। এঁরা অনেক সময়েই বড় শহরের বেশি সুযোগ পাওয়া খেলোয়াড়দের টপকে যান। ভয়ডরহীন, হার-না-মানা, ‘খারুস’ ক্রিকেট খেলেন।
তবে, এক জনের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ না করলে ছোট শহরের এই আশ্চর্য উত্থানের রহস্য পুরোপুরি ধরা যাবে না। তিনি মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। মফস্সল তাঁকে দেখে শিখেছিল, কোথা থেকে এসেছি, সেই হীনম্মন্যতাকে কী অনায়াসে অতিক্রম করে যাওয়া যায় নিজের ক্রিকেটীয় দক্ষতার জোরে। তাঁর উত্থান বুঝিয়ে দিয়েছে যে, প্রতিভা ও পরিশ্রমের যথার্থ প্রয়োগ ঘটাতে পারলে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সাফল্যের জন্য পারিবারিক পরিচয় বা বড় শহরের ছাপ থাকার প্রয়োজন পড়ে না। তাঁর প্রভাব কতখানি, বোঝার জন্য এই তথ্যটুকুই যথেষ্ট যে, ২০০৮ সালে প্রখ্যাত ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্সি ফার্ম আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং দ্য ধোনি এফেক্ট : রাইজ় অব স্মল টাউন ইন্ডিয়া শীর্ষক একটি গবেষণাধর্মী রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। আজকের ভারতীয় দলে যে ছোট শহরের খেলোয়াড়রা দাপটের সঙ্গে খেলছেন, এর ট্রেন্ড-সেটার কিন্তু ধোনিই।
বর্তমানের টিম ইন্ডিয়ার দিকে তাকালে এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় যে, ভারতীয় ক্রিকেটে ছোট শহরের হাত ধরেই ‘নতুন ভারত’ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এবং জিতছে। আর এ ভাবেই আমাদের দেশের ক্রিকেটে গণতন্ত্রীকরণ ঘটেছে— শুধুমাত্র বড় শহরের মধ্যেই এই খেলা আটকে নেই। টিম ইন্ডিয়ায় এখন নিত্য-নতুন প্রতিভার নিরন্তর বিস্ফোরণ ঘটছে। এ বারের বিশ্বকাপ হাতছাড়া হয়েছে বটে, কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য ভারতের খেলোয়াড়রা তৈরি।